ঘরের কাছে পায় না দানা, চাষির ছেলে যুদ্ধে চলে

বেকারত্ব ঘোচাতে মাছে-ভাতে বাঙালিও এখন দলে দলে সেনায় যোগ দিচ্ছে। গ্রামের নাম তাই লোকমুখে হয়ে গিয়েছে ‘আর্মি’ গ্রাম।তবুও মনে হয়, ওঁরা কি সকলেই এ ভাবে এক দিন কফিনবন্দি হবেন বলেই এত কসরত করছেন? চাষি পরিবারের ছেলে প্রসেনজিৎও কি হাল না ধরে হাতিয়ার ধরেছিলেন এই জন্যই? এমন হাজারও প্রশ্ন জিইয়ে রেখেই ফের বীজ বুনবেন চাষি।

Advertisement

গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৮ ২২:৫১
Share:

Shall they return to beating of great bells

Advertisement

In wild trainloads?

A few, a few, too few for drums and yells...’

Advertisement

(The Send-Off: Wilfred Owen)

স্কুল কিংবা কলেজবেলায় আমাদের অনেকেরই পাঠ্য ছিল উইলফ্রেড আওয়েনের এই কবিতাটি। স্যর বলতেন, ‘বিষয়টি ছবির মতো ভাবার চেষ্টা করো।’ আমরা চেষ্টা করতাম। কিন্তু সাদা ফুলের মালা, দল বেঁধে ট্রেনে ওঠা—নাহ্, এমন কোনও ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠত না।

যেটা ভেসে উঠত, সেটা অনেকটা এ রকম— একটা কালো রঙের বড় বাক্স, এক জন জওয়ান, পরনে জলপাই পোশাক, তাঁর সঙ্গী কোনও ভাই বা বন্ধু যিনি সেই জওয়ানকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছেন। প্ল্যাটফর্ম ভর্তি লোক, ফেরিওয়ালার ‘চা গরম’ কিংবা ‘শশা দেব নাকি’-র ভিড়ে কিঞ্চিৎ বেমানান একটা ঢ্যাঙা লোক দাঁড়িয়ে, যিনি আমজনতার থেকে ঈষৎ আলাদা। যাঁর চালচলন, কথা বলার কায়দা স্বতন্ত্র, একটু অন্য রকম। মানে লোকটা আমাদের। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা আবার আমাদের মতো নয়। যিনি সদ্য ছুটি শেষ করে ফিরছে কর্মক্ষেত্রে। কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে!

স্যর কিন্তু গম্ভীর গলায় বলে চলেছেন, ‘So secretly, like wrongs hushed-up, they went./They were not ours:’ আমরা অবাক! এ আবার কেমন কথা? তারা আমাদের কেউ নয়? কে বলল? আওয়েন সাহেব লোক। তিনি এ সব কী করে বুঝবেন? আমরা তখন গুনে গুনে বলে দিতে পারতাম, আমাদের পাড়ায়, গাঁয়ে, এমনকি আশপাশের পাঁচটা গাঁয়ে ক’জন আর্মি, বিএসএফ, সিআরপি-তে চাকরি করেন! তাঁরা যখন ছুটিতে বাড়ি আসতেন কিংবা ছুটি কাটিয়ে ফিরতেন, এক ঘণ্টার রাস্তা যেতে সময় লাগত পাক্কা দেড় ঘণ্টা!

কারণ সেই জওয়ানকে গাঁয়ের রাস্তায় চোদ্দো বার থামতে হত। সে-ও এক যুদ্ধ। মানে সিভিলিয়নদের সঙ্গে আর কি! কারও প্রশ্ন, ‘‘তা বাবা, চাকরি তো হল, এ বার বিয়েটা সেরে ফেলো। তুমি বললে, অমুকের মেয়ের সঙ্গে...’। কারও পরামর্শ, ‘পয়সা নষ্ট কোরো না। বাবা তো সে ভাবে জমি-জিরেত করতে পারল না। এ বার বাবাকে কিছু জমি কিনে দাও। চাষ তোমাদের রক্তে।’ কারও প্রস্তাব, ‘তোমরা তো শুনেছি তাড়াতাড়ি রিটায়ার করো। তা ফিরে এসে কি জমিতেই মন দেবে?’ কারও অনুরোধ, ‘তোমার পুরনো কিছু পশমের পোশাক বা পুরনো জুতো থাকলে থাকলে দিও বাবা। যা শীত পড়েছে। পরে মাঠে যাওয়া যাবে।’

মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, চাষির ছেলে যুদ্ধে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে? সহজ উত্তর, তেমন ভাল কোনও চাকরি মিলছে না। ভবিষ্যতেও যে মিলবে তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। গাঁ-গঞ্জে আজও বহু লোকজন আফসোস করেন, ‘‘অনিচ্ছে সত্ত্বেও ছেলেটাকে বিএসএফের চাকরিতেই যেতে হল।’’ তত দিনে ‘বর্ডার’ সিনেমা দেখা হয়ে গিয়েছে। কেউ সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে ছেড়ে চললেন যুদ্ধে। কারও ‘কনে’ দেখা শেষ। ফিরে এসে বিয়ে করবেন।

হোক সিনেমা, তবুও এই মুহূর্তগুলোর সঙ্গে আমরা ‘রিলেট’ করতে পারতাম। আমাদের চেনাজানা লোকজন, আত্মীয়-স্বজনেরা তো এ ভাবেই চাকরিতে যেতেন। কেউ মিলিটারিতে, কেউ বিএসএফে, কেউ এয়ারফোর্সে, কেউ নেভিতে। কিছু দিন চাকরির পরে তাঁরা বিয়ে-থা করতেন। ছুটিতে বাড়ি ফিরতেন। আবার ফিরতেন কর্মক্ষেত্রে। তার পরে এক দিন অবসর নিয়ে গ্রামে ফিরে ফের চাষ-আবাদ কিংবা ব্যবসা। কালেভদ্রে সীমান্তে গুলিগোলা চললে উদ্বিগ্ন হতেন বাড়ির লোকজন।

কিন্তু বছর কয়েক ধরে এই ছবিটা বদলে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যেই কফিনবন্দি হয়ে গ্রামে ফিরছেন এই রুজির খোঁজে বন্দুক হাতে নেওয়া যুবকের দল। গত কয়েক মাসের মধ্যে এ ভাবেই চলে গিয়েছেন মুর্শিদাবাদের রাধাপদ হাজরা, বোখরার মতিউর রহমান, করিমপুরের অরূপ কর্মকার। সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মীরে সুন্দরবনি সেক্টরে পাক সেনার গুলিতে নিহত হয়েছেন বিএসএফ জওয়ান, হোগলবেড়িয়ার প্রসেনজিৎ বিশ্বাস। শক্তিপুর, সাটুই, কৃষ্ণনগর, মুরুটিয়া, করিমপুর, কাশীপুরের মতো বহু আটপৌরে গ্রামেই মাঝেমধ্যে ঢুকছে কফিন!

সেনা-আধাসেনার চাকরিতে এমনটা হতে পারে জেনেই তো সকলে চাকরি করতে যান। যে চাকরির অজস্র শর্তের মধ্যে মৃত্যুও একটা শর্ত। রোজ সকাল-বিকেল যাঁরা ‘লাইন’-এ যাবেন বলে প্রস্তুতি নেন তাঁরাও হাসতে হাসতেই বলেন, ‘‘মরতে তো এক দিন হবেই। তাই বলে বেকার হয়ে বাড়িতে বসে থাকারও তো কোনও মানে হয় না।’’ আসলে, তখন আর একটা ভাবনাও কাজ করে যে, এ পেশায় মৃত্যু আসতেই পারে। কিন্তু তিনিই যে মরবেন তা বিশ্বাস হয় না। তার পরে প্রশিক্ষণ শেষে চাকরি করতে করতে সেই চাষিবাড়ির ছেলেও অনেক রুখু সত্যি জেনে যান। তাঁর কাশ্মীরে বদলির খবর পেয়েও বাড়িতে তিনি বলেন, ‘‘এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যেখানে যাচ্ছি, সেটা কাশ্মীরের বিপজ্জনক এলাকা থেকে বেশ কিছুটা দূরে। সেখানে কোনও গন্ডগোল নেই।’’

কথাটা মিথ্যে। জওয়ান জানেন। আর সেটা জেনেই বাড়ির লোকজনকে অভয় দেন। কারণ, তিনি জানেন, তিনি নিজে সেনাতে আছেন। তাঁর বাড়ির লোকজন নন। দেশরক্ষার কাজ যেমন তাঁকে করতে হয়, ঠিক তেমনই বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়, বোনের বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে হয়। তাঁর পাঠানো টাকাতেই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চিকিৎসা হয়। উদ্ধার হয় বন্ধক রাখা গয়না। পিঠে অ্যাসল্ট রাইফেল ঝোলে। মাথায় ঘোরে পাটিগণিতের জটিল আঁক। আর সেই কারণেই তাঁকে সুদূর কাশ্মীর কিংবা অরুণাচলে বসেও মাথায় রাখতে হয়, ‘‘ধান উঠে গেল। এ বার সর্ষের মরসুম। চাষের জন্য কিছু বেশি টাকা পাঠাতে হবে।’’

এ ভাবেই চলে জীবন ও সংসারের চাকা। কিন্তু সব এলোমেলো করে দেয় এই কফিন, গান-স্যালুট, আর্ত-কান্না। সিনেমা ও সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, পঞ্জাব কিংবা ভিন্‌রাজ্যের কোনও জওয়ান নিহত হয়েছেন। বাড়িতে ফিরেছে তাঁর দেহ। কান্না, হাহাকারের মধ্যেও সেই জওয়ানের ছেলে প্রতিজ্ঞা করছেন, তিনিও যুদ্ধে যাবেন। বাবার মতো। ঠিক যে ভাবে বাবাও বেছে নিয়েছিলেন পিতামহের পথ। একটা সময় মনে হত, পঞ্জাব আর বঙ্গদেশ তো এক নয়!

এখন মনে হচ্ছে, সত্যিই কি তাই? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রথম প্রজন্মের ছেলেরা সেনায় নাম লেখালেও এখন পরিস্থিতি ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। বেকারত্ব ঘোচাতে মাছেভাতে বাঙালিও এখন দলে দলে সেনায় যোগ দিচ্ছে। মুর্শিদাবাদের বোখরা গ্রামের নাম তাই লোকমুখে হয়ে গিয়েছে ‘আর্মি’ গ্রাম। সে গ্রামের জনা তিরিশেক যুবক আছেন সেনায়। আরও প্রায় তিরিশ জন সকাল-বিকেল প্রস্তুত হচ্ছেন সেনায় যোগ দেবেন বলে। এ বঙ্গেও বাড়ির কাছে সীমান্ত আছে। সেখানেও জওয়ান আছে। তারাও কখনও কখনও প্রশিক্ষণ দেয় স্থানীয় তরুণদের। খোঁজ মেলে কোথায়, কবে, কত লোক নেওয়া হবে। তার পরেই একটা চাকরি। আটপৌরে জীবন খুঁজে পায় অন্য মানে। আর সেই কারণেই প্রত্যন্ত গাঁ-গঞ্জে সাতসকালে দল বেঁধে দৌড়তে থাকেন সেনা-আধাসেনায় নাম লেখাতে চাওয়া ছেলেমেয়েরা।

তবুও মনে হয়, ওঁরা কি সকলেই এ ভাবে এক দিন কফিনবন্দি হবেন বলেই এত কসরত করছেন? চাষি পরিবারের ছেলে প্রসেনজিৎও কি হাল না ধরে হাতিয়ার ধরেছিলেন এই জন্যই? এমন হাজারও প্রশ্ন জিইয়ে রেখেই ফের বীজ বুনবেন চাষি। ফুলে-ফলে ভরে উঠবে জমি। দেখতে দেখতে প্রসেনজিতের ছেলেটাও এক দিন বড় হবে। মাথায় অজস্র প্রশ্ন আর লোকমুখে শোনা বাবার গল্প বুকে নিয়ে এক দিন হয়তো সে-ও পড়বে আওয়েনেরই ‘ফিউটিলিটি’ —‘Are limbs, so dear-achieved, are sides/Full-nerved, still warm, too hard to stir?/Was it for this the clay grew tall?’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement