বিপন্ন মহিষাসুর দশেরা

এ বিষয়ে কর্নাটকের রাজ্য উৎসব বা স্টেট ফেস্টিভ্যালের উল্লেখ প্রাসঙ্গিক। মাইসুরুর বিখ্যাত চামুণ্ডী হিলসের উপরে চামুণ্ডেশ্বরী মন্দিরকে কেন্দ্র করে মাইসুরু দশেরা নামের এই বার্ষিক উৎসব হয়।

Advertisement

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৯ ০০:২৬
Share:

বহুদর্শিত ‘বাহুবলী’ চলচ্চিত্রে ছিল মাহিষ্মতী নগর। চলচ্চিত্রের কাহিনিকারদের অন্যতম ছিলেন আনন্দ নীলকান্তন, যাঁর বহুপ্রশংসিত গ্রন্থ অসুর রাবণের দৃষ্টিকোণে রামায়ণের বিনির্মাণ করে দলিত প্রতিবাদের পৌরাণিক ভিত্তি দিতে পেরেছে সহজ ভাষায়। গবেষকদের একাংশের মতে, এই মাহিষ্মতী বোধ হয় দিক্‌নির্দেশ করে মহিষমণ্ডলা রাজ্যের দিকে, পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক মতে যে রাজ্যের রাজাই ছিলেন মহিষাসুর। মাইসোর বা মাইসুরু শহরের নামও মনে করা হয় এই মহিষাসুরের নাম থেকেই গৃহীত। কর্নাটকের স্থানীয় জনজাতি তাই তাঁদের প্রাচীন রাজা মহিষাসুরকে দেবতা জ্ঞানে আরাধনা করেন বহু দিন। স্থানীয় জনজাতির এ ধরনের অর্চনা বিরল নয়। মহারাষ্ট্রের গোন্দ জনজাতির রাবণদশেরা উদ্‌যাপনের কথা আমরা জানি, তাঁরা রাবণবধে শোকপালন করেন। তা হলে এ ক্ষেত্রে নতুন করে মহিষাসুরের পুজোর কথা উঠছে কেন?

Advertisement

এ বিষয়ে কর্নাটকের রাজ্য উৎসব বা স্টেট ফেস্টিভ্যালের উল্লেখ প্রাসঙ্গিক। মাইসুরুর বিখ্যাত চামুণ্ডী হিলসের উপরে চামুণ্ডেশ্বরী মন্দিরকে কেন্দ্র করে মাইসুরু দশেরা নামের এই বার্ষিক উৎসব হয়। দশ দিনব্যাপী উৎসবে অংশগ্রহণ করেন মাইসুরুর রাজপরিবারের সদস্যরা। হাতি ঘোড়া উটের বিশাল মিছিল প্রদক্ষিণ করে মাইসুরু শহরকে। চামুণ্ডেশ্বরী মন্দির থেকে দেবীমূর্তি বার করে শহর প্রদক্ষিণ করানো হয়। মাইসুরু দশেরা দেখতে আসেন দেশবিদেশের বহু মানুষ।

এই ‘মূলধারা’র উদ্‌যাপনে এক ভাবে ছন্দপতন হয় আজ থেকে পাঁচ বছর আগে, যদিও মননের প্রক্রিয়া শুরু হয় তারও বেশ কিছু দিন আগেই। স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, যুক্তিবিদ, ‌ইতিহাসবিদরা একত্রিত হন স্থানীয় জনজাতির মহিষাসুর বন্দনার তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রসঙ্গে। ‘অসুর’ শব্দটি দাক্ষিণাত্যের পৌরাণিক সাহিত্যে কোনও নঞর্থক অর্থে ব্যবহৃত হয় না। মহিষমণ্ডলা বা মহিষমতী রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায় সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে। তাতে জানা যায় যে শূদ্র অর্থাৎ আধুনিক ভাষায় দলিত ছিলেন মহিষাসুর। পরে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন এবং সম্রাট অশোকের কথায় নিয়োজিত হন বৌদ্ধধর্মের প্রচারে। মহিষাসুরের শাসনাধীন মহিষমণ্ডলায় বহু উন্নয়ন প্রকল্পের ঐতিহাসিক নথি খুঁজে পান গবেষকরা। ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায় সেই সময়ের আর এক ব্রাহ্মণ রানি চামুণ্ডারও। মহিষাসুরের উত্থানে শঙ্কিত হয়ে অন্য হিন্দু রাজারা রানি চামুণ্ডাকে অনুরোধ করেন মহিষাসুরকে হত্যা করতে। মহিষমণ্ডলা আক্রমণ করেন চামুণ্ডা, হত্যা করেন বৌদ্ধ শান্তিপ্রিয় রাজা মহিষাসুরকে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয় বহু পৌরাণিক কাহিনি, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহাসিক তথ্যের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয় ওঠে।

Advertisement

মহিষাসুরের এই ভিলেনায়ন অসংখ্য পৌরাণিক আর্য আগ্রাসনের চিহ্নের মধ্যে অন্যতম। অন্য দিকে, দেবী চামুণ্ডেশ্বরীর মিথায়নও আর্য ব্রাহ্মণ রানি চামুণ্ডার ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্র ধরে। রানি চামুণ্ডার গল্পই হয়ে ওঠে দেবী চামুণ্ডেশ্বরীর, তাঁর জন্য কর্নাটকে তৈরি হয় বহু মন্দিরও। সম্প্রতি (‘শারদা’ ক্রোড়পত্র, আবাপ, ২৭-৯) জহর সরকার লিখেছেন বাংলায় মহিষাসুর বধের আখ্যানের বিষয়ে। কেন ব্রিটিশ শাসকদের জমি আগ্রাসনের জন্য প্রয়োজন ছিল ঘাসজমি অঞ্চল থেকে বুনো মহিষ তাড়ানোর, কেন মহিষের মাথাওয়ালা অসুরকে বধ হতেই হবে মহিষাসুরমর্দিনীর হাতে। আজও মণ্ডপে আহত মহিষাসুরের পায়ের তলায় মৃত মহিষের মাথা সেই ইতিহাসকে মনে করায়।

যেমন মনে করায় মাইসুরুর চামুণ্ডী হিলসের বিশাল মহিষাসুর মূর্তি (যা আবার বেশ বিখ্যাত সেলফি পয়েন্ট) যার হাতে সাপ আর তরোয়াল। যে রাজ্যের জনজাতির কাছে আজও পূজনীয় মহিষাসুর, সেই রাজ্যেই নৃশংস রাক্ষসরূপে দেখা যায় মহিষাসুরকে। কর্নাটকের চিন্তাশীল মানুষ এই আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা জোগান। তাঁদের উদ্যোগে শুরু হয় মহিষাসুর দশেরা, চামুণ্ডা পাহাড়েই। জনজাতির ঐতিহ্য, স্থানীয় ইতিহাসকে আর্য তথা হিন্দি বলয়ের আগ্রাসন থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করেন যাঁরা, তাঁদের অন্যতম কে ভগবান। গৌরী লঙ্কেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকর্মী। গৌরীর মৃত্যুর পর সরকার তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে।

কিন্তু সঙ্কটে গৌরী লঙ্কেশ, কে ভগবানদের মহিষাসুর দশেরার প্রয়াস। মাইসুরুর বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিমহা ফরমান দিয়েছেন, এই উৎসব হিন্দুত্বের বিরোধী। আসলে বলতে চেয়েছেন হিন্দি বলয়ের বিরোধী, আর্য আগ্রাসনের বিরোধী। হিন্দুত্বের ধুয়ো তুলে আসলে এই বিরোধিতা বৈচিত্রের, অসাম্প্রদায়িক ইতিহাসের। মহিষাসুর দশেরাকে ঠিক পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেননি ওঁরা, বি আর অম্বেডকর পার্ক নামক ছোট একটি জায়গায় ঠেলে দিয়েছেন। জনজাতি/দলিত ধরনের ব্যাপার অম্বেডকর পার্কেই বেশি ভাল মানায় বোধ হয়।

এ বার তাই আরও এক বার আর্যাবর্তের জয় উদ্‌যাপিত হবে কর্নাটকে, যা পালিত হচ্ছে রোজ সারা ভারতে। কখনও হিন্দি ভাষা, কখনও সাহিত্য, কখনও চলচ্চিত্রের আড়ালে। গৌরী লঙ্কেশ, কে ভগবানরা তাও লড়ে যাবেন মৃত্যুর আগে-পরে। মহিষাসুর দশেরার জন্য। আর আমাদের একটু সম্মান, অসাম্প্রদায়িক, স্থানিক অবস্থানের জন্য।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement