এ কৌশল নতুন নয়

গুজরাতে নরেন্দ্র মোদী-মুখোশের রমরমা আরও দশ বছর আগে। ২০০৭ বিধানসভা ভোটের সময়। সনিয়া গাঁধী গুজরাতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে ‘মওত কা সওদাগর’ বলে আক্রমণ করেছিলেন।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share:

পোরবন্দরে মহাত্মা গাঁধীর পৈতৃক ভিটে, তাঁর জন্মস্থান ‘কীর্তি মন্দির’ থেকে বেরিয়ে শরবতের দোকানে এক ছোট্ট ছেলের সঙ্গে দেখা। দু’বছর আগের কথা। ২০১৭ সালের গুজরাত বিধানসভা ভোট। বাবার দোকানে বসা ছেলেটির মুখে নরেন্দ্র মোদীর মুখোশ। শরবতের দোকানে যিনিই আসছেন তিনিই বলছেন, মোদীজি, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেল, এক গ্লাস শরবত দিন।

Advertisement

গুজরাতে নরেন্দ্র মোদী-মুখোশের রমরমা আরও দশ বছর আগে। ২০০৭ বিধানসভা ভোটের সময়। সনিয়া গাঁধী গুজরাতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে ‘মওত কা সওদাগর’ বলে আক্রমণ করেছিলেন। বিজেপির লক্ষ লক্ষ নেতা-কর্মী-সমর্থক মুখোশ পরে নরেন্দ্র মোদী সেজেছিলেন। বার্তা স্পষ্ট ছিল। মোদী একা নন। সকলেই মোদী। সনিয়া গাঁধী কাকে নিশানা করছেন? সনিয়ার আক্রমণের উল্টো ফল হয়েছিল।

মোদীর প্রচারের নতুন মন্ত্র: ম্যায় ভি চৌকিদার। এত দিন নিজেকে চৌকিদার বলছিলেন। এখন সবাইকে দিয়ে বলাচ্ছেন। চৌকিদার পরিচিতির মেধাস্বত্ব এখন তিনি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান। তাঁর সরকারের মন্ত্রী, বিজেপির নেতারা তো বটেই, সততার পথে চলা দেশের সবাই চৌকিদার। এবং, দুর্নীতির সঙ্গে দেশের সুরক্ষাও মিশিয়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষও চৌকিদারি করছেন। পরিচিতি বদলে ফেলার নতুন কৌশল।

Advertisement

২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গার পরে নরেন্দ্র মোদী একই কৌশল নিয়েছিলেন। তখন দেশবিদেশে নিন্দা। বাজপেয়ী ‘রাজধর্ম’ স্মরণ করিয়েছেন। কলকাতায় গায়ক গান বেঁধেছেন, ‘তুমি আসবে বলেই দেশটা এখনও গুজরাত হয়ে যায়নি।’ মোদী গুজরাতি অস্মিতার তাস খেললেন। বললেন, তাঁর নয়, এ আসলে গুজরাতের অপমান। গুজরাতিদের গর্বে মিলেমিশে গেল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের আবেগ।

এখন তাঁর চৌকিদারিত্বে বিজয় মাল্য-নীরব মোদী-মেহুল চোক্সীদের বিরুদ্ধে সরকারি ব্যাঙ্কের কোটি কোটি টাকা লুট করে পালানোর অভিযোগ। যুদ্ধবিমান কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের গোপন ফাইল ফাঁসের অভিযোগ। রাহুল গাঁধী বলছেন, ‘‘চৌকিদার চোর হ্যায়।’’ এবং এ বারও তাঁর দিকে ধেয়ে আসা আক্রমণের তির সকলের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রী। দেশবাসীকে বলছেন, আমি তো আপনাদের মতোই দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ রুখতে পাহারাদারি করছি। বিরোধীরা আপনাদেরও চোর বলে অপমান করছেন। এ-ও পুরনো কৌশলের রকমফের। সবার মুখে মোদীর মুখোশ থেকে ‘ঘর ঘর মোদী’ স্লোগান থেকে ‘আমিও চৌকিদার’— একই মুদ্রার এ পিঠ, ও পিঠ। আইডেন্টিটি সুইচিং বা পরিচিতি বদলে ফেলা।

এবং এতদ্দ্বারা মানুষের অবচেতনে আর একটি ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন নরেন্দ্র মোদী। তা হল, তিনি সাধারণ মানুষ। কবেই ঘর-সংসার ছেড়েছেন। পিছুটান নেই, সাংসারিক দায়ও নেই। তা হলে কার জন্য দুর্নীতি করবেন? এ-ও নতুন নয়। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী বলতেন, তাঁর কাছে ‘সিএম’-এর অর্থ চিফ মিনিস্টার নয়, কমন ম্যান। ২০১৪ লোকসভা ভোটের আগে মোদী নিজেকে ‘চাওয়ালা’ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। তার সঙ্গে ওবিসি পরিচয়ের মিশেল করে নিজেকে নিচুতলার প্রতিনিধি হিসেবে ‘ব্র্যান্ডিং’ করেছিলেন। চাওয়ালা থেকে প্রধানমন্ত্রী— আমজনতার কাছে স্বপ্নপূরণের কাহিনি হিসেবে প্রচারিত ছিল।

বিজ্ঞাপন স্রষ্টা শৌভিক মিশ্রের কথায়, যে কোনও পণ্য নিজস্ব একটা অবস্থান তৈরির চেষ্টা করে। কোনও সাবান সেলুলয়েডের তারকাদের সাবান হিসেবে আত্মপরিচয় দেয়। কোনও সাবানের পরিচিতি হয় খেটে খাওয়া মানুষের সাবান হিসেবে, যা অনেক দিন চলবে। খরচ কম হবে। রাজনীতিকরাও এ ভাবে নিজের ‘পোজ়িশনিং’ করেন।

দেশের রাজনীতিতে নিচুতলার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করা বা নিচুতলা থেকে উঠে আসা রাজনীতিকের সংখ্যা কম নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়াবতী সেই দলে পড়েন। নরেন্দ্র মোদীর ভোলবদল দেখে দলিত নেত্রী মায়াবতী প্রশ্ন তুলেছেন, নরেন্দ্র মোদী কি আর চাওয়ালা নন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, চৌকিদারের এত ফ্যাশন!

কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের মানুষ নিজেকে সত্যিই চৌকিদার ভাববে? জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের মতে, গুজরাতি অস্মিতা যদি জাতি-গর্বের সঙ্গে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের আবেগের মিশেল হয়ে থাকে, তবে চাওয়ালা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরাটা ছিল নিচুতলার মানুষের উঠে আসার লড়াইয়ের গল্প। নরেন্দ্র মোদী সত্যিই চাওয়ালা ছিলেন, মানুষ তা বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’ প্রচারটা বিরোধীদের প্রচার ভোঁতা করার মরিয়া চেষ্টা। প্রধানমন্ত্রী অন্য একটি পরিচিতি দখল করার চেষ্টা করছেন। তিনি নিজে চৌকিদার ছিলেন না। তিনি চৌকিদারের রূপ ধরেছেন। কিন্তু মাল্য-মোদী-চোক্সীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে তাঁর চৌকিদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়ে গিয়েছেন। তাই মোদী সকলকেই চৌকিদার বানাতে চাইছেন। এই প্রচেষ্টা সফল হবে কি না, প্রশ্ন রয়েছে।

সমস্যা হল, নরেন্দ্র মোদীর এই চৌকিদার নিয়ে চর্চায় আসল বিতর্কগুলো ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। দেশ জুড়ে চাষিদের সমস্যার সমাধান করতে, কৃষকদের আত্মহত্যা রুখতে কি মোদী সরকার কিছু করতে পারল? বছরে এক কোটি নতুন চাকরির প্রতিশ্রুতি পূরণে আদৌ কিছু কাজ হল? না কি বেকারত্বের আসল ছবি লুকোতেই ধামাচাপা দেওয়া রইল সরকারি সমীক্ষা? প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত নানা প্রকল্পের কতখানি সুফল পেলেন গরিবরা? আর, হ্যাঁ, ‘অচ্ছে দিন’ কি সত্যিই এল?

সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি তাঁর মাতৃভাষা তেলুগুতে প্রচলিত একটা গল্প শুনিয়েছিলেন। এক কারখানার চৌকিদার রোজ রাতে নানা রকম বিচিত্র স্বপ্ন দেখেন। দুপুরে কারখানার শ্রমিক-মজুরদের সে সব গল্প শোনান। খেটে খাওয়া মানুষগুলো মজার গল্প শুনে হেসে গড়িয়ে পড়েন। কিছু ক্ষণের জন্য হাড় ভাঙা খাটুনির কষ্ট ভুলে থাকেন। এক দিন কারখানার মালিকও সেই গল্প শুনলেন। তিনিও শ্রমিক-মজুরদের মতোই মজা পেলেন। সবাইকে গল্প শুনিয়ে আনন্দ দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে চৌকিদারকে বোনাস দিলেন। তার পর তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন। কারণ চৌকিদারের দায়িত্ব ছিল রাতে পাহারা দেওয়া। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা নয়। স্বপ্নের কথা শোনানোটাও নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement