এরও বাড়া যে ক্ষতি হতে চলেছে

একই সঙ্গে নিশ্চয় দেখব কোন পক্ষ কতটা অনিষ্ট করেছে বা করতে পারে। এ পরীক্ষায় কেউ ভাল নম্বর পাবে না, হয়তো উন্নয়নখাতের চেয়ে কমই পাবে।

Advertisement

সুকান্ত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০২
Share:

ভারতীয় ভোটার। ফাইল চিত্র।

আমাদের দেশের রাজনীতিতে, বিশেষ করে নির্বাচনী মরসুমে বহু অনাচার চলতেই থাকে। এ বিষয়ে কিছু কথা বলা হয়েছে এই লেখার প্রথম পর্বে (‘নকলটাই হয়ে দাঁড়ায় আসল’, ১৭-৪)। আমাদের পোড়া কপাল, দেশের কোনও দলকেই খোলা মনে নৈতিক সমর্থনদানের জো নেই। ভোট দিতে পারি, কিছু সুবিধা পেতে পারি, অমুক নেতা বা নেত্রীর মুগ্ধ অনুগামী হতে পারি, কিন্তু সেই সঙ্গে বলি, হ্যাঁ, অমুক অমুক অপকীর্তি তো তাঁরা করতেই পারেন, রাজনীতি বলে কথা। মোহ নিয়ে তর্ক চলে না, যেমন চলে না হুমকি-হামলার বিরুদ্ধে। এত কিছুর পর যদি বিচারবুদ্ধি খাটিয়ে সত্যিই স্বাধীন ভাবে ভোট দিতে পারি, অবশ্যই হিসাব করব কোন দল কী কী উপকার করেছে বা করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। যা-ই বলি, উপকার ও উন্নয়ন যথেষ্ট হয়েছে ও হচ্ছে, সব আমলেই অল্পবিস্তর হয়, তার একটা কাঠামোও গড়ে উঠেছে গত সত্তর বছরে— সেটা স্বীকার না করা অন্যায় হবে। কিন্তু সব সময় খেয়াল থাকে না কোনটা যথার্থ মঙ্গল আর কোনটা ফাঁকা দাবি, স্তোকবাক্য বা আবেগে সুড়সুড়ি— হয়তো এমন আবেগ যা উস্কে দিচ্ছে বিভেদ-হিংসা-প্রতিহিংসা, ঘরে-বাইরে যুদ্ধু-যুদ্ধু খেলা। আর ওই যে উন্নয়নসাধনের কাঠামো, গরম বুলির ছেঁকায় সেটাও কি ধ্বংসের উদ্যোগ হচ্ছে?

Advertisement

একই সঙ্গে নিশ্চয় দেখব কোন পক্ষ কতটা অনিষ্ট করেছে বা করতে পারে। এ পরীক্ষায় কেউ ভাল নম্বর পাবে না, হয়তো উন্নয়নখাতের চেয়ে কমই পাবে। ভাল কাজগুলোও যেন সম্পন্ন হয়েছে ক্ষমতাবানের দম্ভের দান হিসাবে, প্রশাসন কাঠামোর বিপর্যয় ঘটিয়ে, সমাজকে অশান্ত অসুস্থ করে, সুশাসন নয় স্বৈরাচারের প্রকাশ হয়ে। তবু স্তরভেদ আছে। ক্ষতি তো সবাই করছে, তার গভীর অলক্ষ্য মাত্রা হয়তো প্রাপ্তিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে বহু ক্ষেত্রে। শেষ মাপকাঠি তাই নিদারুণ সিনিকাল এক বিচার— কখনও সুযোগ এলে কোন ক্ষতি কতটা পূরণ বা শোধন করা যাবে, কোনটা কত দূর ‘রিভার্সিবল’।

এক ডাক্তার বন্ধুর কাছে শুনেছি, বিরল গ্রুপের রক্তের মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে তাঁরা কখনও জেনেশুনে সংক্রামিত রক্ত প্রদান করেন— আগে তো প্রাণটা বাঁচুক, সংক্রমণ পরে সামলানো যাবে। আমাদের ‘বডি পলিটিক’-এর অবস্থা তথৈবচ। ‘নিছক’ দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়ন যে সব দলের সব কাজের অনুষঙ্গ, সেটা আমরা মেনে নিয়েছি; অন্য রকম দেখলে ভাবি দলটা দুর্বল, এদের সমর্থন করা মানে ভোট নষ্ট। শাসনের এই ‘ডিফল্ট মোড’-এ সমাজ তথা রাষ্ট্রের কাঠামো এমনিতেই যথেষ্ট ঢিলে হয়ে পড়েছে; বাকি যে হিসাব, তা হল— গভীর গাঠনিক স্তরে এরও বাড়া কী ক্ষতি হতে চলেছে।

Advertisement

এই গূঢ় স্তরে আমাদের মৌলিক সাংবিধানিক অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। বিপদটা কতটা কাটিয়ে ওঠা যায়, বা অন্তত ঠেকিয়ে রাখা যায়, তা স্থির করবে বর্তমান নির্বাচন। পারি আর না পারি, প্রতিবাদ করার, দাবি জানাবার একটা সুযোগ আজও আমরা উপভোগ করি, এত স্বাভাবিক ভাবে যে খেয়ালই হয় না। (কাশ্মীর বা উত্তর-পূর্বের নাগরিকরা একমত নাও হতে পারেন।) যতই সমস্যা হোক, আজও জনজীবনের অধিকাংশ প্রক্রিয়ার একটা নির্দিষ্ট বিধি আছে, নেহাত স্বৈরাচারী নির্দেশে চলে না। আজও রাষ্ট্রের হাল সম্বন্ধে বহু তথ্য জানতে পারি, পত্রিকায় বা সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা করতে পারি, লাভ হোক না হোক। শেষ অবলম্বন হিসাবে আছে— অতি দূরস্থ, অতি মহার্ঘ, অতি ভীতিপ্রদ, তবু আছে— উচ্চ আদালতের বিধান। গণতন্ত্রের এ সব আশীর্বাদ সত্যিই কি আমরা পরিত্যাগ করতে রাজি?

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

এখানেই ওঠে সর্বশেষ, সবচেয়ে মর্মান্তিক প্রশ্ন। মর্মান্তিক, কারণ প্রশ্নটা নিজেকেই করতে হয়। সচ্ছল শহুরে শিক্ষিত গোষ্ঠীর মজ্জাগত বিশ্বাস, কোনও অবস্থাতেই কোনও গুরুতর সমস্যা ‘আমাদের’ হবে না; হবে ‘ওদের’ অর্থাৎ আমাদের বৃত্তের বাইরের জনজাতি, প্রত্যন্ত প্রদেশের বাসিন্দা, আর অবশ্যই সেই চিরাচরিত ‘ওরা’ অর্থাৎ গরিব-গুর্বো। ‘আমাদের’ চৌহদ্দির কেউ ফ্যাসাদে পড়লে পড়বে ঠোঁটকাটা ঝামেলা-পাকানো বেকার প্রতিবাদীর দল। বাকি সব ‘আমরা’ স্ত্রীপুত্রকন্যা, ফ্ল্যাট-মারুতি-গ্যাজেটসম্ভার নিয়ে শক্ত ডাঙায় নিরাপদে আছি। ইএমআই বা স্কুলের খরচ নিয়ে নালিশ করতে পারি, কিন্তু যে সরকারই আসুক আমাদের তেমন ক্ষতির ভয় নেই; জবরদস্ত কেউ এলে বরং আয়কর দু’পয়সা কমতে পারে, গরিবগুলোও একটু শাসনে থাকে।

একটা স্বতঃসিদ্ধ সত্য আমরা ভুলে থাকতে বদ্ধপরিকর— ব্যাপক অসাম্য-ক্ষোভ-অনাচার-স্বৈরাচারের মধ্যে কোনও মন্ত্রবলে নিরুপদ্রব জীবনযাপনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। নিজেদের স্বার্থেই তাই পরের মঙ্গলের কথা একটু না ভাবলে নয়। নইলে এক দিন দেখব, কাজের মাসির ছেলেটার মতো আমাদের সন্তানও কর্মহীন, ট্রাম্প সাহেবের দৌলতে বিদেশের রাস্তাও বন্ধ। দেখব, আমাদের এক টাকার জায়গায় যাদের কোটি টাকার সংস্থান, সেই অকল্পনীয় ভাগ্যবানদের হিতার্থে আমাদের ইএমআই-এর বোঝা সত্যিই দুঃসহ হয়ে উঠেছে। দেখব, নিরীহ নির্বিরোধ জীবনযাপন করেও দুর্বৃত্তের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছি না, বরং সে জন্যই বেশি করে তাদের শিকার হচ্ছি। সেই সঙ্গে ব্যাপক বঞ্চনা ও হতাশার ফলে বৃহত্তর সমাজ নতুন-নতুন বিধ্বংসী আন্দোলনে উদ্বেল হচ্ছে, হাজার জোর খাটিয়েও বাগে আনা যাচ্ছে না।

মানতেই হবে, সুখশান্তি সুনিশ্চিত করতে এটা কোনও ভাল ফর্মুলা নয়। তার চেয়ে ঢের সোজা এখনই একটু ভাবনাচিন্তা করা, জানালার বাইরে আর নিজের মনের অন্দরে তাকিয়ে দেখা, যেটুকু লেখাপড়া শিখেছি তা দিয়ে বাস্তব তথ্যতল্লাশ করা, এবং ভীতির অশেষ সত্যিকারের কারণ ছাপিয়ে আলস্যের অজুহাত হিসাবে কোনও মনগড়া ভয় না সৃষ্টি করা।

এটা বড্ড নীতিকথার মতো হয়ে গেল। তার বদলে কাঁচা বাস্তবকে অবশ্যই শিরোধার্য করা যেতে পারে। তার দাবি কিন্তু দিন দিন বেড়েই চলবে। যতই নিজেদের সর্বংসহা মনে করি, সেই চাপ সইবার ক্ষমতা আমাদের আছে তো?

(শেষ)

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement