ফাইল চিত্র
পাশ-ফেল ফিরিয়া আসিবার পথে। এই বার লটারির মাধ্যমে স্কুলের প্রাথমিক স্তরে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির ব্যবস্থা খারিজ করিবার প্রস্তাব দিল সরকার। মেধার পরীক্ষা লইয়া তাহাদের ভর্তি করিবে স্কুল। সমালোচকরা বলিবেন, এমন অল্প অল্প করিয়া ভাঙিয়া কাজ কী? শিক্ষার অধিকার আইনটাই বাতিল করা হউক। তাহার যে মূল দর্শন, সকল শিশুর শিক্ষায় সমানাধিকার, রাজ্য সরকার কি তাহাতে বিশ্বাসী নহে? বিধানসভায় দাঁড়াইয়া শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলিয়াছেন, লটারির মাধ্যমে ছাত্র ভর্তির ফলে অনেক স্কুলের মান নামিয়াছে। শিক্ষামন্ত্রীর যোগ্য কথাই বটে। স্কুলের মান রাখিতে তাঁহার বড়ই আগ্রহ, ছাত্রের মান লইয়া মাথাব্যথা নাই। যাহাদের মন্দ ছাত্র বলা হইতেছে, তাহাদের অধিকাংশই যে দরিদ্র পিতামাতার সন্তান, মন্ত্রী মহাশয় দৃশ্যত তাহা মনে রাখেন নাই। ক্ষমতা বোধ করি এক এমনই মাদক, যাহা ক্ষমতাধরকে আত্মবিস্মৃত করিয়া তোলে। তাই ‘উন্নত’ সরকারি স্কুলগুলিকে ‘মন্দ’ ছাত্রদের কলুষ হইতে বাঁচাইতে মন্ত্রী আইন লঙ্ঘনের প্রস্তাব দিয়াছেন আইনসভায়। এই ছুতমার্গ নূতন নহে। দরিদ্রতম এলাকাগুলিতে যথাযথ স্কুল না দিয়া ‘শিশুশিক্ষা কেন্দ্র’ চালাইতেছে রাজ্য। এ বার সরকারি স্কুলগুলির মধ্যেও বর্ণপ্রথার প্রবর্তন করিতে চায়। মন্দ ছাত্রদের উন্নতি না করিতে পারিলে তাহা ‘ভাল’ স্কুল নহে, এ কথা বলাই কি তাঁহার উচিত ছিল না? যাহার ফল ভাল ও যাহার ফল মন্দ, দুই জনেই এই রাজ্যের শিশু। সরকার ও রাজ্যবাসীর চক্ষে তাহাদের অধিকার সমান। অধিক সুবিধা দিবার ক্ষমতা থাকিলে দুর্বলতর শিশুটিকেই দিতে হইবে। কারণ, তাহার প্রয়োজন অধিক।
একটি শিক্ষক সংগঠনের নেতা বলিয়াছেন, কয়েকটি স্কুলকে ‘উৎকর্ষ কেন্দ্র’ ঘোষণা করিয়া সেইগুলিতে মেধা-পরীক্ষার ভিত্তিতে ভর্তি করা হইতে পারে। তিনি ভুলিয়াছেন, উৎকর্ষ কেন্দ্র নির্মাণের এই ধারণা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, বিশেষত গবেষণার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। স্বল্প কিছু শিক্ষক-ছাত্রের উন্নততম জ্ঞান অন্বেষণের জন্য এমন কেন্দ্র প্রয়োজন। স্কুলশিক্ষার উদ্দেশ্য পৃথক। বুনিয়াদি শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজন, সকল ছাত্রের শ্রেণি-অনুসারী ক্ষমতাগুলি তৈরি করা। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য উৎকর্ষের জমির প্রস্তুতি। শহরবাসী ও গ্রামবাসী, ধনী ও দরিদ্র, উচ্চবর্ণ ও দলিত-আদিবাসী, হিন্দু ও সংখ্যালঘু, সকল পরিবারের শিশুকে আনন্দময়, কার্যকর শিক্ষা দিতে হইবে স্কুলকে। তেমন স্কুল কেন পাড়ায় পাড়ায় থাকিবে না? উন্নত মানের শিক্ষা হইতে একটিও শিশুকে বঞ্চিত করা অপরাধ। সেই চেষ্টাও হাস্যকর। ইতিহাসের দিকে তাকাইলেই শিক্ষক মহাশয় বুঝিবেন, কে উৎকৃষ্ট শিক্ষার যোগ্য, কে অযোগ্য, শৈশবে তাহা নির্ণয় করিতে গেলে ভুল হইবার সম্ভাবনাই অধিক। বিশ্ববিখ্যাত মেধাবীরা অনেকেই শৈশবে অতি ‘মন্দ’ ছাত্র ছিলেন।
শৈশবে মেধা নির্ণয় কেবল দুঃসাধ্য নহে, তাহা অনুচিত। অধিকার কথাটির অর্থই আমরা ভুলিয়াছি। অধিকার তাহাই, যাহার উপর শর্ত আরোপ করা চলে না। তথাকথিত মেধাও একটি শর্ত। বুনিয়াদি শিক্ষায় তাহা আরোপ করা হইবে কেন? এই কারণেই লটারি স্কুলে ছাত্রছাত্রী ভর্তির সম্ভাব্য উপায়গুলির মধ্যে সর্বোত্তম। তাহার কারণ, ইহার মূল দর্শনটি হইল: সকল শিশুর মধ্যে সমান সম্ভাবনা রহিয়াছে, সকল স্কুল সমান যত্নে তাহা লালন করিবে। ‘উত্তম স্কুল’ বলিয়া আদৌ যদি কিছু থাকে, তাহাতে দুর্বল ছাত্রেরও অধিকার রহিয়াছে। দুর্বল ছাত্র যাহাতে সবল হয়, উজ্জ্বল হয় উজ্জ্বলতর, তাহারই চেষ্টা করিবেন শিক্ষকেরা। শিশুদের মধ্যে, স্কুলগুলির মধ্যে, শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্যের অর্থ অসাম্যকে প্রশ্রয়। অসাম্য অন্যায়। অন্যায়ের ভিত্তিতে নীতি হইতে পারে না।