বিপন্ন পরিবেশে গাঁধীকেই মনে পড়ে

গাঁধীর এই উন্নয়নের চিন্তাকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠতে পারে সমাজব্যবস্থার ভিন্ন এক চরিত্র। যাকে আমরা বলি ‘গণতন্ত্র’। গাঁধীর সার্ধশতজন্মবর্ষে লিখছেন অভ্র ঘোষ।গাঁধীজির পরিবেশ চিন্তার ক্ষেত্রে এই অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রিক ব্যবস্থার সম্পর্ক ওতপ্রোত। তিনি গ্রামকে রাখতে চান কেন্দ্রে, নগর বা নাগরিক অতিকায় শিল্পকে নয়।

Advertisement
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০৪
Share:

নোয়াখালির পথে অনুগামীদের সঙ্গে গাঁধী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ

পৃথিবীর ফুসফুস আমাজন যখন জ্বলছিল— তখন কেউ কেউ ভেবেছিল, এ বোধহয় দাবানলের আগুন। পরে জানা গেল, রেন ফরেস্টে ইচ্ছে করেই আগুন লাগানো হয়েছে। ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি বলসোনারো বলেছেন, কৃষিজমি সম্প্রসারণের কাজে এ এক মহান উদযোগ। মার্কিন রাষ্ট্রপতি মহামতি ট্রাম্পও বেশ উল্লসিত। কৃষিবিস্তারের পর শিল্পায়নও হবে। সভ্যতার ইতিহাস এই ছন্দেই চলে। অন্য দিকে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আতঙ্কিত, বিশ্ব উষ্ণায়নের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটে চলেছে। আর এক দশকের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমাতে না পারলে উষ্ণায়নের দাপট এমন এক স্তরে পৌঁছবে যে, মানবসভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়বে। অবশ্য তাতে কার কী! মানবজাতি বলতে তো বোঝায় আমাদের মতো ভীরু আমজনতা— মুনাফাখোর শিল্পপতি, মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেট, ক্ষমতা মদমত্ত রাষ্ট্রীয় কর্তারা কি এ সব ভাবেন? যারা চেরনোবিল ঘটায়, যারা পোখরানে আণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে— তারা কি মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আদৌ বিচলিত? এ সব প্রশ্ন মনগড়া নয়, ঠাট্টারও নয়। তা না হলে আমাজনের আগুন ব্যাখ্যা করব কী করে?

Advertisement

রোগটা অবশ্য আজকের নয়, তিনশো বছর ধরে ধাপে ধাপে তা বিস্তৃত হয়েছে। এখন তার অন্তিম লগ্ন। অষ্টাদশ শতকে যখন ইয়োরোপ-আমেরিকায় শিল্পায়নের বিস্তার ঘটছিল, তখন সভ্যতার নয়া-রূপ দেখে তৈরি হয়েছিল এক রোম্যান্টিক বিদ্রোহ— ওয়ার্ডসওয়ার্থ-শেলির মতো কবি অথবা রুশো-র মতো দার্শনিকদের কথা ইতিহাস হয়ে আছে। প্রকৃতি-হননের বিরুদ্ধে তাঁরা শঙ্কিত হয়েছিলেন, সোচ্চারও বটে।

কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয়নি। শিল্পায়ন-নগরায়ণ আর প্রকৃতির শক্তিগুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার আন্দোলন ও কথাবার্তাটুকুই চালানো হয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাদী সভ্যতার ধারাবাহিক ধর্ষণে প্রকৃতি বিধ্বস্ত হয়েছে ক্রমাগত। তার কোনও প্রতিকার ঘটেনি। ফলে তার চূড়ান্ত অবস্থা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।

Advertisement

এটাকে কেবল ইয়োরোপ-আমেরিকার সমস্যা নয়, তুলনায় উন্নতিবিহীন তৃতীয় বিশ্বেও উন্নয়নের জোয়ার আনার জন্য শিল্পায়নের পথ বেছে নেওয়া হয়েছিল। এটা অবিমৃশ্যকারিতা হবে বলে পরাধীন ভারতবর্ষে গাঁধী সাবধান-বাণী দিয়েছিলেন অবিরাম, কিন্তু কেউ সে সব কথা শোনেনি। বলা হত, গাঁধী বড্ড বেশি প্রাচীনপন্থী, নব্য-বৈদান্তিক, আধুনিকতা-বিরোধী। এমন মানুষের পাল্লায় পড়লে দেশ গোল্লায় যাবে। ভারতবর্ষ কি চিরকাল কৃষিজীবী হয়ে থাকবে? গাঁধী বিরোধীরা শুধু নন, গাঁধীর শিষ্যরাও সে কথা বলেছেন। গাঁধীর বিকল্প সভ্যতার ধারণা কেউই মানতে পারেননি। গ্রামপ্রধান, কৃষিপ্রধান ভারতীয় সভ্যতায় গাঁধী চেয়েছিলেন, আধুনিকতার প্রসার হোক অন্য ধারায়। দু’টি স্পষ্ট প্রস্তাব ছিল তাঁর। এক, কৃষিব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়ন এবং কারিগরি ও হস্তশিল্পের ব্যাপক পুনর্গঠন। দুই, দু’চারটি ভারী শিল্প ব্যতিরেকে বৃহৎ শিল্পায়নের দিকে না যাওয়া। অর্থাৎ, ধনতান্ত্রিক যন্ত্রসভ্যতার যুগে ‘শিল্পায়নের গ্র্যান্ড ডিজাইন’-এর বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। তবে এই বিকল্প অর্থনীতির জন্য চাই বিকল্প এক রাষ্ট্রব্যবস্থা। গাঁধীর স্পষ্ট মত ছিল, কেন্দ্রীভূত অপার ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্র নির্মাণ না করে সমাজনির্ভর বিকেন্দ্রিত রাষ্ট্র তৈরি করা উচিত। জয়প্রকাশ নারায়ণ যে-রাষ্ট্রের চরিত্র ব্যাখ্যা করে ‘কমিউনিটারিয়ান স্টেট’-এর বিশ্লেষণ করেছিলেন। তৃণমূল স্তরে পঞ্চায়েত ও স্বয়ম্ভর গ্রামসমাজ হবে বিকেন্দ্রিত রাষ্ট্রের ভিত— ব্লক-জেলা-রাজ্য-কেন্দ্র ধাপে ধাপে বিন্যস্ত হবে, তবে গ্রামসমাজের অর্থনীতি বিপন্ন না করে। গাঁধীর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব— গ্রাম-ব্লক-জেলা-রাজ্য-কেন্দ্র পরস্পর জৈবিক সম্পর্কে বাঁধা, তবে প্রত্যেকেই নিজ নিজ এলাকায় স্বাতন্ত্র ও স্বাধিকার বজায় রেখে চলবে। অন্যের উপর প্রভুত্ব করবে না। গাঁধীর এই চিন্তা খানিকটা ‘ওশানিক সার্কল’-এর মতো, গ্রাম যদি কেন্দ্রবিন্দু হয়, বাকি তরঙ্গবৃত্তগুলি সকলেরই স্বাধিকার বজায় থাকবে, অথচ সবার মধ্যেই এক জৈবিক যোগসূত্রও বিদ্যমান থাকবে।

গাঁধীর বিকল্প চিন্তাকে বরণ করে নিয়েছিলেন গ্রামীন ভারত।

গাঁধীজির পরিবেশ চিন্তার ক্ষেত্রে এই অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রিক ব্যবস্থার সম্পর্ক ওতপ্রোত। তিনি গ্রামকে রাখতে চান কেন্দ্রে, নগর বা নাগরিক অতিকায় শিল্পকে নয়। এই দর্শনের পিছনে ভারতবর্ষের মতো বিশাল দেশের বিপুল জনসংখ্যার শ্রমসম্পদ ব্যবহারের নৈতিকতাও কাজ করে। তাঁর ধারণা, কেন্দ্রীভূত বৃহদায়তন শিল্পের সংগঠন সে কাজ করতে পারবে না, বিকেন্দ্রিত ছোট ছোট শিল্প ও কৃষিকর্মের বিস্তার সব মানুষের কাজের সংস্থান করতে পারবে। ‘হরিজন’ পত্রিকায় (১৬ মে ১৯৩৬) গাঁধী লিখেছিলেন, ‘একটি কারখানা একশোজনকে কাজ দেয়, হাজার হাজার জনকে বেকার করে। তেলকলে আমি টন টন তেল উৎপাদন করতে পারি। কিন্তু আমি হাজার হাজার কলুকে বেকারও করে দিই। একে আমি বলি, বিনাশক শক্তি। আর লক্ষ কোটি হাতের শ্রমে উৎপাদন হল গঠনমূলক শক্তি ও জনসাধারণের কল্যাণসাধক। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় হলেও বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রের গণ-উৎপাদনে কোনও কাজ হবে না।’

গাঁধীর চিন্তা, আদর্শকে ক্ষয় করতে পারেননি সময়।

শোষণহীনতা, অপরিগ্রহ, শ্রমসম্পদের সর্বতোরূপে সামাজিক ব্যবহার— এই তিন নৈতিকতাকে যদি গাঁধীর উন্নয়নচিন্তার শর্ত বলে মনে করি তা হলে তাকে অবশ্যই বিকল্প উন্নয়নের চিন্তা বলা যেতে পারে। আর এই উন্নয়নের চিন্তাকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠতে পারে সমাজব্যবস্থার ভিন্ন আর এক চরিত্র। যাকে আমরা বলি ‘গণতন্ত্র’।

গাঁধীর বিশ্লেষণে রাষ্ট্র সংগঠিত হিংসার প্রকাশ। কারণ, আধুনিক রাষ্ট্র কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার সংগঠন। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার সঙ্গে আধুনিক শিল্পায়নের ধারার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। যন্ত্র-শিল্প-প্রযুক্তির যত বিস্তার ঘটবে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের শক্তিও তত বৃদ্ধি পাবে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বাধীনতা সেই হারেই কমতে থাকবে। ভারতের প্রাচীন কৌম জীবনও ধস্ত হবে।

আরও পড়ুন: দু’মাসে ১৪৪ খুদে আটক কাশ্মীরে! সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিটির রিপোর্টে উদ্বেগ

আজকের বিশ্বায়নের যুগে, দ্রুতগতিসম্পন্ন প্রযুক্তি ও বৈপ্লবিক গণমাধ্যমের যুগে গাঁধী দর্শনের কথা বলতে ভয় হয়। তবে মানুন আর না মানুন, তারিফ করতেই হবে গাঁধীজির সাহসকে। বিশ শতকের প্রযুক্তিভিত্তিক সভ্যতার মুখের উপর ছুড়ে দিতে পারেন যিনি এই কথাগুলি: ‘যন্ত্র এমন এক সাপের গর্ত, যে বিবরে এক থেকে একশোটা সাপও থাকতে পারে। যেখানে যন্ত্র সেখানেই বড় বড় শহর। যেখানে বড় শহর, সেখানেই ট্রাম ও রেলপথ। একমাত্র সেখানেই দেখা যায় বিজলি বাতি। সৎ চিকিৎসকেরা বলবেন, যেখানে কৃত্রিম গতির সাহায্যে গমনাগমন বাড়ে, সেখানেই মানুষের স্বাস্থ্য খারাপ হয়। আমার মনে পড়ছে, এক ইয়োরোপীয় শহরে এক বার মুদ্রাসঙ্কট দেখা দেয়। তখন ট্রাম কোম্পানি, আইনজীবী ও চিকিৎসকদের আয় কমে গিয়েছিল, মানুষের অসুস্থতাও হ্রাস পেয়েছিল। যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত, অথচ প্রশংসনীয়, এমন একটি ব্যাপারও আমার মনে পড়ে না।’ (হিন্দ স্বরাজ, ১৯০৯)।

আরও পড়ুন:মহাত্মা গাঁধীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে শুরু হচ্ছে প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে অভিযান

এই কথাগুলি পড়ে পাঠকের নিশ্চয়ই মনে পড়বে গাঁধীর নেচারোপ্যাথির কথা। অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেতে চাইতেন না তিনি। প্রাকৃতিক ভেষজ ওষুধ ব্যবহারই ছিল তাঁর পছন্দ। কিন্তু সে সব দিন গেছে। শিল্প-প্রযুক্তিভিত্তিক সভ্যতা যত বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের রোগের জটিলতা ও মারণব্যাধির ধরনও তত পাল্টাচ্ছে। আর একইসঙ্গে প্রকৃতিকে যত ধ্বংস করছি আমরা, প্রকৃতিও তার যথোপযুক্ত সংহার-শক্তির অমিতবিক্রম প্রকাশ করছে। মানুষ পালাবার পথ আর খুঁজে পাচ্ছে না। পাবেও না!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement