রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধী, এই দু’জনকে নিয়ে আমাদের চিন্তার শেষ নেই। অথচ তাঁদের কাউকেই আমরা যথাযথ ভাবে গ্রহণ করতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথকে তো যত্রতত্র ব্যবহারযোগ্য করে তুলেছি। তাঁর সাধের শান্তিনিকেতন নিয়ে কত কিছু হচ্ছে। আইন-আদালতের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। কিন্তু এই দু’জনকে নিয়ে একটি দিক আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। সেটি হল, বিরুদ্ধ ভাবনাকে তাঁরা কী ভাবে দেখেছেন বা তার সঙ্গে কত দূর অবধি পথ হেঁটেছেন?
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিষ্ঠিত আশ্রমে কখনওই কোনও রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ পছন্দ করতেন না। সেটা ছিল সক্রিয় রাজনীতি। স্বদেশি রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা চর্চা তো ছিলই একদম প্রাথমিক পর্বে। তার সীমাবদ্ধতার কথা ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন। কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট রচনাগুলির কথা আমরা বলতে পারি। স্বদেশি রাজনীতির জন্য শান্তিনিকেতনে পুলিশের উৎপাত হোক, এটা কবি কখনওই চাইতেন না। কিন্তু কে যাননি সেখানে? জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু তো যেতেনই, স্বয়ং গাঁধীজিও যেতেন। সেটা অবশ্যই স্বাধীনতা-পূর্ব যুগ। রবীন্দ্রনাথের কোনও আপত্তি ছিল না সে-সবে। এই রাজনীতিকদের সঙ্গে সর্বদা রবীন্দ্রনাথের মতের মিল হত এমনটা নয়। বিহারের ভূমিকম্পের পর গাঁধীজির মন্তব্য রবীন্দ্রনাথ নস্যাৎ করেছিলেন। তাঁর সেই তীব্র প্রতিবাদপত্রটি গাঁধী স্বয়ং প্রকাশ করেছিলেন তাঁর সম্পাদিত হরিজন পত্রিকায়। নিজের বক্তব্যে অটল থেকেই। উভয়ের মধ্যে ছিল অনাবিল প্রীতির সম্পর্ক। সুভাষচন্দ্র একবার সেখানে গিয়ে ছাত্রদের সামনে বক্তৃতায় বলেছিলেন, “আজ থেকে একশো বছর বাদে কলকাতা থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরে শান্তিনিকেতন রইল কি গেল সেটা বড় ব্যাপার নয়, গুরুদেবের শিক্ষাদর্শ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়াটা আসল।” অনুষ্ঠানে উপস্থিত সে দিনের এক ছাত্রের কাছেই আমার শোনা।
রবীন্দ্রনাথ সেই বক্তব্যে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন কি না জানা নেই। তবে প্রতিবাদ করেননি। আজ চতুর্দিকে শুনছি একটি ‘গেল, গেল’ রব। চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। বিরুদ্ধ মতকে সঙ্গে নিয়ে, অপছন্দের কথাকে শুনেই চলার চেষ্টা করতে হবে। তবে, সেটা একটি মতামত হিসেবে উঠে এলেই। নিছক সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।
শান্তিনিকেতনে আজ রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে অভিযোগ। দু’টি পক্ষের বাদানুবাদ, প্রায় হাতাহাতিও হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিতর্ক? তার স্থান কোথায়? ডানপন্থী এলে বামপন্থী আসবেন না, বা বামপন্থী এলে ডানপন্থীরা রেগে যাবেন, এটা তো রবীন্দ্রনাথের আদর্শ নয়। ছাত্র, শিক্ষকেরা কেউ সক্রিয় রাজনীতিতে না থাকলেও অগণিত রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী রবীন্দ্রনাথের কাছে ছুটে গিয়েছেন। আশ্রমে থেকেছেন। দিনের পর দিন পড়ুয়াদের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন, কোথাও কোনও বাধা ছিল না। হয়তো তখন এ দেশে আধুনিক রাজনীতি সবে পা ফেলছে, তাই তার একটি গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আজকের দলীয় রাজনীতির যে রূপ, তাতে প্রশ্ন ওঠা হয়তো স্বাভাবিক। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, পড়াশোনা ছেড়ে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিক, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য এটা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু গাঁধীজি তখন সারা দেশ জুড়ে প্রচারে নেমেছেন। ছাত্রেরাও উত্তেজিত। উপাচার্য মালব্য তাঁর মতের সম্পূর্ণ বিরোধী গাঁধীজিকেই নিয়ে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সামনে। গাঁধীজি আধুনিক শিক্ষাকে বিষবৎ পরিহার করে ছাত্রদের আন্দোলনে যোগ দিতে বললেন। মালব্য উল্টোটা বোঝালেন। পাশাপাশি বসেই। উভয়ে কেউ কারও বিরুদ্ধে কিছুই বললেন না।
বস্তুত সেই সময়ে পড়ুয়াদের লেখাপড়া ছেড়ে রাজনীতিতে যোগদানের বিষয়ে শিক্ষাবিদদের অনেকেই আপত্তি করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ও সেই দলে ছিলেন। এক দিকে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অধ্যক্ষ বা শিক্ষাবিদরা ছিলেন, অন্য দিকে ছিলেন রাজনীতির চেয়ে শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া মানুষেরা। উভয়ের মধ্যে মতের অমিল হলেও, দু’টি নির্দিষ্ট ধারা বিদ্যমান ছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন বা মোতিলাল নেহরুর মতো মানুষ যেমন আমাদের আইনসভার লড়াই শিখিয়েছেন, তেমনই গাঁধীজি চিনিয়েছেন প্রতিরোধের প্রকরণগুলি।
সেই প্রকরণগুলির প্রথম ধাপ হচ্ছে, নিজেকে প্রশ্ন করা। গাঁধীজির হিন্দ স্বরাজ গ্রন্থটি এগিয়েছে এ ভাবেই। পাঠক এবং সম্পাদকের কথোপকথন। প্রশ্ন করছেন পাঠক, উত্তর দিচ্ছেন সম্পাদক। ধরে নিতে পারি যে, সম্পাদকের বক্তব্যই গাঁধীজির বক্তব্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রশ্ন তুলছেন যে পাঠক, তিনিও একই ব্যক্তি। অর্থাৎ, কোনও সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত নয়। প্রতিপ্রশ্ন, অনেকান্তবাদই অভীষ্ট। নিজের মধ্যে এই প্রশ্নটি না থাকলে আমি যে কাজ করছি, তা ঠিক কি না, বুঝব কী ভাবে? এ ছাড়াও আমার মতামতের বিরুদ্ধে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের বক্তব্য পুরোপুরি নস্যাৎ না করে যদি একটু শুনি, সেটাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অনেক সময়েই একটি বিশেষ অবস্থান নিতে হয়। কিন্তু সেই অবস্থানটি বিভিন্ন কাছাকাছি মতামতের সমন্বয়ে গঠিত হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে একের মত অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, গণতন্ত্রের যেটা সবচেয়ে বড় সমস্যার দিক।
একবার সদলবলে শান্তিনিকেতনে গিয়েছেন গাঁধীজি। রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে। তখনও অহিংস অসহযোগ শুরু হয়নি। প্রাক্তন আশ্রমিক ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, “কালীমোহনবাবু আমাদের প্রাক্তনদের ও আশ্রমের অন্যান্য অধ্যাপকদের নিয়ে গাঁধীজির সাথে দেখা করেন। রাজনৈতিক নানা কথাবার্তা ও আলোচনা হয়। ইংরেজ রাজত্বের নানা অবিচারের কথা কালীমোহনবাবু উত্থাপন করেন। গাঁধীজি ধীর, স্থির ভাবে সব শুনে বললেন, আচ্ছা, ধরুন, আজ যদি ইংরেজ চলে যায় এবং আপনি গভর্নর হন, আপনি কীভাবে রাজ্য চালাবেন?” (আশ্রমস্মৃতি, পৃ ৫৭)
এই প্রশ্নটি আজ ফিরে ফিরে আসে। কী ভাবে চলবে গণতন্ত্র? কখনও মনে হয়, এটাই বুঝি সবচেয়ে বড় বিপদ। কিন্তু কিছু দিন পরে তা স্তিমিত হয়ে এলে আরও পাঁচটি সমস্যা মাথাচাড়া দেয়। কিন্তু আমাদের সব মত শোনার ধৈর্য আছে কি? অন্যকে অসহিষ্ণু বলা যতটা সহজ, নিজেকে সহিষ্ণু করে তোলা ঠিক ততটাই শক্ত কাজ। নিজে মার্ক্সবাদের বিরোধী হয়েও চলার পথে তাঁদের হাত ধরতে কুণ্ঠিত হননি গাঁধীজি। কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্য গড়ে উঠেছিল। নিজের দলে তার মাশুল দিতে হয়েছিল পি সি জোশীকে। তবে তার জন্য তিনি অনুতপ্ত ছিলেন না।
অহিংস পথের স্রষ্টা, যিনি মনে করতেন এই পথে না চললে অহিংস সমাজ গঠিত হবে না এবং যাঁর এই পথকে প্রতিক্রিয়াশীল মনে করতেন কেউ কেউ, তাঁদের অনেকের সঙ্গে সংলাপে লিপ্ত হয়েছেন গাঁধীজি। কেউ কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন, কেউ বা অন্য দলে। কিন্তু সংলাপ এড়িয়ে নয়। যে মানবেন্দ্রনাথ লেনিনকে মুখের উপর বলে এসেছিলেন যে গাঁধীজির সঙ্গে সহযোগিতা অসম্ভব, কারণ তিনি প্রতিক্রিয়াশীল, সেই তিনিই পরে তথাকথিত গাঁধী টুপি পরে কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। মহাত্মা সাদরে তা মেনেও নিয়েছেন। সূর্য সেনের শিষ্যা কল্পনা দত্তের সঙ্গে দেখা করেছেন জেলে। কেন কল্পনা সশস্ত্র পথকে বেছে নিলেন, জানতে চেয়েছেন সে কথা। পরে জেল থেকে বেরিয়ে কল্পনা যখন কমিউনিস্ট দলের সদস্যা হচ্ছেন, বাপুর সঙ্গে বন্ধুত্ব তখনও অটুট।
পরাধীন দেশে এতটা সম্ভব হয়েছিল। স্বাধীনতার এত বছর পরে বিরোধী মতকে জেলে না ঢুকিয়ে, নানা ধারায় পর্যুদস্ত না করে অন্য কিছু কি ভাবা যায় না? একটি সংলাপনির্ভর গণতন্ত্রের ভাবনা কি এতটাই কঠিন যে, তার উপর নির্ভরশীল হলে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার এখনকার তুলনায় আরও নীচে নেমে যেতে পারে?