ছবি: পিটিআই।
বাঙালির বাগ্ধারায় ‘রাম’ শব্দটির ব্যবহার কম নহে। বাঙালি ‘রাম ধাক্কা’ দিতে অভ্যস্ত। ‘রাম চিমটি’ দিতেও অকুতোভয়। লক্ষণীয়, এই সকল ক্ষেত্রেই ‘রাম’ সর্বোত্তমের বিশেষণ। ইহাও লক্ষণীয়, রামের ভগবান বা অবতার রূপ লইয়া বঙ্গসমাজে কোনও কালেই বিশেষ আতিশয্য ছিল না। বাংলায় তিনি পৌরাণিক চরিত্র হিসাবেই বিরাজিত ছিলেন। কিছু কাল যাবৎ পুরাণের রাম বাঙালির ঠাকুরঘরে স্থান পাইয়াছেন, ‘হনুমান চালিশা’কে সঙ্গী করিয়া। ধর্মাচরণ অবশ্যই ব্যক্তির স্বাধিকার, তবে তাহা যখন ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ হইতে চায়, তখন কিছু সংশয় ও অনুমানের অবকাশ থাকিয়া যায় বইকি। প্রশ্ন তুলিবার কারণ থাকে যে, ভারতের অন্যত্র হিন্দুত্ববাদ ও তাহার রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত ঘটার সঙ্গেই কি বঙ্গবাসীর, নির্দিষ্ট করিয়া বলিলে বঙ্গভাষীর, ঠাকুরঘরে রাম তাঁহার পোক্ত আসন পাইলেন? এবং সেই ক্ষেত্রে কি বলা চলে, রাম-ভক্তি অপেক্ষা রাম-রাজনীতির ছায়াই এই নূতন ধারায় অধিকতর দৃশ্যমান? অযোধ্যায় রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গে রাম-পূজনের সমারোহ এই সকল প্রশ্নকে আর এক বার উস্কাইয়া দিতেছে।
অযোধ্যায় শিলান্যাসের দিনটি বাংলায় করোনাজনিত লকডাউনের আওতায় পড়িয়াছিল। আগেই সেই মর্মে বিজ্ঞপ্তিও জারি হইয়াছিল। রাজ্যের বিজেপি-প্রধান কিন্তু পাল্টা ঘোষণা করিলেন, পূজন কর্মসূচি হইতে তাঁহারা কোনও মতেই সরিবেন না। অতএব লকডাউনের মধ্যেই পথে নামিয়া রামভক্তেরা উৎসব পালন করিলেন। শুধু জেলা স্তরেই নয়, উৎসবের শঙ্খ-ঘণ্টা বাজিল কলিকাতাতেও। বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা সাংসদ দিলীপ ঘোষের নির্বাচনী এলাকা খড়্গপুরে পুলিশ ও ভক্তকুলের মধ্যে অশান্তির ঘটনাও ঘটিল। বিক্ষিপ্ত গোলমালের খবর মিলিল মালদহ হইতে। কিন্তু বিস্ময়ের বাসা অন্যত্র। পূর্ব মেদিনীপুরে কাঁথি, এগরা, নন্দীগ্রাম, পুরুলিয়ার আদ্রা ইত্যাদি জায়গায় তৃণমূল কংগ্রেসের নামে পরিচিত লোকজনও রাম-উৎসবে মাতিলেন। কাঁথিতে রাজ্যের জাঁদরেল মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর পাড়ায় নাকি রাম-পূজার জৌলুস ছিল নজরকাড়া। নন্দীগ্রামে তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধান অকপটে কবুল করিলেন, তাঁহার কাছে ধর্মের স্থান দলের আগে। আদ্রায় তৃণমূল শহর কমিটির সভাপতিরও যুক্তি, রাম সকল হিন্দুর দেবতা বলিয়াই তিনিও রাম-পূজনে শামিল। প্রশ্ন উঠিবে, এত দিনও কি তাঁহারা এই ভাবেই রামের পূজা করিয়া আসিয়াছেন? যদি তাহা না হয়, তবে কিন্তু না মানিয়া গতি নাই যে, ইহা ভক্তিমার্গ নহে, রাজনীতি-মার্গ।
বস্তুত দেশে এবং এই রাজ্যে বিজেপির অগ্রগতির সহিত বাংলায় রামনবমী পালনের ঘটাও দেখা যাইতেছে। সেই সমারোহে তৃণমূলের নেতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বারংবার আলোচনার বিষয় হইয়াছে। বলা হইয়াছে, রাম কাহারও একার নন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার: ভোটের বিভাজন আটকানো। হিন্দু ভোট-ব্যাঙ্কে ভাঙন রোধের প্রয়াস। ‘হিন্দুত্ব’-এর পরীক্ষায় সূচ্যগ্র জমি না-ছাড়ার লড়াই। বিজেপির ‘রাম’ এবং তৃণমূলের ‘রাম’ এই ভাবেই পরস্পরের প্রতিপক্ষ হইয়া উঠিয়াছেন। বাংলার রাজনীতিতে ‘রাম’-সংবেদনশীলতা অবশ্য অতীতেও দেখা গিয়াছে। তিন দশক আগে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের ডাক দিয়া দেশের নানা প্রান্ত হইতে ‘রামশিলা’ অর্থাৎ ‘পবিত্র’ ইট পাঠানোর পর্বে বাংলার এক জেলায় প্রভূত উত্তেজনা দেখা দেয়। দুইটি ইট পুকুরে ছুড়িয়া দেওয়া হয়। উপরমহলের নির্দেশে গভীর রাতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন পুকুর হইতে সেই ইট উদ্ধার করিয়া গন্তব্যে রওনা করায়। রাজ্যে তখন বাম শাসন। সুতরাং আজ যে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধির ফলে শাসক তৃণমূলকে রামচন্দ্রের ভরসায় থাকিতে হইতেছে, তাহা নূতন কিছু নহে। ভোটতান্ত্রিক রাজনীতির অবয়ব মাত্র!