পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ধ্বস্ত মূর্তির চারিপার্শ্বে ছড়াইয়া থাকিল বাঙালির বিপন্নতা। বাঙালি বলিতে কোনও নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী নহে, জন্মসূত্রে বাংলাভাষী জনসমষ্টিও নহে। ‘বাঙালিত্ব’ এখানে একটি ধারণা। যে ধারণা নবজাগরণের আলোকে স্নাত, উদারবাদে দীক্ষিত, গ্রহণশীলতায় অভ্যস্ত, আন্তর্জাতিকতায় স্থিত, যাহা প্রকৃতপ্রস্তাবে একটি সাংস্কৃতিক চরিত্রলক্ষণ। পশ্চিমবঙ্গের নয় কোটি মানুষের মধ্যে কয় জন এই বৃহৎ বাঙালির চেতনায় সংস্কৃত, সেই প্রশ্নটি এ ক্ষণে গৌণ। মঙ্গলবার বিপন্ন হইল ধারণাটির অস্তিত্ব, এবং যাঁহারা সেই ধারণাটিকে আত্মস্থ করিয়াছেন, শ্রদ্ধায় ধারণ করিয়াছেন, বিপন্ন হইলেন তাঁহারা। বঙ্গভাষী হইলেও, না হইলেও। বিদ্যাসাগরের মূর্তি যাহারা ভাঙিল, একাধিক ভিডিয়ো ক্লিপ হইতে তাহাদের পরিচয় সম্বন্ধে একটি ধারণা পাওয়া সম্ভব। তাহাদের একাংশ বঙ্গভাষী নহে। হয়তো এই রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দাও নহে। বহিরাগত। আবার, বঙ্গভাষী দুষ্কৃতীরাও এই তাণ্ডবে ছিল। তাহাদের রাজনৈতিক অবস্থানও অনুমান-সম্ভব। কেহ বলিতে পারেন, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার কর্মসূচি তাহাদের ছিল না, যাহা ঘটিয়াছে তাহা নিতান্তই ঘটনাক্রম। কথাটির সত্যাসত্য এই ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। এবং, যদি সত্যই পূর্বপরিকল্পনা ব্যতীত তাহারা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙিয়া থাকে, তবে তাহা আরও বিপজ্জনক। কারণ, বিদ্যাসাগর কে, বৃহৎ বঙ্গের সত্তায় এই খর্বাকৃতি পুরুষের ছায়া কতখানি দীর্ঘ, এই কথাগুলি তাহারা জানিত না, অথবা জানিয়াও তোয়াক্কা করে নাই। বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তিতে বাঙালির বাঙালিত্ব আবদ্ধ নহে, কিন্তু তাহার উপর আঘাত আসিলে তাহা ওই সংস্কৃতির উপরই আক্রমণ, কারণ মূর্তি ভাঙিয়া এই দুষ্কৃতীরা স্পষ্ট বলিয়া দিল, কোনও ধারণার মর্যাদা লঙ্ঘন করিতে তাহাদের বাধে না।
কেহ বলিতে পারেন, বিদ্যাসাগরের মূর্তির উপর আক্রমণ এই প্রথম নহে। কয়েক শত মিটার দূরত্বে কলেজ স্কোয়্যার, সেখানেই অতীতে নকশালরা বিদ্যাসাগরের মূর্তির মুণ্ডচ্ছেদ করিয়াছিল। সেই লজ্জা লুকাইবার নহে। কিন্তু, যতই বালখিল্য হউক, নকশালদের একটি রাজনৈতিক যুক্তি ছিল— তাহারা বিদ্যাসাগরকে বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থার প্রতীক ঠাহরাইয়াছিল, এবং সেই প্রতীকটিকে ভাঙিয়াছিল। মঙ্গলবারের দুষ্কৃতীদের সেই রাজনীতি ছিল না। যাহা ছিল, তাহা নিছক বিদ্বেষ। উদারতার সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষ, যথার্থ সুশিক্ষার প্রতি বিদ্বেষ। বিদ্যাসাগর সেই শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতিভূ। এবং লক্ষণীয়, মূর্তিটি তাহারা প্রকাশ্যেই ভাঙিয়াছে। নকশালদের রাত্রির অন্ধকারের আড়াল প্রয়োজন হইয়াছিল। অর্থাৎ, এমন আক্রমণের মধ্যে যে গূঢ় অবৈধতা, এই বাহুবলীরা এখন তাহাকেও হেলায় অস্বীকার করিতেছে। ইহা শুধু আক্রমণই নহে, নির্লজ্জ অহঙ্কারের কুৎসিত প্রদর্শনী।
শিক্ষাকে, উদারবাদকে, গ্রহণশীলতাকে তাচ্ছিল্য করিবার যে প্রবণতাটি ভারতে দ্রুত কায়েম হইতেছে, মঙ্গলবারের ঘটনাক্রমে তাহারই প্রতিফলন। যাহা উগ্র হিন্দুত্ব অথবা মোদীপাক অতিজাতীয়তাবাদী নহে, তাহাই তাচ্ছিল্যের যোগ্য, এই কথাটিকে শিক্ষিত, সভ্য ভারত যথেষ্ট প্রতিরোধ করে নাই। বরং, প্রশ্রয়ই দিয়াছে। অশিক্ষাকে বৈধতা দিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যখন একের পর এক অ-শিক্ষিত উক্তি করিয়া চলিয়াছেন, শিক্ষিত ভারত সেই সব উক্তিতে নিহিত অশিক্ষার দম্ভকে তুচ্ছ করিয়া বড় জোর রসিকতা করিয়াছে। এবং, প্রতিরোধহীনতার সেই ফাঁক গলিয়াই আজিকার দিনটি উপস্থিত হইয়াছে, যখন এক দল দুষ্কতীকে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙিতে দেখিয়াও সভ্য সমাজ সর্বশক্তিতে ঝাঁপাইয়া পড়িতে পারে না। যে অস্ত্রে উদার ভারতের হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে, মঙ্গলবার কলিকাতার রাজপথে সেই অস্ত্রটিই বঙ্গসংস্কৃতির হৃৎপিণ্ডে বিঁধিয়া গেল।