প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনী সভা করতে ঘন ঘন আসছেন পশ্চিমবঙ্গে। রাজ্যবাসী শুনছে একের পর এক ভাষণ। আর আমার মতো অনেকেরই হয়তো খটকা লাগছে শুনে, যে মোদী কখনও ‘আমি’ বলেন না। বলেন, ‘ইয়ে মোদী নহি করেগা’ কিংবা ‘ইয়ে মোদী হি করেগা’। তাঁর সাক্ষাৎকার পড়লেও দেখা যায়, উত্তমপুরুষে বিশ্বাসী নন তিনি। কথা বলেন প্রথমপুরুষে। অবশ্য মোদী একা নন। অরবিন্দ কেজরীবালও জনসভায় বলেছেন, কেজরীবালই পারেন দিল্লির উন্নতি করতে। রাহুল গাঁধী মঞ্চ থেকে ঘোষণা করেছেন, সমস্যা হলে কেবল রাহুলকে (‘আমাকে’ নয়) ডাকতে হবে। তবে মোদী প্রায় কখনওই ‘আমি’ বলেন না। মনস্তত্ত্বের ছাত্র হিসাবে ব্যাপারটা কৌতূহল জাগায়।
মনস্তত্ত্বে নিজেকে প্রথম পুরুষে সম্বোধন করার অভ্যাসটির পোশাকি নাম ইলেইজ়ম (Illeism)। অনেক ক্ষমতাবান লোকের মধ্যেই এটা দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘ট্রাম্প না থাকলে অবৈধ অভিবাসনের উপর কারও নজরই পড়ত না’, এমন কথা বলা তাঁর দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। ২০১২ সালে তাঁর টিভি-শো ‘অ্যাপ্রেন্টিস’ জনপ্রিয়তায় এক নম্বরে উঠে এলে তিনি টুইট করেন, ‘অভিনন্দন, ডোনাল্ড!’
লাতিন শব্দ ‘ইলে’ (সে) থেকে পাওয়া ‘ইলেইজ়ম’ শব্দটি। এ কোনও মানসিক রোগ নয়, একটা প্রবণতা। ব্যক্তির মনের বা ব্যক্তিত্বের একটা দিক উন্মোচন করে এই প্রবণতা। সে নিজের সঙ্গে একটা দূরত্ব সৃষ্টি করতে চায়। যখন কারও আত্মবিশ্বাস টলমলে হয়ে পড়ে, নিজের ক্ষমতা, শক্তিমত্তা নিয়ে ধন্দে পড়ে যায়, তখন সেই ভীতি, উদ্বেগ, সংশয় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সেই অনুভূতিগুলি থেকে সে একটা দূরত্ব তৈরি করার তাগিদ অনুভব করে। নেতিবাচক মনোভাব থেকে একটা ব্যবধান তৈরি করতে পারলে প্রকাশ্যে আত্মপ্রত্যয়ী ভাবমূর্তি তুলে ধরা সহজ হয়। জনসমক্ষে ভীতি, উদ্বেগের লেশমাত্র আর দেখা যায় না। দেখানো যায় কেবল আত্মসন্তুষ্টি, কথায় উৎসাহের ব্যঞ্জনা, আশাবাদের প্রাবল্য।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
সমস্যাটা আরও একটু জটিল যখন গবেষকরা এর সঙ্গে আত্মপ্রেমের (নার্সিসিজ়ম) যোগ খুঁজে পান। আত্মপ্রেমীরা আত্মবিশ্বাসী হওয়ার জন্য সব সময় ঘটনার কেন্দ্রে থাকতে চায়। ফলে চাটুকার-পরিবৃত হয়ে থাকতে পছন্দ করে। এই ধরনের লোকেরা সর্বদা নিজের প্রতি ‘স্পেশাল’ ব্যবহার সেবা আশা করে, আর যে কোনও সঙ্কট বা সমস্যার জন্য অন্যদের দায়ী করে। যে আত্মপ্রেমী, সে যে ‘ইলেইস্ট’ হবেই, এমন কোনও তত্ত্ব নেই, তবে এর মিশ্রণ যে পাওয়া সম্ভব, সে সম্ভাবনা মনস্তাত্ত্বিকরা নাকচ করেননি। কারও মতে, ইলেইজ়ম দেখা যায় সেই সব ক্ষেত্রে, যেখানে আত্মপ্রেমের ক্ষতগুলিতে প্রলেপ লাগানোর জন্য একটা আত্মগর্বিত মিথ্যা ‘আমি’ (সেল্ফ) নির্মাণের চেষ্টা চলে। যে সে চেষ্টা করছে, তার প্রকৃত আত্মন্ আসলে ভঙ্গুর।
নাটকে, চিত্রনাট্যে ‘ইলেইজ়ম’ ব্যবহার করা হয় এমন চরিত্র আঁকতে, যে নিজের ভাবমূর্তিকে নিজের চাইতে বড় করে তুলেছে। শেক্সপিয়র তাঁর জুলিয়াস সিজ়ার নাটকে যেমন সিজ়ারের মুখে প্রথম পুরুষে সংলাপ বসিয়েছেন। তাঁর উপর আক্রমণ হতে পারে জেনেও সিজ়ার সেনেট না গিয়ে থাকতে পারছেন না, কারণ ‘বিপদ জানে, সিজ়ার তার চাইতেও বিপজ্জনক।’ অলিভার স্টোনের ‘নিক্সন’ ছবিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে যখন তাঁর এক সঙ্গী পরামর্শ দেন, মার্কিন সেনাদের গুলিতে মৃত যুদ্ধবিরোধী ছাত্রদের পরিবারকে সমবেদনা জানাতে, তখন নিক্সনের উত্তর, ‘আমি সহানুভূতি জানাতেই চাই, কিন্তু নিক্সন তা পারেন না।’ শিল্পী সালভাদর দালি, ফ্রান্সের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গল, ভূতপূর্ব রুশ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ, অনেকেই এ ভাবে নিজেকে বোঝাতে নিজের নাম বলেছেন।
নরেন্দ্র মোদীর জীবন সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়, তাতে আন্দাজ করা যায় যে তা এক সাধারণ, নিম্নবিত্ত জীবন থেকে ক্রমিক উত্থানের কাহিনি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং ভারতীয় জনতা পার্টির মধ্যে বহু বাধা অতিক্রম করে তিনি উচ্চপদে এসেছেন। রাজ্যে এবং জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধীদের উপরে সম্পূর্ণ আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছেন। তাঁর ধারণার অনুকূল নয়, এমন সব ভাবনাকেই নাকচ করার চেষ্টা করেছেন। এমন ব্যক্তির অন্তরে উদ্বেগ ও আশঙ্কা থাকাই স্বাভাবিক। বলা বাহুল্য, তাঁর মনকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে পরীক্ষা না করে যথার্থ কারণ বোঝা সম্ভব নয়।
তবে অনেকে মনে করেন, নিজের নাম নিজে বলা বিপণনের কৌশল। ট্রাম্প একাধারে ব্যক্তি এবং ব্র্যান্ড। অনেক বড় বড় হোটেল, ক্যাসিনো, আবাসন তৈরি করেছে তাঁর কোম্পানি, তার সবগুলির মাথায় জ্বলজ্বল করে ‘ট্রাম্প’ শব্দটি। তিনি নিজেই যে একটি ব্র্যান্ড, তা মনে করাতেই ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে প্রথম পুরুষে সম্বোধন করেন। হয়তো মোদীও তাই করেন। তিনি যে ভারতের অনেক দলের একটি দলের, অনেক নেতার একজন নেতা নন, তিনি বিশিষ্ট, অবিকল্প, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, কারণ তিনি মোদী, এ কথা মনে করাতেই তিনি নিজেকে ‘মোদী’ বলেন।
কোনটা সত্য? মোদী কি ইলেইজ়ম-প্রবণ, না কি বিপণন বিশারদ? তা বোঝা যেত যদি জানা যেত তিনি নিজের সঙ্গে কথা বলার সময়েও নিজেকে ‘মোদী’ বলেন কি না। কিন্তু ক্ষমতাবানের স্বগতোক্তি কে আর শুনতে পায়।