প্রসঙ্গটা উঠলে এখনও বলেন প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেব, ‘‘সে দিন বুদ্ধদা শুধু তৃণমূল নেত্রীর হাতটা ধরতে বাকি রেখেছিলেন! কত বার বলেছিলেন, রাজি হয়ে যান। মেনে নিন না একটু। আমার জন্য নয়, সরকারের জন্য নয়। রাজ্যের জন্য। কিন্তু উনি মানলেন না। আলোচনা থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন।’’— প্রসঙ্গ দশ বছর আগের। নন্দীগ্রামে ধুন্ধুমারের পরে সিঙ্গুরে তখন রক্তপাতহীন সমাধান বার করার মরিয়া চেষ্টা চলছে। নন্দীগ্রামে ধাক্কা খেয়ে সিঙ্গুর-প্রশ্নে প্রথম দিকের অনড় অবস্থান থেকে অনেকটা সরে এসেছে বামফ্রন্ট সরকার। রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর মধ্যস্থতায় রাজভবনে প্রথম দফার আলোচনা হয়েছে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে। আলোচনার টেবিলে মুখোমুখি হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধান বিরোধী নেত্রী। পরের আলোচনা কলকাতা তথ্যকেন্দ্রে। যে আলোচনার স্মৃতি মনে করিয়ে দেন গৌতমবাবুরা। যে আলোচনা কখনও পরিণতি পায়নি। ৪০০ একরই চাই, তার কমে নয়— এই শর্ত রেখে নিজের অবস্থানে ফিরে গিয়েছিলেন বিরোধী নেত্রী।
সে দিনের বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা হতে দেননি, আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা-ই করে দেখালেন। সে দিনের মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গুর নিয়ে যে রফায় পৌঁছতে পারেননি, আজকের মুখ্যমন্ত্রী ভাঙড়ে সেই রফাসূত্র বার করে ফেললেন। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু নিজে আলোচনার টেবিলে এসেও মীমাংসাসূত্র অর্জন করতে পারেননি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা নেপথ্যে থেকেও ভাঙড়-চুক্তি রূপায়ণ করিয়ে দিলেন। ‘রাজ্যের স্বার্থ, উন্নয়নের স্বার্থ’ জাতীয় শব্দবন্ধ সিঙ্গুরেও ছিল। কিন্তু তার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা গেল ভাঙড়ে এসে!
ভাঙড়ে কী করেছে রাজ্য সরকার? সোজা কথায় বললে, ১২ কোটি টাকার প্যাকেজ। ঘোষণা করা হয়েছে, পাওয়ার গ্রিড নয়, সাব স্টেশন হবে। কোথা থেকে বিদ্যুতের তার টানার জন্য কোন টাওয়ার থাকবে, তারও কিছু রফাসূত্র হয়েছে। জমিহারাদের জন্য বর্ধিত ক্ষতিপূরণ, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির জন্য কর্মদক্ষতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণের কথা হয়েছে। আর আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে মামলা প্রত্যাহারে উদ্যোগী হবে প্রশাসন, এই আশ্বাসও রয়েছে। এমন সব নানা আশ্বাস সিঙ্গুরেও ছিল। তবু সেখানে ছোট গাড়ির কারখানার স্বপ্ন ছেড়ে পাততাড়ি গুটোতে হয়েছিল রতন টাটাকে। ভাঙড়ে পাওয়ার গ্রিডের বদলে সাব স্টেশনের বোর্ড লাগিয়ে বছর দুয়েক পরে আবার কাজ চালু হয়ে গেল।
আবির-রঙিন বিজয় মিছিল যখন ভাঙড়ের রাস্তায় ঘুরছে, কাজ শুরু হচ্ছে আবার, সেই ভিড়ের মধ্যে কিছু মুখকে অবশ্য দেখা যায়নি। তাঁরা প্রায় দু’বছর প্রশাসন এবং শাসক দলের চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছেন। এখন বলছেন, ‘‘আন্দোলনের নেতারা যদি সব মেনে নেন, আমাদের কী করার আছে?’’ সব নেতাই অবশ্য সব মেনে নেননি। ভাঙড় সংহতি কমিটি বিবৃতিই দিয়েছে, ‘‘ভাঙড়ের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হল। সরকারের সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক কেরিয়ারের লালসার কাছে জমি, জীবিকা, বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ কমিটি’র সর্বোচ্চ নেতৃত্ব আত্মসমর্পণ করে ভাঙড়ের গ্রামবাসীদের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করলেন।’’ মানবাধিকার সংগঠনগুলিরও প্রায় এক সুর। সিঙ্গুরে আলোচনা শুরু হয়েছিল আনুষ্ঠানিক মধ্যস্থতা ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ভাঙড়ে সরকার কোনও আনুষ্ঠানিক আহ্বান করেনি। আন্দোলনকারীদের একাংশের সঙ্গে ‘ট্র্যাক টু’ কথা চলতে চলতেই মীমাংসা-আলোচনা হয়ে গেল। বাকি আন্দোলনকারীদের দাবি, তাঁরা আলোচনা শুরুর কথা জানতেই পারেননি!
যাঁদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ, সেই অলীক চক্রবর্তী, শর্মিষ্ঠা চৌধুরীদের যুক্তি, আগে সরকার আলোচনার পথেই আসছিল না, আন্দোলনকারীদের ‘বহিরাগত’ চিহ্নিত করে দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছিল। কিন্তু এখন, আন্দোলনের ফলেই, সরকারের মনোভাব অনেক ইতিবাচক হয়েছে। প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্র অবশ্য বলছে, সরকার আন্দোলনের কাছে নতিস্বীকার করলে আরও আগেই তা হয়ে যেত। আর্থিক প্রলোভন এবং একই সঙ্গে প্রশাসনিক চাপ বাড়ানো— ‘গাজর ও লাঠির নীতি’ই এখানে কাজ হাসিল করেছে। এক দিকে বলা হয়েছে, রফার পথে এলে ইনাম মিলবে। আবার সেই পথে না গেলে আইন-প্রশাসনের ফাঁস আরও চেপে বসার খাঁড়া মাথার উপরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অন্য একটা চালও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ভাঙড়ে আন্দোলন শুরুর পর থেকেই গ্রামবাসীরা গুন্ডামির অভিযোগ করে এসেছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা, প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে। কয়েক মাস আগে সর্বশেষ প্রাণহানির ঘটনার পরে আরাবুলকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। জামিন হলেও তার পর থেকে ভাঙড়ে গোলমালের মানচিত্রে আর আরাবুল নেই। স্থানীয় মানুষের আস্থাবর্ধক এই পদক্ষেপের ভিত্তিতে দাঁড়িয়েই বাকি কাজটা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রশাসনকে। তার ফল? পঞ্চায়েত ভোটের ফল ঘোষণার দিনও সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদ থেকে যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘কিছু মাওবাদী হোয়াটসঅ্যাপে মনোনয়ন করে জিতে গিয়েছে’, তাদেরই কিছু লোক এখন ভাঙড়ের রাস্তায় আবির মেখে বিজয় মিছিল করছে।
সিঙ্গুর আর ভাঙড়ের আন্দোলনের কমিটিতে অভিন্ন মুখ ছিলেন পিডিএস নেতা সমীর পূততুণ্ড। তাঁর কথা: ‘‘সিঙ্গুরে প্রথম দিকে গ্রামে লাঠি চলেছে, জবরদস্তি হয়েছে। কিন্তু নন্দীগ্রামের ঘটনার পরে সিঙ্গুরে বামফ্রন্ট সরকার আর আলোচনার সময় জোরাজুরি করেনি। ভাঙড়ে চুক্তি করার জন্য পুলিশ দিয়ে চাপ দেওয়া হয়েছে। উপর থেকে যা বোঝা যায়নি, এমন অনেক কিছুও তলায় তলায় ঘটেছে।’’
যাঁর ব্যাখ্যা বা দৃষ্টিভঙ্গি যেমনই হোক, ভাঙড়-পর্ব থেকে আপাতত জোড়া বার্তা দিতে পেরেছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রথমত, বামফ্রন্ট সরকার যা পারেনি, তাঁর সরকার তা পারে। বোমা, গুলি, অবরোধের পরে শান্তির সমাধান পর্যন্ত পৌঁছনোর দক্ষতা তাঁর সরকারের আছে। তার জন্য যেমন ওষুধ প্রয়োগ প্রয়োজন বলে তাঁর মনে হয়, তিনি তা করবেন। আর দ্বিতীয়ত, স্পষ্ট করা গিয়েছে, বিরোধী রাজনীতিক হিসেবে মমতা ছিলেন ‘আপসহীন’। সিঙ্গুরে বহু জমির মালিক (তৎকালীন সরকারি হিসেবে ৮৭%) ক্ষতিপূরণের চেক নিয়ে নিলেও রাজনীতির স্বার্থে মমতা রফার চেক নেননি। আর এখন ভাঙড়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, আন্দোলনকারী নেতৃত্বের বড় অংশকে আপসে টেনে আনা যায়। তার পরিণামে আন্দোলনকারীদের মধ্যে এখন যে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস, তা-ও তো সরকারের লাভ!
সিঙ্গুর হোক বা নন্দীগ্রাম— পরে হাজির হয়েও আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল তৃণমূল। এখনকার বিরোধী সিপিএম নানা কৌশল ভেবে ভাঙড়ের আন্দোলনের নেপথ্যে থেকেছে। আন্দোলনের সামনের সারিকে সরকার নির্বিষ করে দেওয়ার পরে পিছনের সিপিএম এখন ন যযৌ, ন তস্থৌ!
বিরোধীদেরই এখন ভাবতে হবে, ভবিষ্যতের আন্দোলন তারা কোন রসায়নে গড়ে তুলবে। যে আন্দোলন শাসকের ফাঁদে পা দেবে না!