রাস্তা খোলা পাওয়ার অধিকার

লম্বা, রাস্তাজোড়া মিছিল হয়তো রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা বোঝায়, কিন্তু মানুষ বড় অসহায়, অক্ষম বোধ করে।

Advertisement

মৌ ঘোষ

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
Share:

স্কুল ছুটির পরে বাসে উঠেই বছর আটের মেয়েটির বায়না, ‘‘খিদে পেয়েছে।’’ মা বললেন, ‘‘বাড়ি গিয়ে ভাত খাবি।’’ তিনি তো জানেন না, মিনিট চল্লিশের রাস্তা পেরোতে সে দিন লাগবে দেড় ঘণ্টা। মেয়েটি খিদেয় কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ল, মায়ের মুখ পাংশু। উপায় কী, শহরে মিছিল চলছে।

Advertisement

অফিস টাইমে মিছিল বার করলে ক্ষুব্ধ হন কর্মীরা, তাই হয়তো একটু বেলা করে মিছিল বার করে দলগুলো। তখন বেশির ভাগ খুদে পড়ুয়াদের ভিড় বাসে। ক্লান্ত চোখগুলি বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠছে। অনেকের বোতলে জলও শেষ। বাস থেকে নেমে জল কিনে দেওয়ার উপায় নেই মায়েদের। একটি গাড়ির গা ঘেঁষে দাঁড় করানো আর একটি গাড়ি। রাস্তায় নামারও জো নেই।

লম্বা, রাস্তাজোড়া মিছিল হয়তো রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা বোঝায়, কিন্তু মানুষ বড় অসহায়, অক্ষম বোধ করে। মাঝেমধ্যেই বাসে উঠলে শুনতে হয় ‘‘লম্বা মিছিল। বাস এখন যাবে না।’’ চালকেরাও যে খুব খুশি মনে এ কথা বলেন তা নয়। তাঁরাও বিরক্ত। এক চালক সে দিন বললেন, ‘‘এমন লম্বা মিছিল না করলে এঁরা কি ভোট পাবেন না?’’

Advertisement

সময় নষ্টের সঙ্গে রয়েছে টাকা নষ্ট। তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর তাগিদে শিয়ালদহ থেকে ট্যাক্সি ধরে হেস্টিংস যাওয়ার পথে গাড়ি থমকে গেল। রাজনৈতিক দলের মিছিল বেরিয়েছে। সব রাস্তা বন্ধ। প্রায় ঘণ্টা খানেক গাড়ির মধ্যেই বসে থাকা, এ দিকে সমানে উঠে যাচ্ছে ট্যাক্সির মিটার। নামার উপায় নেই। নেমেই বা যাব কোথায়? নানা দিক থেকে কানে আসছে, সব রাস্তাই বন্ধ।

ট্রেনের যাত্রীরা নাজেহাল হচ্ছেন আরও বেশি। মেডিক্যাল কলেজে এক তরুণী জানালেন, এক রাজনৈতিক দলের সমাবেশের দিন তাঁর মাকে হাসপাতালে দেখানোর ডেট পড়েছিল। সে দিন কৃষ্ণনগর থেকে ট্রেন ধরতে গিয়ে ভিড়ে উঠতে পারেননি। ফের আসতে হল আর এক দিন, এর জন্য দু’দিন অফিস ছুটি নিতে হয়েছে। বেতনও কাটা পড়বে। এমন মিছিল-মিটিং থাকলে সাতসকালে বেরিয়েও তাঁরা ট্রেনে জায়গা পান না। ভিড় অসহ্য মনে হলে বাড়ি ফিরে যান। সমস্যায় পড়ে স্কুলপড়ুয়ারাও। বেসরকারি স্কুল উপস্থিতি নিয়ে খুব কড়া। যেমন করে হোক কলকাতায় এসে পড়ে, শেষে যাওয়ার সময়ে নাজেহাল হন অনেকে। ট্রেনে-বাসে ওঠা যায় না, অ্যাপ ক্যাব চলে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। বেলঘরিয়া, শ্যামনগর, দুর্গানগর, বিরাটি থেকে শিয়ালদহের স্কুলে পড়তে আসে যে শিশুরা, তাদের কাছে মিছিল বিভীষিকা।

এর সঙ্গে রয়েছে নানা ধর্মের মিছিল। কলকাতা পুলিশের নিয়ম, রাজনৈতিক বা সামাজিক কর্মসূচির অধিকার আইনস্বীকৃত। তাই আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা না থাকলে মিছিল আটকানো যায় না। শহরে মিছিলের জন্য নির্দিষ্ট কিছু রাস্তা বা রুট আছে। সেই রাস্তা দিয়ে মিছিল হয়। যানজট সামাল দিতে গাড়ি ঘুরপথে করে দিতে হয়। এ সবই পুলিশকর্তারা তাঁদের বিবেচনা অনুসারে করেন।

মুশকিল হল, পথচলতি মানুষের কাছে এর কোনওটারই আগাম খবর থাকে না। তাই বাসে-ট্রেনে বসে বসে লোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পড়ুয়ারা পৌঁছতে পারছে না স্কুলে। ট্রেন মিস হয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় না বেরোলে সাধারণ মানুষ জানতে পারেন না যে, রাস্তা বন্ধ। কখনও রাস্তা জুড়ে মিছিল। কখনও রাস্তা আটকে পুজো। উল্টে গাড়ির চালকের উপরেই পাড়ার দাদারা তর্জন-গর্জন করেন। ‘‘দেখছেন না বাঁশ পড়ে রয়েছে, প্যান্ডেল হচ্ছে? এ রাস্তায় ঢুকলেন কেন?’’ ঠিকই, রাস্তা তো চলাচলের জন্য নয়। যদি কখনও অবাধে যাওয়া-আসা করা যায়, তা নেহাত ভাগ্যজোরে।

কলকাতা বরাবরই মিছিল-মিটিংয়ের শহর, পুজোর শহর। কিন্তু দুটোই যেন আগের চাইতে সংখ্যায় অনেক বেশি, চলেও অনেক দিন ধরে। গণেশ পুজো থেকে শুরু করে জগদ্ধাত্রী পুজো, ইদের ইফতার থেকে মহরমের মিছিল, রাস্তা না আটকালে কোনওটাই সম্পন্ন হয় না। অতএব বাসে-ট্যাক্সিতে আটকে বসে থাকো, নইলে মাঝরাস্তায় নেমে হাঁটো। হাঁটতে হাঁটতে হিসেব কষতে হয়, কতগুলো দিন রাস্তা বন্ধ পেয়েছি ছেলেবেলায়? কিংবা দশ-পনেরো বছর আগে? আর কতগুলো দিন রাস্তা বন্ধ থাকে আজ? পুলিশ-প্রশাসন যখন অনুমতি দেয়, তখন কি কেবল ধর্মের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতাই বিচার করে? নাগরিকের পথ চলার স্বাচ্ছন্দ্য কি বিবেচনা করা হয় না?

সম্প্রতি একটি পরিবারের সদস্যরা যাচ্ছিলেন উত্তর কলকাতার একটি শ্মশানে। সে দিন জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জনের উৎসব। পিতার মৃতদেহ কাচের গাড়িতে, সেটির জন্য রাস্তা ছেড়ে দিলেও, পিছনের গাড়িকে ছাড়তে নারাজ পুজোর কর্তারা। উন্মত্ত নাচ চলছে ডিজে বক্সের কান-ফাটানো গানের সঙ্গে। তার মধ্যে আটকে রয়েছে পরিবারের শোকার্ত মহিলাদের গাড়ি। ঠিক সময়ে শ্মশানে পৌঁছতে না পারা, শেষ দেখা দেখতে না পারার উদ্বেগে তাঁরা অস্থির হয়ে উঠছেন। শেষ অবধি শ্মশান থেকে প্রায় আধ ঘণ্টার দূরত্বে নেমে তাঁরা হাঁটতে শুরু করলেন। এই কি ধর্ম? এর অনুমতি কি সত্যিই দেয় সমাজ?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement