নির্বাচনে নিবেদন

স্কুলশিক্ষা ব্যাহত করিয়া নির্বাচন দেখিতে দেশবাসী অভ্যস্ত। কিন্তু অভ্যস্ততা অনৈতিকতার কোনও হেতু হইতে পারে না, তাই প্রতিবাদ করিবার সময় আসিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৯ ০০:৫৫
Share:

নির্বাচন করিতে হইলে কি শিক্ষার অধিকার নস্যাৎ করিতে হয়? প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনের পূর্বেই কেন্দ্রীয় বাহিনী আসিয়া বিদ্যালয়ের ভবনগুলিকে দখল করে, স্কুল ছুটি ঘোষণা করিতে হয়। এই বার সঙ্কট কিছু তীব্র হইয়াছে দুইটি কারণে। এই বৎসর সাত দফায় নির্বাচন হইবে রাজ্যে, সময় লাগিবে এক মাসেরও অধিক। অতএব স্কুলদখলের মেয়াদ আরও দীর্ঘ দিন চলিতে পারে। কেন এই অব্যবস্থা? শিক্ষার অধিকার আইন পাশ হইয়াছিল ২০০৯ সালে। তাহার পর দ্বিতীয় বার সাধারণ নির্বাচন ঘোষিত হইল। মাঝে বেশ কিছু বিধানসভা ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন গিয়াছে। প্রতি বারই স্কুল দখল হইয়াছে, শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হইয়াছে। নির্বাচন কমিশন শিশুর মৌলিক অধিকার উপেক্ষার ধারাবাহিকতা বজায় রাখিয়াছে। বস্তুত এই বৎসরটি লজ্জার দশকপূর্তি। ভারত যেন ভুলিয়াছে, শিক্ষাকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিবার অর্থ কেবল বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করিবার প্রকল্পে টাকা বরাদ্দ করা নহে। সেই সকল ভবনে পঠনপাঠন অব্যাহত রাখিতে হইবে, শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ গড়িতে হইবে। কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্য তাহা ভুলিয়াছে। তাই নির্বাচন আসিলে সর্বাগ্রে বিদ্যালয়গুলিকে সেই কাজে নিবেদিত করিয়া দেওয়া হয়। এই বৎসর নির্বাচনের কাজ হইতে শিক্ষকদের অব্যাহতি চাহিয়া নির্বাচন কমিশনের নিকট আবেদন করিয়াছিল নীতি আয়োগ। উত্তর আসিয়াছে, মতামত নিষ্প্রয়োজন, সিদ্ধান্ত লইবার অধিকার কমিশনের। গত বৎসর একটি সমীক্ষায় প্রকাশ, নির্বাচনী প্রস্তুতি, টিকাকরণের প্রচার এবং হিসাবরক্ষায় শিক্ষকদের অধিকাংশ সময় ব্যয় হইতেছে।

Advertisement

স্কুলশিক্ষা ব্যাহত করিয়া নির্বাচন দেখিতে দেশবাসী অভ্যস্ত। কিন্তু অভ্যস্ততা অনৈতিকতার কোনও হেতু হইতে পারে না, তাই প্রতিবাদ করিবার সময় আসিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের স্কুলগুলিতে অন্তত দুই শত বাইশ দিন স্কুল হইবার কথা। বাহিনী থাকিবার জন্য গত বৎসর পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য দশ হইতে পনেরোটি শিক্ষাদিবস নষ্ট হইয়াছিল। এই বৎসর যদি কোনও স্কুলে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষার কেন্দ্র পড়িয়া থাকে, তৎসহ তাহা নির্বাচনের কেন্দ্রও নির্দিষ্ট হয়, তবে ত্রিশ হইতে পঁয়তাল্লিশ দিন স্কুল বন্ধ থাকিতে পারে। শিক্ষার এই সঙ্কট চোখ এড়াইবার কথা নহে। সমস্যা শুধু পঠনপাঠনে ক্ষতির নহে। নির্বাচনের জন্য হউক, অথবা সন্ত্রাসদমনের জন্য হউক, শিক্ষার প্রাঙ্গণে অস্ত্র প্রবেশ করিলেই তাহার পরিবেশ বদলাইয়া যায়। কাশ্মীর, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, অসম, নাগাল্যান্ড, মণিপুরের স্কুলগুলি তাহার ভুক্তভোগী। আশির দশকে মণিপুরের একটি স্কুল দখল করিয়াছিল সেনা। বহু বৎসর পরে তাহার খেলার মাঠ হইতে আটটি করোটি উদ্ধার হইয়াছে। কাশ্মীরের স্কুলগুলিতে আধাসেনার দীর্ঘমেয়াদি শিবির সেই রাজ্যে নাগরিক অসন্তোষের একটি প্রধান কারণ। বিহার-ঝাড়খণ্ডের স্কুলগুলিতে সেনাশিবির স্থাপন করিবার জন্য স্কুলগুলির উপর বার বার আক্রমণ করিয়াছে মাওবাদীরা।

আজ নির্বাচন ঘিরিয়া হিংসা-সংঘাত কম নহে। তাহার সহিত স্কুলের সংযুক্তি কেন? সংবিধান-স্বীকৃত শিক্ষার অধিকারকে উপেক্ষা করিয়া, বিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা অস্বীকার করিয়া, অবাধে ভোটগ্রহণ করিলেও গণতন্ত্র সুরক্ষিত থাকিবে না। কেন্দ্রীয় বাহিনী কোথায় থাকিবে, জেলা স্তরে তাহা নির্ধারিত হয়। নাগরিক সমাজ ও অভিভাবকদের সংগঠন হইতে জেলা প্রশাসনের নিকট আবেদন করা প্রয়োজন, যাহাতে স্কুলগুলিকে বাহিনীশিবির করিয়া তুলিবার কুপ্রথা বন্ধ হয়। বিকল্পের সন্ধান করিতে হইবে। গণতন্ত্রে ভোটাধিকার বস্তুটি যে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ, তাহা প্রশ্নাতীত। কিন্তু প্রশ্নাতীত বলিয়াই ভোটাধিকারই একমাত্র অধিকার, বাকি সব মায়া, এমন যুক্তি চলিতে পারে না। বরং বলা চলে, প্রথম ভোটটি প্রাপ্য— স্কুলশিক্ষার।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement