প্রকৃতির গায়ে তখনও শীতের চাদর। ফেব্রুয়ারি মাস। কবির সঙ্গে দেখা করবেন বলে গাঁধীজি এলেন বোলপুরে। সঙ্গে কস্তুরীবাঈ, মহাদেব দেশাই আর পেয়ারেলাল। পথ-মধ্যে কলকাতায় দু-দণ্ড সময় কাটালেন তাঁর প্রিয় চার্লির সঙ্গে। সি এফ অ্যান্ড্রুজ তখন অসুস্থ। ভর্তি রয়েছেন প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে। ভোরের আলো গায়ে মেখে নাগপুর ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার গাঁধীজিকে নিয়ে যখন হাওড়া স্টেশনে ঢুকল, সেখানে তখন হাজির প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, বি এম বিড়লা, কবির প্রতিনিধি অমিয় চক্রবর্তী ও আরও অনেকে। সাধারণের ভিড় এড়ানোর জন্য এ বার অবশ্য তাঁর আসার খবর খুব গোপন রাখা হয়েছিল। ট্রেন থেকে নেমে পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের পরে গাঁধীজি অমিয় চক্রবর্তী ও কৃপালনীকে নিয়ে সোজা পৌঁছলেন প্রেসিডেন্সি হাসপাতালে। সেখানে শয্যাশায়ী অ্যান্ড্রুজ। মিনিট পনেরো কাটিয়ে গাঁধীজি গেলেন বিড়লা হাউসে। সেখানে হালকা খাবার খেয়ে আবার রওনা দিলেন স্টেশনের উদ্দেশে।
স্টেশনে যখন তাঁরা পৌঁছলেন চারিদিক তখন লোকে-লোকারণ্য। তাঁর গাড়ি দেখামাত্র আওয়াজ উঠল—‘বন্দেমাতরম্’, ‘মহাত্মা গাঁধী কি জয়’। উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্যে তিনি গিয়ে উঠলেন সাহেবগঞ্জের লুপ ট্রেনের কামরায়। বরাবরের মতো এ বারেও তাঁর ইচ্ছেমতো ব্যবস্থা হয়েছে থার্ডক্লাসে। গোটা একটা কামরা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর জন্য। কস্তুরীবাঈ, প্যারেলাল, মহাদেব দেশাই ছাড়াও সঙ্গে রয়েছেন কবির প্রতিনিধি অমিয় চক্রবর্তী। ভারতে বক্তৃতার আমন্ত্রণ পেয়ে সে সময় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক হ্যারল্ড হোটেলিং এসেছেন ভারত-ভ্রমণে। তিনিও সস্ত্রীক চলেছেন শান্তিনিকেতন। কবির সঙ্গে দেখা করতে। তাঁরাও একই ট্রেনে গাঁধীজির সহযাত্রী হয়েছেন। গাড়িতে উঠে মহাত্মা খুঁজে নিলেন জানলার ধারের আসন। স্মিত হাস্যে উপস্থিত জনতার অভিবাদন স্বীকৃতির বার্তা যেন পৌঁছে দিলেন জনে জনে। জানলার বাইরে হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করলেন হরিজন ফান্ডের জন্য জনতার দান। দেখতে দেখতে ট্রেন ছেড়ে দিল। চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠলো গাঁধী নামের জয়ধ্বনিতে।
শান্তিনিকেতনের এত বিপুল কর্মযজ্ঞ, কী করে তার খরচ চলছিল? রবীন্দ্রনাথ কী করে এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতেন? আর তা করার জন্য তাঁকে কী পরিশ্রমই না করতে হয়েছিল! তার খবর ক’জনই বা রাখে? সহধর্মিণী মৃণালিনী দেবীর গয়না বিক্রির টাকায় গড়ে তোলা ব্রহ্মচর্যাশ্রম পরবর্তী কালে ডালপালা মেলে বৃহৎ হলে আর্থিক দায়ের পরিমাণও বৃহত্তর হয়। সে দায় মেটাতে বিয়েতে যৌতুক পাওয়া সোনার ঘড়ি, গলার হার বেচে দিয়েছেন কবি। সমুদ্রের ধারে বসবাসের লোভে পুরীতে সাধের বাড়ি করেছিলেন। তাও বিক্রি করতে হয়েছিল। (‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’)। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে রবীন্দ্রনাথ এর জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন। চারিদিকে ঈর্ষাপরায়ণ ও বিরুদ্ধ প্রতিবেশের মাঝে সহকারী বন্ধু হিসেবে থেকে কেউ হাতও বাড়িয়ে দেয়নি। মাঝেমধ্যে অর্থ সমস্যার সুরাহা হলেও পুনরায় তা মাথা চাড়া দিয়েছে। শেষ বয়স পর্যন্ত কবি সে জন্য চিন্তিত ছিলেন। হয়তো সেই চিন্তা থেকেই তিনি মহাত্মার সঙ্গে শেষ বারের জন্য দেখা করতে চেয়েছিলেন। আমন্ত্রণ করে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের আশ্রমে।
‘‘কাগজপত্র থেকে জানলাম আপনি বাংলায় আসছেন। আশা করি আমার সাথে শান্তিনিকেতনে ক’টা দিন কাটাবেন।’’ ২০ জানুয়ারির (১৯৪০) কবির এই টেলিগ্রামের জবাবে পাল্টা-টেলিগ্রামে গাঁধীজি জানিয়েছিলেন “ষোলো বা সতেরোতে শান্তিনিকেতনে পৌঁছবার ব্যবস্থা করছি। তিন দিন বা নিদেনপক্ষে দু’দিন থাকব।” আর সে কথা রাখতেই এ বার তাঁর কবির ডেরায় আসা (১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪০)।
বর্ধমান ছুঁয়ে ট্রেন যখন বোলপুর স্টেশনে ঢুকল, তখন সেখানে হাজার মানুষের ভিড়। সবাই তাঁদের প্রিয় নায়ককে এক বার দেখতে চান। কবির শরীর ভাল নেই। তিনি আসতে পারেননি। গাঁধীজিকে নিতে এসেছেন রথীন্দ্রনাথ। তিনি তখন আশ্রমের কর্মসচিব। সঙ্গে বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষ ক্ষিতিমোহন সেন, শিক্ষাভবনের অধ্যক্ষ অনিলকুমার চন্দ, শ্রীনিকেতনের সচিব সুকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রীভবনের জয়ন্তী দেবী, কলাভবনের নন্দিতা দেবী, নির্মলানন্দ ঘোষ ও অন্য ছাত্রেরা।
শুষ্ক মাটির রুক্ষদেশ বীরভূমে অনেকদিন পরে আবার এলেন মহাত্মা। সে দিন তাই শান্তিনিকেতন যাওয়ার পথ সেজেছিল নতুন সাজে। জাতীয় পতাকায় মোড়া তোরণ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছিল জাতির জনককে। রাস্তার দু’ধার দিয়ে টাঙানো হয়েছিল পতাকা। লোকে অধীর আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল সড়কের দু’পাশে। তারই মাঝে ছুটে চলল গাঁধীজির গাড়ি। উত্তরায়ণে প্রবেশপথের মুখে যখন তা থামল দু’ধারে তখন সার দিয়ে দাঁড়িয়ে শ্রীভবনের মেয়েরা আর সেই সঙ্গে ক্ষিতিমোহন সেন, গুরদয়াল মালিক ও আরও অনেকে। মাদাম ক্রিস্টিন বসনেকের নেতৃত্বে তাঁরাই গাঁধীজি ও তাঁর অনুগামীদের সাদরে বরণ করে নিয়ে গেলেন শ্যামলীতে। শ্যামলী কবির প্রিয় মাটির বাড়ি। মাটির ছাদ-সহ এ বাড়ি পরীক্ষামূলক ভাবে তৈরি হয়েছিল ১৯৩৪ সালে। নন্দলালের পরিচালনায় কলাভবনের একদল ছাত্র তার গায়ে ফুটিয়ে তুলেছিল রিলিফ ভাস্কর্য। এ বারে গাঁধীজির থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সেখানেই।
অভ্যর্থনা পর্ব সমাধা হলে গাঁধীজি গেলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। ১৯৩৬ সাল থেকে কবি তাঁর পুনশ্চ বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। সম্ভবত এখানেই উভয়ের সাক্ষাৎ হল। আবেগঘন সে মুহূর্তে কুশল বিনিময়ের পরেই কবি অ্যান্ড্রুজের খোঁজ নিলেন। মহাত্মা বললেন, ‘‘আমি যখন তার সামনে গেলাম, সে আমাকে চিনতে পারল না। শীঘ্রই আর একটা অপারেশন হবে।’’ কথাবার্তার ফাঁকে গাঁধীজি বললেন, ‘‘আমার পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন।’’
তাতে সায় দিলেন কবিও। বললেন, ‘‘সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিন। রাজনীতিতে ফিরে আর কাজ নেই।’’ ‘‘তা হলে তখন তো আমার আর কোনও প্রয়োজনই থাকবে না।’’ সহাস্যে জবাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন গাঁধীজি। ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’-এর সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সে সময়ে বোলপুরে। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, ‘‘গাঁধীজির বয়স ৭০-এর উপর। কিন্তু দেখিলাম, তিনি চলাফেরা করেন দ্রুত, কাজ করেন দ্রুত। কাজ করেনও অনেক— এই শক্তি কোথা হইতে আসে! তিনি মিতাহারী, সংযমী, দৈহিক ও মানসিক অপচয় ও ক্ষয় যাহাতে না হয় তাহার সর্বাবিধ উপায় তিনি অবলম্বন করিয়া থাকেন। ভগবানে বিশ্বাস তাঁহাকে চিত্ত ক্ষোভ ও অবসাদ হইতে রক্ষা করে। তিনি আগেরকার মতই পরিহাস রসিক আছেন।’’ (প্রবাসী, চৈত্র, ১৩৪৬, পৃ. ৮৩২, ‘শান্তিনিকেতনে গান্ধিজি’)
জীবনের উপান্তে এসে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। আশ্রম নিয়ে তাঁর দুর্ভাবনার কথাটা পাড়লেন অতিথির সামনে। তাঁর অবর্তমানে কী হবে বিশ্বভারতীর, সেই চিন্তাই যেন ক্রমশ তাঁকে কাবু করে ফেলছিল। আশ্রমের এত বিপুল কর্মযজ্ঞের ব্যয়ভার তো ছিলই, সেই সঙ্গে পরিচালন ব্যবস্থার সুষ্ঠু সম্পাদনের দিকটাও ফেলে দেওয়ার নয়। এর আগে গাঁধীজি বারবার আশ্রমের অর্থসঙ্কট মোচনে কবির পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সে কথা মনে রেখে কবিও বোধহয় তাঁর চিন্তার কথা মহাত্মাকে জানাতে দ্বিধা করলেন না।