ভোটের লাইনে মহিলারা। ফাইল ছবি
আজ ভোট। গণতান্ত্রিক উৎসবের দিন। এই ভোটের প্রচারে নিয়ে নানা বিষয় উঠে এসেছে। বিতর্ক হয়েছে। কথা হয়েছে মহিলাদের উন্নয়ন নিয়েও। তাঁদের জন্য নেওয়া নানা কর্মসূচির কথা প্রচারে এসেছে। এটা জরুরি। গণপরিসরে এই কথাগুলি যত উঠে আসে, ততই মঙ্গল। কারণ, আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়ে নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষ সমানাধিকার, পুরুষ নারীর সমানহারে বেতনের মতো বিষয় নিয়ে কথা বললেও সত্যিই কি মেয়েরা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত ও নিরাপদ? সাম্প্রতিক বিশ্বে ক্রমে বেড়ে চলা নারী নির্যাতনের ঘটনা বা কর্মজগতে ‘মিটু’-র মতো আন্দোলনের দিকে চোখ রাখলে এ কথা বোধহয় নিশ্চিত ভাবে বলা চলে যে নারীকে আমরা আজও ‘অর্ধেক আকাশ’ করে তুলতে পারিনি। ২০১১ সালের জনগণনার ‘সেক্স রেশিও’ বা ‘নারী-পুরুষ অনুপাত’-এর দিকে চোখ রাখলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, আমাদের দেশে নারী পুরুষের সংখ্যার অনুপাতে নারী এখনও পিছিয়ে। অর্থাৎ পুত্রের থেকে কম সংখ্যক কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করছে। অনেকেই মনে করেন, এর অন্যতম কারণ, অবশ্যই ‘কন্যাভ্রূণ হত্যা’। আজও আমাদের দেশে অনেক পরিবারেই কন্যাসন্তান মানেই অনাদরের, উপেক্ষার। সময় বদলালেও সমাজের মানসিকতায় এখনও বদল আসেনি। তাই আমরা দেখি, কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার পরে, আজও বহু মাকে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়।
ভারতে কন্যাসন্তান হত্যার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। কন্যাভ্রূণ হত্যার পিছনে বেশ কয়েকটি সামাজিক কারণকে দায়ী করা হয়ে থাকে। যেমন, দারিদ্র, পণপ্রথা, শিক্ষার অভাব ইত্যাদি। এর মধ্যে বিশেষ ভাবে বলতে হয় বর্ণাশ্রম ও পণপ্রথার কথা। আজও আমাদের দেশ থেকে পণপ্রথার অভিশাপ পুরোপুরি ঘোচেনি। ফলে কন্যাসন্তান জন্মানো মাত্রই প্রচুর যৌতুক দিয়ে তাকে পরের হাতে তুলে দিতে হবে এই ধারণায় অনেক পরিবারই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এর সঙ্গে বিপদ বাড়িয়েছে জন্মের আগেই শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণের মতো প্রযুক্তির আবির্ভাব। এই পদ্ধতি বাজারে আসার পরে দেখা গিয়েছিল, অনেক ক্ষেত্রে সন্তানের জন্মের আগে লিঙ্গ নির্ধারণ করে, সেই সন্তান যদি মেয়ে হয় তাকে ভ্রূণ অবস্থাই হত্যা করা হয়। পরে সরকারি হস্তক্ষেপে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও লুকিয়ে চুরিয়ে কন্যাভ্রূণ হত্যার কাজ চলছেই। এমনকি, এর জন্য আরও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২০১৭ সালে ভারতে মোট ছ’লক্ষ শিশু ভ্রূণ নষ্ট করা হয়েছে, যার বেশির ভাগটাই ছিল কন্যাভ্রূণ।
এর জেরে আমাদের সমাজে স্ত্রী-পুরুষ অনুপাতের বিপজ্জনক পরিবর্তনের পাশাপাশি, জন্মের পরেও যে কন্যাসন্তানেরা খুব ভাল আছে এমনটা বলা যাবে না মোটেও। সাম্প্রতিক কয়েকটি পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, ৩১.৬ শতাংশ মেয়ের বিবাহ হচ্ছে নাবালিকা অবস্থায়। সাত শতাংশ মেয়ে পনেরো বছর বয়সে গর্ভবতী হচ্ছে। আবার দেশের মোট বিবাহিত মহিলার মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ উনিশ বছর বয়সের মধ্যে সন্তানের জননী হচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিবাহের হার সব থেকে বেশি লক্ষ করা যায় মালদহ, বীরভূম, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ (৬৬ শতাংশ), দক্ষিণ দিনাজপুর পুরুলিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে (৬২ শতাংশ)। পরিসংখ্যান আরও বলছে, এই রাজ্যে ১১.২ শতাংশ মেয়ে ১৮ বছরের আগে প্রথম সন্তানের জন্ম দিচ্ছে। তার মধ্যে ৩১ শতাংশ ক্ষেত্রে সন্তান ও মায়ের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে প্রতি হাজার জন পুরুষে নারীর সংখ্যা বর্ধমানে ৯৪৫, কলকাতায় ৯০৮, দার্জিলিঙে ৯৭০। ভারতবর্ষে প্রতি হাজার পুরুষে নারীর সংখ্যার অনুপাতে সবার আগে রয়েছে কেরল। সেখানে প্রতি হাজার পুরুষে নারীর অনুপাত ৯৬৬ এবং সর্বনিম্ন হার হরিয়ানায়। সেখানে প্রতি হাজার পুরুষে নারীর অনুপাত ৮৫৭।
কন্যাভ্রূণ হত্যা কমাতে সরকারের তরফে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ করা হয়েছে। মেয়েদের পড়াশোনায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য সরকারের তরফে রাজ্যে কন্যাশ্রী, কেন্দ্রের ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ প্রভৃতি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সন্তান ও মায়ের জন্য নেওয়া হয়েছে নানা প্রকল্প। সরকারের পাশাপাশি, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও নারীদের অধিকারকে সুরক্ষিত রাখতে এগিয়ে এসেছেন। তাঁদের উদ্যোগেও মেয়েদের স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তাই আজকের প্রজন্মের মা-বাবাকে সবার আগে এ কথা বুঝতে হবে, উপযুক্ত পরিবেশ পেলে মেয়েও পরিবারের হাল ধরতে পারে। কন্যারাও দেশের ভবিষ্যৎ। তারা সুরক্ষিত না থাকলে দেশের ভবিষ্যত সুরক্ষিত হবে না। আর এ জন্য, রাজনৈতিক দলগুলিকে আরও বেশি করে মেয়েদের সমস্যার কথা তুলে ধরতে হবে।
বিসিডিএন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক