অর্থনীতির দুনিয়া জানিত, খোলা বাজার বনাম আমদানি প্রতিস্থাপনের নীতির দ্বন্দ্বের নিরসন ১৯৬০’এর দশকেই হইয়া গিয়াছে, এবং আমদানি প্রতিস্থাপনের নীতিটি গোহারা হারিয়া অর্থনীতির ময়দান ছাড়িয়া পলাইয়াছে। পরবর্তী বেশ কয়েক দশক এই প্রসঙ্গে বিস্তর লেখালিখি, গবেষণা হইয়াছে— তাহার পর, কালের নিয়মেই সেই চর্চাতেও ভাটা পড়িয়াছে, কারণ ফয়সালাটি অনড় রকমের পাকা। অর্থনৈতিক তত্ত্ব এবং নীতিনির্ধারণের জগতে একটি স্বাভাবিক প্রথা আছে— কোনও তর্ক চুকিয়া গেলে, বিপরীতে কোনও অকাট্য প্রমাণ না পাওয়া অবধি কেহ আর সেই তর্কে প্রবেশ করেন না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্ভবত সেই প্রথায় বিশ্বাসী নহেন। তিনি চাকা পুনরাবিষ্কার করিবার ধনুর্ভঙ্গ পণ করিয়াছেন। ভারতকে আত্মনির্ভর করিবার প্রধান ধাপ হিসাবে তিনি অর্থব্যবস্থার দরজা-জানালা বন্ধ করিতে লাগিয়াছেন। দুর্জনে অবশ্য রব উঠাইয়াছে, ইহা কতিপয় মিত্রকে আরও সুবিধা করিয়া দিবার ফিকির, কিন্তু সেই সকল অভিযোগ মুলতুবি থাকুক। যাহা দৃশ্যমান, তাহা হইল, দেশের বর্তমান সরকার আমদানির ক্ষেত্রে একের পর এক বাধানিষেধ তৈরি করিতেছে, এবং আত্মনির্ভরতার বাণী রচিত হইতেছে। অথচ, অনেক অর্থনীতিজ্ঞই স্মরণ করাইয়া দিতেছেন যে, এই পথের শেষে সমৃদ্ধি নহে, অপেক্ষা করিয়া থাকে কালান্তক লালফিতা, প্রবল আমলাতন্ত্র-লাইসেন্স রাজ, এবং শ্লথ আর্থিক বৃদ্ধির ভয়াবহ বাস্তব।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বন্ধ করিয়া উন্নয়নের দুইটি মডেল বিংশ শতকের মধ্যভাগ দেখিয়াছে। প্রথমটি ভারতের মডেল; দ্বিতীয়টি পূর্ব এশিয়ার, যাহার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়াও আছে, আবার চিনও। দুইটি মডেলের মিল ছিল একটি জায়গায়— কেহই বিদেশি প্রযুক্তি, জ্ঞান বা যন্ত্রপাতিতে আপত্তি করে নাই। অমিল, ভারতের ক্ষেত্রে অর্থব্যবস্থার দরজা খুলিবার কোনও পরিকল্পিত রূপরেখা ছিল না; পূর্ব এশিয়ার ছিল। ফলটি ভারতীয় মডেলের পক্ষে অনুকূল হয় নাই— একদা ভারতের সহিত তুলনীয় দক্ষিণ কোরিয়া বহু দূরে আগাইয়া গিয়াছে, চিনের কথা উল্লেখ না করিলেও চলিবে। ইতিহাসের শিক্ষা হইল, উদার বাণিজ্য ভিন্ন অর্থব্যবস্থায় প্রাণসঞ্চার হয় না। তাহার প্রস্তুতি হিসাবে ক্ষেত্র বাছিয়া বিদেশি প্রতিযোগিতা হইতে ঢালের ব্যবস্থা করিতে পারে সরকার— কিন্তু, তাহার পূর্বশর্ত হইল ক্ষেত্রটি খুলিয়া দিবার নিশ্চয়তা, এবং বন্ধ থাকিবার সময় তাহার উন্নতিকল্পে সর্বশক্তি প্রয়োগ। আত্মনির্ভরতার হুঙ্কারে এই কাজ হইবে না। সুতরাং, প্রধানমন্ত্রী দরজা-জানালা আঁটিয়া দিবার ফলে ভারতীয় শিল্পক্ষেত্রে অকুশলতা আরও বাড়িবে, সেই আশঙ্কা প্রবল।
জওহরলাল নেহরু যখন আমদানি প্রতিস্থাপনের নীতির পথে হাঁটিয়াছিলেন, সেই সময়ের সঙ্গে বর্তমান সময়ের পার্থক্য এমনই দুস্তর যে, দুই জমানা কার্যত তুলনার অতীত— আন্তর্জাতিকতায় নিমজ্জিত নেহরুর সহিত নাগপুর-আত্মা মোদীরও যেমন তুলনা হয় না। সেই সময় এক দিকে সদ্য-স্বাধীন দেশের সম্মুখে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রত্যাবর্তনের মনস্তাত্ত্বিক সম্ভবনাটি প্রকট ছিল; অন্য দিকে, পাশ্চাত্যের কোনও দেশই ভারতকে অগ্রসর হইতে সাহায্য করিতে সম্মত হয় নাই— তাহাদের কাম্য ছিল ভারতের বাজার। তাহারই ফল সোভিয়েট-নির্ভরতা, ও মুক্ত বাণিজ্য বিমুখতা। তাহার পরও নেহরু কিন্তু প্রযুক্তি হস্তান্তর বা কারিগরি সাহায্য লইতে বিমুখ হন নাই। পরবর্তী কালে চিন যখন ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক জানালা খুলিতেছে, তাহারও পাখির চোখ ছিল প্রযুক্তি হস্তান্তর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দুয়ার আঁটিয়া দেশীয় উৎপাদকদের বাজার করিয়া দিতে চাহেন। মুক্ত বাজার যেখানে জানালার বাহিরেই দাঁড়াইয়া আছে, সেখানে এমন একটি ভুল ‘ঐতিহাসিক’ হইয়া থাকিবে।