Lockdown in India

জামলো, পায়েল আর সাইউবদের গল্প

বারবার নিজেদেরকে হয়তো আমরা প্রবোধ দিয়েছি যে এত বিপুল জনসংখ্যা, সরকার কী-ই বা করতে পারত? কিন্তু সত্যিই কি তাই?

Advertisement

সুমন সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২০ ১৬:৫৮
Share:

প্রতীকী ছবি

এ যেন এক অনন্ত হাঁটার গল্প। সেই ২৪ মার্চ, যখন দেশজোড়া লকডাউন ঘোষিত হল, তখন থেকে মানুষ হেঁটে চলেছেন। সভ্য, শিক্ষিত সমাজ যাঁদের পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে চেনে।

Advertisement

কেউ কাঁধে বয়স্ক পিতামাতাকে নিয়ে হাঁটছেন, কেউ সন্তানদের কোলে, কাঁখে নিয়ে হাঁটছেন। দেশভাগ পরবর্তীতে এই রকম দৃশ্য আর চোখে পড়েছে কি না, সন্দেহ। যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, প্রায় দুশো মানুষ এর মধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন, কেউ রাস্তায় ক্লান্তিতে, কেউ অসুস্থ হয়ে আবার কোথাও কোথাও ট্রেন বা রাস্তার দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন প্রচুর মানুষ। যে মানুষেরা মালবাহী ট্রেনের তলায় চাপা পড়ে মারা গিয়েছেন, তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন যে, রেললাইনের দূরত্ব সবচেয়ে কম, তাই তাঁরা রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন। ক্লান্ত অবসন্ন দেহ নিয়ে তাঁরা রাতের অন্ধকারে ওই রেললাইনেই শুয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের জানা ছিল না, যে মালবাহী ট্রেন দ্রুতগতিতে ছুটে এসে তাঁদের দেহকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যাবে। থাকলে হয়তো তাঁরা ওই রেললাইনে বিশ্রাম নিতেন না, চিরঘুমে তলিয়ে যেতেন না।

তার পর ধরা যাক জামলো মকদম, যার বয়স ৮ বছর, তেলঙ্গানা থেকে ছত্তীসগঢ় ফিরছিলেন নিজের বাড়িতে। এতটা পথ হাঁটার ধকল সহ্য করতে না পেরে, পথেই মারা যায়, আমাদেরই কন্যাসম, জামলো। কন্যাসম কিন্তু কন্যা তো নয়! তাই হয়তো শহুরে মধ্যবিত্তের মরমে এই মৃত্যু কোনও আলোড়ন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। যে সময়য়ে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে, যে সময়য়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী দূরবর্তী বা অনলাইন শিক্ষার জন্য ‘অর্থনৈতিক’ প্যাকেজে প্রকল্প ঘোষণা করছেন, সেই সময়ে জামলো মকদম বাড়ি ফিরতে পারল না। এই খবরগুলো আজকাল আর আমাদের নাড়া দেয় না, আমাদের বিচলিত করে না। আমরাও ধীরে ধীরে ভুলতে শুরু করি ওদের মুখগুলো, আমরা ভুলে যাই যে শুধুমাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে যদি এ রকম সারা দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষিত না হত, তা হলে হয়তো এই রকম দৃশ্য আমাদের দেশ দেখত না। যদি ন্যূনতম খাবার এবং অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা দেশের সরকার করত, তা হলে কি এই এত মানুষের মৃত্যু মিছিল দেখতে হত?

Advertisement

সারা দেশে করোনায় যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, এই পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু কি তার সঙ্গে সংখ্যাগত ভাবে যুক্ত হবে? হয়তো না। আজ থেকে বহু বছর পর যখন কোনও ঐতিহাসিক এই করোনার সময়ের ইতিহাসকে নথিবদ্ধ করবেন, তখন কি তাঁর জামলোর কথা মনে পড়বে?

আবার ধরা যাক, পায়েলের কথা। বছর বারো বয়স, সে উত্তরপ্রদেশের ফরিদাবাদ থেকে হাঁটতে শুরু করেছিল তার বাবার সঙ্গে। অন্যদের সঙ্গে তার একটাই তফাত, তার একটি পা কৃত্রিম। কিন্তু তা-ও সে শুরু করেছে হাঁটতে, এখনও পৌঁছেছে কিনা জানা নেই। সেও হাঁটছে।

আসলে আমরা যাঁরা শহুরে, তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত বিত্তশালী মধ্যবিত্ত— তাঁরা আজ পরাজিত। আমরা যৌথ ভাবে পরাজিত। আমরা যাঁরা এই নতুন অর্থনীতির সুফল ভোগ করে থাকি, তাঁরা মিলিত ভাবে হেরে গিয়েছি। আমরা যাঁরা শপিং মলে যাই, আমরা আইনক্সে পপকর্ন নিয়ে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হলে সিনেমা দেখে থাকি, সেই আমরা সবাই আজ বিজিত। আমরা এই মানুষদের কাছে হেরে গিয়েছি, যাঁরা এই জায়গাগুলো তিলতিল করে নিজেদের শ্রম দিয়ে গড়ে তুলেছেন, তাঁদের শ্রমের কাছে পরাজিত। আমরা কোনও দিন তাঁদের খোঁজার চেষ্টা করিনি। ভাবিনি যে এই যে ৬ লেনের জাতীয় সড়ক বানানো হয়েছে, তার পিছনে তাঁদের কতটা শ্রম আছে, কতটা ঘাম-রক্ত আছে!

আজকে যখন তাঁরা সেই ৬ লেনের রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, তখন তাঁদের চোখে যে বেদনা, যে ক্লান্তি, যে ক্ষোভ— তা কি আমাদের ছুঁতে পারছে? রাজনৈতিক দলেরা বা নাগরিকেরা যতই করুক না কেন আপনাদের জন্য, তা কি যথেষ্ট? যত খাবারের প্যাকেট বা যত টাকাই তাঁদের কাছে আমরা পৌঁছনোর চেষ্টা করি না কেন, তা কি তাঁদের প্রাপ্য যে সম্মান, তা ফিরিয়ে দিতে পারছে? একজন কর্মক্ষম মানুষ যখন খাবারের জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, তাতে কি তাঁর সম্মান বাড়ছে? না কি আমরা যাঁরা এই খাবার তাঁদেরকে ত্রাণ হিসাবে দিচ্ছি, তাঁদের সম্মান বাড়ছে?

যে উঁচু উঁচু অট্টালিকায় আমরা থাকি, সেখান থেকে নেমে এসে কি তাঁদের সম্পর্কে কোনওদিন আমরা খোঁজ নিয়েছি, যে তাঁদের কোনও একটা ছোট ঘরও আছে কিনা? তাঁদের স্নানের জায়গাটা কতটা স্বাস্থ্যসম্মত, কত জন মিলে একটি স্নানাগার তাঁরা ব্যবহার করেন? আমাদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া পারস্পরিক দূরত্বের নিদান বা শারীরিক দূরত্বের নিদান আদৌ কি তাঁরা পালন করতে সক্ষম?

আমরা যারা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কখনও আলো নিভিয়ে বা থালা বাজিয়ে করোনার চিকিৎসায় যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের উৎসাহ দিয়েছি, তাঁদের কত জন এই পায়েল, জামলো বা ট্রেনের তলায় চাপা পড়া মানুষদের কথা ভেবেছেন? কত জন রাতে ঘুমাতে পারেননি, ওই ট্রেনলাইনে পড়ে থাকা রক্তলাগা রুটির ছবি দেখে? আমরা কত জন সরকারের দিকে আঙুল তুলেছি? যে আঙুলে কালি লাগিয়ে আমরা সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবি দিয়ে প্রমাণ করেছি যে হ্যাঁ, আমরা গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করলাম! তার মধ্যে কত জন মনে করি যে, ওই ছবি দেওয়াটা গণতন্ত্র নয়, বরং সরকারকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করাটাই আসলে গণতন্ত্র?

বারবার নিজেদেরকে হয়তো আমরা প্রবোধ দিয়েছি যে এত বিপুল জনসংখ্যা, সরকার কী-ই বা করতে পারত? কিন্তু সত্যিই কি তাই? সরকার কি সত্যিই অপারগ, না কি তার সদ্দিচ্ছার অভাব? সরকার চাইলে কি এই পরিযায়ী শ্রমিকদের তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারত না? চাইলে কি সরকার এই মানুষদের জন্য প্রাপ্য খাবার এবং টাকার সংস্থান করতে পারত না? এই যে এত বড় কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষিত হল, তা কি এই মানুষদের জন্য, না কি অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে— সেই প্রশ্ন করার কি সময় হয়নি এখনও? আসলে আমরা যাঁদের নির্বাচিত করে সরকারে বসিয়েছি, তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, যে এই সরকারের অভিধানে সহানুভুতি শব্দটা নেই। কিন্তু একটা কথা আমরা ভুলে গিয়েছি— আজকে যাঁরা ওই পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কোনও সহানুভূতি দেখাচ্ছেন না, কাল আমাদের জন্যও তাঁর কোনও ভাবনা থাকবে না আর।

আসুন, একটু মহম্মদ সাইউবের গল্প জেনে নিই।

মহম্মদ সাইউব এবং অমৃত কুমার সুরাটের কাপড় কারখানায় কাজ করতেন। লকডাউনের ফলে দু’জনেরই কাজ গিয়েছে। তাঁরা অনেকের সঙ্গে একসঙ্গে একটি ট্রাকের মাথায় করে ইন্দোরে ফিরছিলেন। পথে এক জায়গায় অমৃতকুমার অসুস্থ বোধ করায় তাঁকে নিয়ে মাঝপথে নেমে পড়েন সাইউব। তাঁর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন অমৃত। সেই ঘুম অনন্ত ঘুম, সেই ঘুম আর ভাঙেনি। জাতীয় সড়কের উপর চলমান অনেককে ডেকে সাহায্য চান সাইউব, কিন্তু কেউ সাহায্য করেননি। কিন্তু বন্ধুকে ছেড়ে যাননি সাইউব। শেষে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন দেখা যায়— অমৃত মারা গিয়েছেন। এক দিকে যখন মুসলমানদের করোনা ছড়ানোর জন্য দায়ী করে দাঙ্গা হচ্ছে, একদিকে যখন দেশের নানা প্রান্তে মুসলমান আনাজ বিক্রেতাদের থেকে আনাজ না কেনার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তখন সাইউব আর অমৃতকুমারের গল্পও নিশ্চিত ভবিষ্যতের কোনও ধারাভাষ্যকার লিখেবেন— এই আশা করাটা কি খুব অন্যায় হবে?

একদিন না একদিন এই লকডাউন উঠবে। আবারও বহু মানুষ গ্রাম থেকে শহরমুখী হবেন। কিন্তু তখনও কি একই অবস্থা থেকে যাবে? না কি তখন অন্তত আমরা দাবি তুলব যে যাঁদের কায়িক পরিশ্রমের সুফল আমরা ভোগ করি রোজ, তাঁদের কথাও ভাবতে হবে সরকারকে। তাঁরা কি আবারও একই অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হবেন কিছু মুনাফাখোর দালালদের সুবিধার্থে, না কি তাঁরাও তাঁদের প্রাপ্য সম্মান ফিরে পাবেন আমাদের দাবির জোরে?

লেখক বাস্তুকার ও সমাজকর্মী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement