ফাইল চিত্র।
অপুষ্টির কারণ কেবল খাদ্যের অভাব নহে, জ্ঞানের অভাব। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা সেই সত্যটিই ফের সম্মুখে আনিল। মহারাষ্ট্র বা অন্ধ্রপ্রদেশে অনূর্ধ্ব দুই বৎসরের শিশুদের পুষ্টির পরিস্থিতি যে ওড়িশা বা ছত্তীসগঢ়ের তুলনায় মন্দ, তাহা ইঙ্গিত করে যে, পরিবারের আর্থিক অবস্থা বা খাদ্যের সুলভতা পুষ্টির একমাত্র নির্ণায়ক নহে। দেড়-দুই বৎসরের শিশুর পুষ্টির জন্য কতটুকু খাবারই বা প্রয়োজন? তাহার খাদ্য মিটাইবার আর্থিক সঙ্গতি নাই, এমন কত পরিবার থাকিতে পারে? অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বভারতীয় সমীক্ষায় প্রকাশ, অনূর্ধ্ব দুই বৎসরের শিশুদের মাত্র সাড়ে ছয় শতাংশ সম্পূর্ণ পুষ্টি পাইতেছে। ইতিপূর্বেও বিভিন্ন সমীক্ষা দেখাইয়াছে যে, মাতৃদুগ্ধের পর শিশুদের প্রয়োজনীয় খাদ্য জোগাইতে ব্যর্থ পরিবারগুলি। অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল এই ঘাটতির পূরণ, কিন্তু সেই প্রকল্পটির সর্বাঙ্গেই ঘাটতির চিহ্ন। তামিলনাড়ু ব্যতিরেকে অপর সকল রাজ্যে অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পটিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিষ্প্রাণ নিয়মরক্ষায় পরিণত হইয়াছে। দুই হাতা খিচুড়ি, এক মুঠা ছাতু বিতরণ করিয়া কেন্দ্রগুলি দায় সারিতেছে, পুষ্টিকর খাদ্যের প্রস্তুতির উপায়টি মায়েদের জানাইবার-বুঝাইবার কর্তব্যে ফাঁকি পড়িতেছে। ১৯৭৫ সাল হইতে অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প চলিতেছে, অথচ দেশের এক-তৃতীয়াংশ শিশু অপুষ্ট থাকিয়া গিয়াছে। খাদ্যশস্যে ভর্তুকির নীতি শিশুর অপুষ্টি ঘুচাইতে কতটা কার্যকর, সেই প্রশ্নটিও ফের উঠিবে। প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাদ্যে ঘাটতিই শিশুর অপুষ্টির প্রধান কারণ হইলে চাল-গমে ভর্তুকিতে লাভ কী?
জাতীয় স্তরে শিশু-কিশোরদের পুষ্টির পরিস্থিতি লইয়া এমন একটি সার্বিক সমীক্ষা এই প্রথম করা হইল। ইতিপূর্বে প্রধানত অনূর্ধ্ব পাঁচ বৎসরের শিশুদের পুষ্টির সমীক্ষা হইত। এই বার পাঁচ হইতে উনিশ বৎসর বয়সিরাও আসিয়াছে সমীক্ষার আওতায়, এবং প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহের সহিত রক্ত, মল-মূত্রের নমুনাও পরীক্ষা করা হইয়াছে। ফলাফল উদ্বেগজনক। এক দিকে, শিশু-অপুষ্টির সাবেক চিত্রটিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় নাই, এখনও পাঁচ বৎসর-অনূর্ধ্ব শিশুদের পঁয়ত্রিশ শতাংশ পুষ্টির ঘাটতির কারণে যথেষ্ট লম্বা হইতে পারে না। পাঁচ হইতে নয় বৎসর বয়সিদের মধ্যেও বাইশ শতাংশ খর্ব রহিয়া যায়। ইহার অর্থ, শিশুদের একটি বড় অংশ ধারাবাহিক ভাবে পুষ্টি হইতে বঞ্চিত হইতেছে। এমনকি অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে মিল প্রভৃতি প্রকল্পও তাহাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি জুগাইতে পারে না। অতএব পরিবার ঠিক সময়ে ঠিক পরিমাণ খাদ্য এবং যথেষ্ট পুষ্টিগুণযুক্ত খাদ্য শিশুকে বরাদ্দ করিতেছে কি না, না পারিলে কেন পারিতেছে না, সে প্রশ্নটিও করা প্রয়োজন।
অপর দিকে, সমীক্ষা দেখাইল এক নূতন তথ্য। জীবনযাপনের ত্রুটির কারণে রোগ-সম্ভাবনার সূচনা হইতেছে কৈশোরেই। স্কুলপড়ুয়া শিশু ও কিশোরদের দশ শতাংশ ‘প্রি-ডায়াবেটিক’, এই তথ্য উদ্বিগ্ন করিতে বাধ্য। সর্বাধিক সম্পন্ন পরিবারগুলির মধ্যে বারো শতাংশ শিশুর মধুমেহ হইবার ঝুঁকি অধিক, কারণ তাহাদের ওজন অধিক। শহরের কিশোরদের মধ্যে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল এবং উচ্চ রক্তচাপের যথেষ্ট নিদর্শনও মিলিয়াছে। অর্থাৎ দারিদ্র হইতে মুক্তি পাইলেও মুক্তি নাই অস্বাস্থ্য হইতে। সন্তানের বিপন্নতা না বুঝিয়া তাহার সম্পন্ন ভবিষ্যতের স্বপ্ন ধাওয়া করিতেছেন বাবা-মা। এখন সরকার কী করিবে, তাহাই প্রশ্ন।