ইস্তাহার তো ছাপে, তা কি পড়ে দেখেন ভোটারেরা?

যাদের জন্য এত আয়োজন সেই জনগণ কী ভাবছে? জনগণ কি আদৌ কোনও নির্বাচনী ইস্তাহার নিয়ে মাথা ঘামায়? না কি তাদের ভাবনা শুধুই আমিত্বে সীমাবদ্ধ? লিখছেন শফিকুল ইসলাম ভারতে সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব মিটলেও আর মাত্র তিন সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে বাকি সব ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ০১:১৭
Share:

প্রতীকী ছবি।

ভারতে সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব মিটলেও আর মাত্র তিন সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে বাকি সব ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হয়ে গিয়েছে। তাঁরা নিজ নিজ দল বা জোটের পক্ষে ভোটারদের সমর্থন আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। কিন্তু নির্বাচিত হলে তাঁরা দলগত ভাবে দেশ ও জাতির জন্য কী করবেন, সে সম্পর্কে তেমন কিছু এখনও জানা যায়নি। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলি জনগণের কাছে অনেক প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে। লিখিত ও মুদ্রিত আকারে সেগুলির উপস্থাপন ঘটে নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। এটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনের পথে দলগুলির প্রস্তুতি অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে, সময়ও আর বেশি নেই।

Advertisement

ভোটারেরা কোন দলকে কী প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ভোট দেবেন—গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা একটা স্বাভাবিক ও প্রচলিত কৌতূহলের বিষয়। নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করার আহ্বান জানানো হয়। রাজনৈতিক দলগুলি সে সব আহ্বানে সাড়া দেয়। কখনও কখনও আহ্বান ছাড়াই তারা ভোটারদের মনোযোগ ও সমর্থন আকর্ষণের উদ্দেশ্যে নানা প্রতিশ্রুতি সংবলিত নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ ও প্রচার করে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী ইস্তাহার সম্পর্কে জনসাধারণের আগ্রহ কম। এর কারণ সম্ভবত এই যে দলগুলি নির্বাচনের আগে ইস্তাহারের মাধ্যমে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চায়, নির্বাচিত হওয়ার পর সেগুলি পূরণ করে না। তাদের এই প্রতিশ্রুতিভঙ্গ নিয়মিত চর্চায় পরিণত হয়েছে এবং জনসাধারণ সম্ভবত এই তিক্ত উপলব্ধিতে পৌঁছে গিয়েছে যে রাজনৈতিক দলগুলি ভোটের আগে যত প্রতিশ্রুতিই শোনাক না কেন, ক্ষমতায় গিয়ে তারা সব প্রতিশ্রুতি ভুলে যাবে। এটা একটা হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি। এ ভাবে গণতান্ত্রিক দেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার অগ্রগতি সাধিত হতে পারে না। জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়মিত ভাবে ভঙ্গ করা যদি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়, তা হলে সেই গণতন্ত্রে জনসাধারণ ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে শ্রদ্ধা ও আস্থার সম্পর্ক থাকতে পারে না।

নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ না করার এই নেতিবাচক চর্চা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশের গুরুত্ব আছে। কারণ, প্রতিটি দলের নির্বাচনী ইস্তাহার জনগণের সঙ্গে তাদের লিখিত ও মুদ্রিত চুক্তির মতো একটা বিষয়। এই চুক্তির ভিত্তিতে জনসাধারণ তাদের নির্বাচিত সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি পূরণ করার দাবি তুলতে পারে। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জবাবদিহি চাইতে পারে এবং মেয়াদ শেষে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার বিষয়গুলি বিবেচনায় নিতে পারে।

Advertisement

নির্বাচনী ইস্তাহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি নির্বাচনের পরে পূরণ করা হবে কি না, সেই প্রশ্ন ছাড়াই বলা যেতে পারে, ইস্তাহার প্রকাশিত হলে সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন মাধ্যমে সেগুলি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিছু হয়ও। এর ফলে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে ভোটারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুবিধা হতে পারে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা রাজনৈতিক দলগুলি সমাজের বিভিন্ন অংশের দাবি-দাওয়ার প্রতি সাড়া দিয়ে সেগুলি তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তাহারে জনগণের আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কতটা আছে? একই সঙ্গে এটা প্রত্যাশিত যে, এ সব প্রতিশ্রুতি যেন নিছক কথার কথা না হয়। সরকারে গেলে কী করবে আর বিরোধী দলে থাকলে কী করবে সেই প্রতিশ্রুতিও থাকা প্রয়োজন।

ভারতে সাত দফায় লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে বিজেপি ‘সঙ্কল্প’ নামে আর কংগ্রেস ‘ন্যায়’ নামে তাদের ইস্তাহার প্রকাশ করেছে।

দুই দলের ইস্তাহারের মধ্যে সাদৃশ্য হল, উভয়েই নাগরিকদের ‘নগদ’ অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। কংগ্রেস, বিজেপির মতো অন্য আঞ্চলিক দলগুলিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

নতুন দিল্লির মসনদ দখলের এই লড়াইয়ে এক দিকে বিজেপি‌কে চাপে রেখে অনেক প্রতিশ্রুতি কংগ্রেসের। অন্যদিকে, গত পাঁচ বছরের উন্নয়ন, রামমন্দির নির্মাণ, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, নাগরিকপঞ্জি এবং সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫-এ ধারার অবলুপ্তিকে তুলে ধরেছে বিজেপি।

এখন প্রশ্ন, ৯০ কোটি ভোটারের কত জন তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার আগে রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তাহার খতিয়ে দেখেন? ‌

নানা মাধ্যমে ভোটারের কাছে ইস্তাহার পৌঁছে যায়। আশি-নব্বইয়ের দশকের পরিস্থিতি এখন আর নেই। এখন দলগুলি বুঝে গিয়েছে প্রতিশ্রুতি পালন না করলে পরের বার ভুগতে হবে। যেমন নরেন্দ্র মোদীকে কালো টাকা নিয়ে খোঁচা সহ্য করতেই হচ্ছে। কংগ্রেস কর্মসংস্থান ও কৃষি নিয়ে যে সব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে ক্ষমতায় এলে তাদের সেগুলি করে দেখাতে মরিয়া হতেই হবে। অন্যদিকে, ভারতীয় জনতা পার্টির ইস্তাহারে ছত্রে ছত্রে তুলে ধরা হয়েছে জাতীয়তাবাদ, হিন্দুত্ব ও গত ৫ বছরের উন্নয়নকে। তাদের থিম ‘সংকল্পিত ভারত, সশক্ত ভারত’। গত বাজেটে নরেন্দ্র মোদী সরকার ঘোষণা করেছিল, ২ হেক্টরের কম কৃষিজমির মালিকদের বছরে ৬ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হবে। এ বার ইস্তাহারে আরও একধাপ এগিয়ে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় এলে জমির ঊর্ধ্বসীমা নয়, এ বার সমস্ত কৃষককে বছরে ৬ হাজার টাকা দেবে মোদী সরকার। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের ৬০ বছর বয়সের পর পেনশন দেওয়া হবে। এক লক্ষ পর্যন্ত কৃষিঋণ হবে সুদহীন। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি আরও এক বার উল্লেখ করা হয়েছে। তৃণমূলও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

আবার, নির্বাচনী ইস্তাহার অনেক সময় দলের কর্মীরাই পড়ে দেখেন না। এ ব্যাপারে একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি বোঝা যাবে। উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি ও রাষ্ট্রীয় লোকদলের মধ্যে মহাজোট হয়েছে। কংগ্রেসের ইস্তাহার প্রকাশের কয়েক দিন পর আরএলডি প্রধান তথা মুজফ্‌ফরনগরের প্রার্থী চৌধুরী অজিত সিংহকে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, কংগ্রেসের ইস্তেহারে কী আছে? তিনি জবাব দিয়েছেন, তিনি ইস্তাহার পড়েননি। ভারতে এবার সাধারণ নির্বাচন হবে নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে ও বিপক্ষে। মোদীর বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই হতে চলেছে।

ইস্তাহারে কংগ্রেস দাবি করেছে, তারা ক্ষমতায় এলে প্রস্তুত হবে পৃথক কৃষি বাজেট৷ বোঝাই যাচ্ছে, অন্যান্য বারের মতো কৃষি ও কৃষক এ বার নির্বাচনের বড় বিষয়৷ কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে কংগ্রেসের ইস্তাহারে। মোদীকে কটাক্ষ করে তাঁর বছরে দু’কোটি চাকরির কথা স্মরণ করিয়েছে কংগ্রেস। রাহুল গাঁধীর দাবি, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে প্রথম বছরেই সরকারের বিভিন্ন দফতরে ২২ লক্ষ শূন্যপদ পূরণ করা হবে। সেই সঙ্গে পঞ্চায়েতে আরও ১০ লক্ষ কর্মসংস্থান হবে। যুবকেরা ‘স্টার্ট আপ' ব্যবসা খুলতে চাইলে প্রথম ৩ বছর কোথাও কোনও অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এ ছাড়া মনমোহন সিংহ জমানার ‘মনরেগা' প্রকল্পে ১০০ দিনের কাজ বাড়িয়ে ১৫০ দিন করা হবে৷ ও দিকে, দেশের উত্তর-পূর্বে নাগরিকত্ব বিল ও নাগরিকপঞ্জি দুই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নাগরিকত্ব বিল বিষয়ে অসম-সহ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। বিপুল সংখ্যক মানুষের নাগরিকত্বের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। নাগরিকপঞ্জির তীব্র বিরোধিতা করেছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

কিন্তু যাদের জন্য এত আয়োজন সেই জনগণ কী ভাবছে? জনগণ কি আদৌ কোনও নির্বাচনী ইস্তাহার নিয়ে মাথা ঘামায়? না কি তাদের ভাবনায় শুধুই আমিত্বে সীমাবদ্ধ? অর্থাৎ, আমার ভোট আমি তাকেই দেব যিনি আমার ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন। এটা হতে পারে আমার নিজের বা পরিবারের কোনও সদস্যের চাকরি দেওয়া, ব্যবসায় বৈধ/অবৈধ সহযোগিতা, নিজের সম্পদ সুসংহত করা বা অন্যের সম্পদ/সম্পত্তি ভোগ দখল করতে সহযোগিতা, টেন্ডারবাজি বা বাজারের দখল নিশ্চিত করতে সহযোগিতা ইত্যাদি। কত শতাংশ জনগণ দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে ভোট দেয়?

উল্লেখিত এই সব পরিমাপক যদি অধিকাংশ জনগণ ভোটের সময় বিবেচনা না করে থাকে, তা হলে ধূর্ত কোনও রাজনৈতিক দল কি অতীত কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে আসবেন কখনও? মনে তো হয় না।

রানাঘাট ভারতী উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement