সালটা ১৯৩৩। বিশ্বভারতীতে টাকার টানাটানি চরমে। রবীন্দ্রনাথ অর্থের জন্য লোকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন। আমন্ত্রণ ছিল বোম্বে, সিংহল থেকে। বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কবি ছ’মাসের ব্যবধানে উভয় স্থানেই পৌঁছে গেলেন। মনে আশা যে, ভাল সাড়া পাওয়া যাবে। তবে সে আশা আশা হয়েই রয়ে যায়। বিশেষ কোনও সাড়া মেলে না। রবীন্দ্রনাথের কাতর আহ্বান সেখানকার জনগণের মন গলাতে পারেনি। ছ’মাস পরে (মে, ১৯৩৪) কবি সিংহল গেলেন, সেখানেও একই অভিজ্ঞতা। ‘ইন্ডিয়ান মার্কেন্টাইল চেম্বার অফ সিলোন’ আয়োজিত এক অভ্যর্থনা সভায় বিশ্বভারতীর জন্য আর্থিক সাহায্য প্রার্থনা করলেন। তাঁর বিনীত আহ্বানও সে দিন ৭০০ টাকার বেশি অনুদান জোটাতে পারেনি। ব্যর্থ মনোরথে কবি ওই দিন সিংহলবাসীদের সামনে যা বলেছিলেন, তা যেন আকুল হৃদয়ের অবগুণ্ঠিত ক্রন্দন—
‘‘আমি জানি যখন আমি থাকবো না তখন আপনারা আজকের এই সন্ধ্যার কথা মনে করবেন এবং সম্ভবত মৃত্যুবরণের মাধ্যমেই আমি দেশবাসীর চূড়ান্ত সেবা করতে পারি। কারণ আপনারা জানেন মৃত্যুই সেই পরিপ্রেক্ষিত রচনা করে যার দ্বারা ব্যক্তিত্বের সত্যতা উপলব্ধ হয়। এবং আপনারা সম্ভবত আমাকে স্মরণ করবেন এই ভেবে যে একদিন সন্ধ্যায় আমি আপনাদের দ্বারে এসেছিলাম সাহায্য ও সহানুভূতির ভিক্ষা প্রার্থনা করে এবং আপনারা আপনাদের সর্বোচ্চ সাহায্য করে উঠতে পারেননি বলে সম্ভবত তখন আপনাদের অনুশোচনা হবে।”
এই সঙ্কট আরও কিছুদিন চলল। রবীন্দ্রনাথ যখন আর কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না, তখন এক দিন অ্যান্ড্রুজ তাঁকে গাঁধীজির কাছে বিষয়টি জানানোর কথা বললেন। কবি প্রথমে ইতস্তত করছিলেন। পরে এক প্রকার নিরুপায় হয়েই সব কিছু জানিয়ে গাঁধীজিকে চিঠি লিখতে বসলেন। আশা, যদি মহাত্মার কথায় দেশবাসী বুঝতে পারে যে, বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখাটা তাদেরও কর্তব্য। অনিল চন্দের উপর দায়িত্ব পড়ল সে চিঠি মহাত্মার কাছে পৌঁছে দেওয়ার। মহাত্মা সে সময়ে ‘অখিল ভারত গ্রামোদ্যোগ সঙ্ঘ’ ও ‘হরিজন সেবক সঙ্ঘ’-এর সাংগঠনিক কাজে ভীষণ ব্যস্ত। তাঁর সঙ্গে দেখা করাই মুশকিল। নিজে হাতে পত্রখানা গাঁধীজিকে দেবেন বলে অনিল চন্দ সময় নিলেন।
অবশেষে গাঁধীজির হাতে যখন চিঠিখানা পড়ল, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আর সময় নষ্ট না করে মহাত্মা কবিকে জানালেন যে, তিনি টাকা সংগ্রহের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। তাঁর উপর কবি যেন ভরসা রাখেন। এই বয়সে এসে যে কবিকে ভিক্ষা অভিযানে বেরোতে হবে, তা তিনি ভাবতেও পারেন না। যে করেই হোক প্রয়োজনীয় অর্থ তিনি কবির হাতে তিনি তুলে দেবেনই। এটা অক্টোবরের ঘটনা। কিন্তু মাস যেতে না যেতেই গাঁধীজি হঠাৎ শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। মাস দুয়েক পরে সুস্থ হয়ে উঠলেও দেশের কাজে এত ব্যস্ত হয়ে গেলেন যে, বিশ্বভারতীর জন্য কিছু করে ওঠার আর অবকাশ পেলেন না।
ও দিকে রবীন্দ্রনাথও বিচলিত হয়ে উঠেছেন। তাঁর অর্থের প্রয়োজন। ভীষণই প্রয়োজন। আশ্রমকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। অনন্যোপায় কবি আবার বের হলেন তাঁর শিল্পী-কলাকুশলীদের নিয়ে (মার্চ, ১৯৩৬)। এ বারের গন্তব্য উত্তর ও পশ্চিম ভারত। কলকাতা, পটনা, এলাহবাদ, দিল্লি হয়ে গেলেন লাহোর পর্যন্ত। সর্বত্র ‘চিত্রাঙ্গদা’ পরিবেশিত হল। লাহোরে পরপর দু’দিন। প্রভূত প্রশংসা কুড়োলেন। ২৫ মার্চ পৌঁছলেন দিল্লি। উঠলেন রঘুবীর সিংহের গৃহে। গাঁধীজিও সেই সময়ে দিল্লিতে। ওই দিন সন্ধ্যায় কস্তুরীবাঈকে সঙ্গে নিয়ে রঘুবীর সিংহের বাড়ি গিয়ে দেখা করলেন কবির সঙ্গে। বিশ্বভারতীর অর্থসঙ্কটের কথা তাঁকে খুলে বললেন রবীন্দ্রনাথ। গাঁধীজিও আশ্বাস দিলেন, যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন তিনি। তবে অনুরোধ রাখলেন যে, প্রয়োজনীয় টাকাটা যদি তিনি এক বার জোগাড় করে দিতে পারেন, তবে কবি যেন নাট্যাভিনয় বন্ধ রেখে শান্তিনিকেতনে ফিরে যান। এর পরেও ২৬ ও ২৭ মার্চ দিল্লির রিগাল থিয়েটারে পরপর দু’দিন চিত্রাঙ্গদা অভিনীত হল। ২৭ মার্চ গাঁধীজি একটা চেক পাঠালেন কবিকে। ষাট হাজার টাকার। সঙ্গে ছোট্ট একটি চিঠি। তাতে অবশিষ্ট অনুষ্ঠানসূচি বাতিলের অনুরোধ— ‘‘এখন আপনি অবশিষ্ট অনুষ্ঠানসূচি বাতিল করে দিয়ে জনসাধারণের মনের উদ্বেগ দূর করুন।’’ সেই সঙ্গে যাঁরা টাকাটা দিয়েছিলেন, কবিকে লেখা তাঁদের একখানি পত্রও পাঠিয়েছিলেন। কিছু কিছু অনুষ্ঠান পূর্বেই নির্ধারিত হয়ে ছিল। সেগুলি পাশ কাটাবার উপায় ছিল না।
২৯ মার্চ মীরাটে ‘চিত্রাঙ্গদা’ অভিনীত হওয়ার কথা। কথা রাখলেন কবি। মীরাট থেকে ফিরে পরের দিনই (৩০/৩/৩৬) এক প্রেস বিবৃতিতে অজ্ঞাতনামা এই বন্ধুদের দানের কথা স্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কৃতজ্ঞতা জানালেন। ৩১ মার্চ সদলবলে ফিরে এলেন শান্তিনিকেতনে। ৬ এপ্রিল অমিয় চক্রবর্তীকে এক চিঠিতে কবি যা লিখলেন, তা কৃতজ্ঞ মানুষের মনের কথা: “বিশ্বভারতীর অর্থাভাব দূর করবার জন্য দুর্ব্বল জীর্ণ শরীরকে ক্লান্তির চরম সীমায় নিয়ে চলেছিলুম। শ্রদ্ধাবিহীনের দ্বারে ব্যর্থ ভিক্ষাপাত্র বহনের দুঃখ ও অসম্মান প্রত্যহ অসহ্য হয়ে উঠেছিল। প্রতিদিন উপলব্ধি করেছি আমার দেশে আমার যথার্থ স্থান নেই, আমি একান্তই বিদেশী। এমন সময়ে অকস্মাৎ এই অপ্রত্যাশিত অনুকম্পা আমাকে বিস্মিত করেছে। এই দান ব্যক্তিগত, এ আমার দেশের দান নয়–এমন কেউ দিয়েছেন যিনি আমার সমানধর্ম্মা।” যথার্থই বুঝেছিলেন তিনি। আসলে টাকাটা দিয়েছিলেন ঘনশ্যামদাস বিড়লা। তাঁর ‘ইন দি শ্যাডো অফ মহাত্মা’য় তার স্বীকৃতিও রয়েছে।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আশ্রমের অর্থ সঙ্কট আবার তীব্র হল। ১৯৩৭ সাল। সারা বাংলা উত্তাল বন্দেমাতরম সঙ্গীত আর বন্দী-মুক্তি নিয়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরমকে জাতীয়সঙ্গীত করা হবে কিনা তা নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের বিতর্ক যখন তুঙ্গে, তখন আন্দামানের জেলে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি ঘিরে সরকার ও জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে দড়ি টানাটানি চলছে। গাঁধীজি স্বয়ং উদ্যোগী হয়েছেন এ ব্যপারে। কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে এ সব বিষয়ে একটা হেস্তনেস্ত করার জন্য এলেন কলকাতায়। উঠলেন শরৎ বসুর এলগিন রোডের বাড়িতে। দুপুরে সেখানেই ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক সেরে তিনি সোজা গিয়ে হাজির হলেন বেলঘরিয়ায়, কবির কাছে। রবীন্দ্রনাথ তখন বেশ কিছুদিন যাবৎ অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য এসে রয়েছেন বেলঘরিয়ার বাগান বাড়িতে প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশের কাছে। অনেকদিন পরে মুখোমুখি বসলেন মহাত্মা ও বিশ্বকবি। বন্দি-মুক্তি, বন্দেমাতরম, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা কিছুই বাদ গেল না তাঁদের আলোচনায়। কবিও জানালেন, বিশ্বভারতীর কথা। তাঁর আর্থিক দৈন্যের কথা। সব শুনে গাঁধীজি আশ্বাস দিলেন, কিছু একটা করার চেষ্টা করবেন তিনি।
সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই মহাদেব দেশাইয়ের কাছ থেকে একটি চিঠি এল রবীন্দ্রনাথের কাছে। সঙ্গে লেজুড় তেরো হাজার টাকার একখানি চেক। সৌজন্যে বিড়লা পরিবার। শত কাজের মাঝেও শান্তিনিকেতন যে গাঁধীজির মন থেকে মুছে যায়নি, এ দান তারই প্রতিফলন। কৃতজ্ঞ কবি মহাত্মাকে চিঠিতে লিখলেন, ‘...আমার এই যাত্রা পথের অন্তিম মুহূর্তে সহসা যখন আমার পরে প্রশ্নাতীত সহনুভূতির সঙ্গে অপরিমিত দাক্ষিণ্য বর্ষিত হল, তখন আমার শুষ্ক তাপিত হৃদয় আনন্দে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়েছে। আমার আর কিছুই বলার নেই। ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।’
জবাবে গাঁধীজি সবিনয়ে বলেছিলেন, এ ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা নেই। যা করার ঈশ্বরই করেছেন। এটা তাঁরই দান। সঙ্গে কবির কাছে ছোট্ট অনুরোধ রাখলেন রাখলেন, ‘বিশ্রাম করুন’।