সম্পাদকীয় ১

মৃত্যুর ধারাবিবরণী

শ্রেণি, বর্ণ ও রাষ্ট্রীয় রাজনীতির এ-হেন ত্রিবেণী সঙ্গমে রোশনি ও অবিনাশের মৃত্যু অনিবার্যই বটে। ভারত মহাত্মা গাঁধীর চশমাটি লইয়াছে— তাহাকে ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর বিজ্ঞাপনে সযত্নে সাজাইয়াছে, কিন্তু তাঁহার মনটিকে লয় নাই। নিজের প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করিবার দর্শন এই ভারতের মর্মে প্রবেশ করে নাই, কারণ তাহা চশমার ন্যায় অনুশীলনরহিত নহে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০৯
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

এক দ্বাদশবর্ষীয়া বালিকা আর এক দশমবর্ষীয় বালক। রোশনি ও অবিনাশ বাল্মীকি। তাহারা কোনও পরাবাস্তব উপন্যাসের চরিত্র হইতে পারিত। এমন একটি উপন্যাস, যাহার প্রথম পৃষ্ঠাতেই জানা থাকিত, ছেলেমেয়ে দুইটির মৃত্যু হইবে গণপ্রহারে। এবং, উপন্যাসের ঘটনাক্রম ক্রমে জানাইতে থাকিবে, কেন তাহাদের মৃত্যু অনিবার্য। এই নাবালক চরিত্রদ্বয়ের নিবাস মধ্যপ্রদেশে। তাহারা জাতিগত পরিচয়ে দলিত। আর্থিক ভাবে অতি দরিদ্র। এই দুইটি পরিচিতির যে কোনও একটিই ভারতে মৃত্যুর যথেষ্ট কারণ হইতে পারে— দুইয়ে মিলিলে আর কথা নাই। রোশনি ও অবিনাশের মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ, তাহারা পথপার্শ্বে মলত্যাগ করিতেছিল। উচ্চবর্ণের দুই প্রতিবেশী সেই দৃশ্যে মর্মান্তিক চটিয়া যায়, এবং তৎক্ষণাৎ প্রবল প্রহারে বালক-বালিকাকে খুন করিয়া ফেলে। রোশনিরা অবশ্য অনন্যোপায় হইয়াই পথপার্শ্বে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য হইয়াছিল, কারণ তাহাদের গৃহে শৌচাগার নাই। গত বৎসর এপ্রিলে তাহাদের গ্রামটি ‘প্রকাশ্যে মলত্যাগ মুক্ত’ গ্রাম হিসাবে ঘোষিত হইবার পরও নাই, কারণ তাহাদের গৃহে শৌচাগার নির্মাণার্থে অর্থবরাদ্দ হইবার পরও পঞ্চায়েত প্রধান সেই টাকাটি দেন নাই। কেন, সেই কারণটি অনুমান করা চলে— বাল্মীকি পরিবারটি এমনই দরিদ্র ও প্রান্তিক যে সামাজিক ক্ষমতার উচ্চাবচতার সিঁড়ির কোনও ধাপেই তাহাদের ঠাঁই হয় না। ক্ষমতাবানরা তাহাদের হকের পাওনা হইতে বঞ্চিত করিলেও প্রতিবাদ করিবার উপায় থাকে না, কারণ তাহাদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। কিন্তু, শৌচাগার যদি না-ও থাকে, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেই হয়। দুই শিশুর মলত্যাগের দৃশ্য দেখিয়া হকম ও রামেশ্বর যাদব নামক দুই ভাই— অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত হইলেও জাতিগত পরিচিতিতে যাহাদের অবস্থান বাল্মীকিদের ঢের উপরে— এমনই চটিল যে একেবারে খুনই করিয়া ফেলিল। কাজটি তাহাদের নিকট সঙ্গত, সহজ এবং স্বাভাবিক ঠেকিয়াছিল, কারণ ভারতে এখন মুসলমান বা দলিত হত্যা জলভাত হইয়া গিয়াছে। রাষ্ট্র তাহাতে সাধারণত আর আপত্তি করে না।

Advertisement

শ্রেণি, বর্ণ ও রাষ্ট্রীয় রাজনীতির এ-হেন ত্রিবেণী সঙ্গমে রোশনি ও অবিনাশের মৃত্যু অনিবার্যই বটে। ভারত মহাত্মা গাঁধীর চশমাটি লইয়াছে— তাহাকে ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর বিজ্ঞাপনে সযত্নে সাজাইয়াছে, কিন্তু তাঁহার মনটিকে লয় নাই। নিজের প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করিবার দর্শন এই ভারতের মর্মে প্রবেশ করে নাই, কারণ তাহা চশমার ন্যায় অনুশীলনরহিত নহে। নিম্নবর্ণের প্রতি সহমর্মিতার পাঠ এই ভারতের আওতার বাহিরেই থাকিয়া গিয়াছে। প্রান্তিক শ্রেণির ক্ষমতায়ন? তাহাও ভিন্ন সাধনার ফল। ভারত শুধু চশমাতেই সন্তুষ্ট। এ-ক্ষণে প্রশ্ন, গ্রামের দুই অশিক্ষিত রগচটা যুবক গাঁধীর দর্শনে দীক্ষিত হইবে, ইহা কি কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি দাবি নহে? অবশ্যই, এবং যাদব ভ্রাতৃদ্বয়ের নিকট সেই প্রত্যাশা কাহারও ছিল না। প্রত্যাশা ছিল ভারত নামক রাষ্ট্রের নিকট, তাহার পরিচালকদের নিকট। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করিবার প্রত্যাশা, প্রান্তিক শ্রেণির ক্ষমতায়নের প্রত্যাশা, এবং জাতি-ধর্মনির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তাবিধানের প্রত্যাশা। সব নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্বই সরকারের, রাষ্ট্রের। দলিত বা সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে সেই দায়িত্ব আরও বেশি, কারণ সেই পরিচিতির কারণেই তাহাদের আক্রান্ত হইবার সম্ভাবনাও বেশি। রাষ্ট্রই পারে তাহাদের রক্ষা করিতে, নিরাপত্তা দিতে। প্রথম যে দিন কোনও মুসলমানের গণপ্রহারে মৃত্যু হইল, প্রথম যখন কোনও দলিতকে তাঁহার জাতিগত পরিচিতির কারণে হেনস্থা হইতে হইল— সে দিনই যদি রাষ্ট্র রুখিয়া দাঁড়াইত, অপরাধীদের কঠোরতম শাস্তি হইত, তবে এই যাদব ভ্রাতৃদ্বয় ও তাহাদের পরিবার বা সমাজ নিজেদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করিতে শিখিয়া লইত। রোশনি ও অবিনাশের মৃত্যুর এই ধারাবিবরণী রচিত হইত না। তাহা এক ভিন্ন ভারত হইত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement