গণতন্ত্র বিষয়ক বেশ কিছু হতাশাজনক লক্ষণ এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতিতে দৃশ্যমান। তাহার মধ্যে অন্যতম গুরুতর লক্ষণটি— কর্নাটক এবং গোয়া রাজ্য বিধানসভার ঘটনাবলিতে প্রকাশিত। দুই রাজ্যেই অবিজেপি শাসিত সরকার ক্রমশ কোণঠাসা হইতেছে বিধায়কদের দলত্যাগের ঠেলায়। গোয়ায় কংগ্রেসের পনেরো জন বিধায়কের দশ জন দল ছাড়িয়াছেন, আর কর্নাটকে কংগ্রেস-জেডি(এস) সরকারের ১১৮ জনের মধ্যে তেরো জন বিধায়ক পর্যায়ক্রমে পদত্যাগপত্র জমা দিয়াছেন। প্রতি দিন নিত্যনূতন নাটকে স্পিকার-সহ বিধায়করা জড়াইয়া পড়িতেছেন, রাজ্যের শাসনভার কাহার হাতে থাকিবে, সেই ছবিও সঙ্গে সঙ্গে ভোল বদলাইতেছে। বলিবার দরকার নাই যে, এই নাটকের মধ্যে বিরাট ভূমিকায় অবতীর্ণ যে রিপুটি, তাহার নাম লোভ। লোভের আকার-প্রকার সম্পর্কে তথ্য-তত্ত্ব না জানিয়াও এইটুকু বলা যায়: গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জিতিয়া আসিয়া জনপ্রতিনিধিগণ যে আচার-আচরণ করিতেছেন, তাহাতে সর্বাপেক্ষা অপমানিত হইতেছেন জনগণ। নিশ্চয় এই কুনাট্য দেখিবার জন্য জনসাধারণ তাঁহাদের মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন নাই! কংগ্রেসের নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী চিদম্বরম যথার্থ বলিয়াছেন যে, শেষ অবধি ফলাফল যাহাই হউক না কেন, গণতন্ত্রের মুখরক্ষা হইবার সম্ভাবনা রহিল না। নানা উপঢৌকন দিয়া বিধায়ক কেনা-বেচার এই প্রক্রিয়ার মধ্যে গণতন্ত্র নাই— আছে কেবল তাহার প্রতি বিদ্রুপবর্ষণ।
এমন ঘটনা ঘটাইতেছেন যে অলক্ষ্য কুনাট্য-পরিচালকগণ, তাঁহারা বুঝিতে পারিতেছেন কি, নিজেদের ক্ষমতার লোভে দেশের কত বড় সর্বনাশ করিতেছেন? আদর্শ, নীতি, বিবেক, সততা হারাইতে হারাইতে রাজনীতি এখন এক ন্যক্কারজনক জুয়াখেলায় পর্যবসিত। ফিরিয়া ভাবা দরকার, নির্বাচন-পরবর্তী দলত্যাগের ক্ষেত্রে সংবিধানে যে নিয়মাবলি আছে, তাহা পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি না। এই প্রথম বার তো নহে। দলত্যাগ-ঘটিত অচলাবস্থা ভারতীয় রাজনীতিকে বহু বার বিপর্যস্ত করিয়াছে। এ বারেও প্রথমাবধি গোয়া ও কর্নাটকের বিধানসভাকে স্থিরতার ছন্দে আসিতে দেন নাই দুই রাজ্যের শাসক দলের বিধায়করা। ভোটের ফলাফলে কংগ্রেস সেখানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছাইতে পারে নাই ঠিকই— কিন্তু সংবিধান অনুসারে নির্বাচন-পরবর্তী দলীয় বোঝাপড়া করিয়াই সরকার গঠিত হইয়াছিল। অথচ, সরকার গঠনের সময়েও বিধায়কদের কার্যত বন্দি করিয়া দলত্যাগের সম্ভাবনা আটকাইতে হইয়াছিল, এখনও সেই একই ঘটনা ঘটিতেছে। বিবেকবোধ-বর্জিত জনপ্রতিনিধিরা শুধু জাগতিক প্রলোভনের বশে এক দলের চিহ্নে লড়িয়া নির্বাচিত হইয়া সুযোগমতো দল পাল্টাইয়া বিপক্ষে চলিয়া যাইতেছেন।
সমগ্র কুনাট্যে ভারতীয় জনতা পার্টির ভূমিকাটি ভয়ানক রকমের প্রকট। বিজেপি নেতারা নিজেরাও অবশ্য সেই ভূমিকা রাখিয়া-ঢাকিয়া চলিতে ইচ্ছুক নহেন। বিজেপি নেতা নরোত্তম মিশ্র কংগ্রেসের দিকে আঙুল তুলিয়া সহাস্যে বলিতেছেন, এ বার মৌসুমি বর্ষা গোয়া হইয়া কর্নাটক কাঁপাইয়া মধ্যপ্রদেশের দিকে ধাবমান! রাজস্থানের বিজেপি বিধায়ক কাটারিয়া প্রকাশ্যেই আশা প্রকাশ করিতেছেন, এ বার তা হলে রাজস্থানেও ‘সরকার পড়িবে’। পশ্চিমবঙ্গেও আপাতত দলত্যাগ-নাট্য জমজমাট। একের পর এক অবিজেপি রাজ্যকে এই ভাবে অন্যায় ঘুরপথে পর্যুদস্ত করিয়া গোটা দেশে ক্ষমতার পতাকা উড়াইতে প্রত্যাশী কেন্দ্রীয় শাসক দল। ক্ষমতার নেশায় ন্যায়-অন্যায়ের পরোয়া নাই। অথচ অন্যায় পথে ক্ষমতা দখল না করিয়া ন্যায় পথে ভোটে জিতিয়া আসিবার চেষ্টা করিলে, দেশের গণতন্ত্রেরও মঙ্গল হইত, তাঁহাদের প্রতি জনসাধারণের সম্ভ্রমবোধও বাড়িত। ক্ষমতার সহিত ক্ষমতার বৈধতা বলিয়াও একটি কথা হয়। বৈধ পথে থাকিলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে বই কমে না।