শারদীয়া দেশ।
সারা বিশ্বেই এই ঘটনা নজিরবিহীন। কোনও এক প্রদেশের প্রধান ধর্মীয় উৎসবকে (অধুনা দুর্গাপুজা ও ইদ, দুয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য) ঘিরে সাহিত্য রচনা ও প্রকাশের এ হেন বিপুল উদ্ভাসের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে এই বঙ্গদেশ ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। বাঙালি (নবজাগরণের আলোকপ্রাপ্ত) চিরকালই মননের চোখ দিয়েই জীবনকে দেখতে চেয়েছে। সে কোনও দিনই সে অর্থে যোদ্ধার জাত ছিল না, ছিল না ব্যবসায়ীর জাতও, মননশীলতার এক সমুন্নত ঐতিহ্য ও নিরন্তর চর্চাই তার সামগ্রিক যাপনের সব চেয়ে বড় অর্জন। এ-ও এক বিরল দৃষ্টান্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামক এক জন কবি ও লেখক এই জাতির সব চেয়ে বড় আইকন। তাই সব বাঙালিই চান শেষ পর্যন্ত এক জন সাহিত্যিক হতে। সে তিনি ডাক্তারই হন, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, আমলা বা মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির সিইও, লেখালেখি করে পরিচিত হতে না পারলে তার মনে হয় যেন ইহজীবন বৃথা! “...হায়! জীবন পূরণ নাই হল মম তব অকৃপণ করে।”
যাই হোক, এ পাড় বাংলার বঙ্গজীবনের সব চেয়ে বড় আনন্দময় অঙ্গ দুর্গাপুজো। যাকে কেন্দ্র করে কয়েক মাস আগে থেকে কয়েক মাস পর পর্যন্ত যে উৎসবের আবহ তার অন্যতম উপচার শারদ সাহিত্য পাঠ। পুজো আসা মানে নতুন জামাকাপড়ের সঙ্গে আগে বাঙালির ঘরে আসত পুজোর গান আর গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ সমন্বিত বৃহদায়তন কিছু পূজাবার্ষিকী। কালের কোপে পরে আজ প্রায় হারাতে বসেছে পুজোর গান কিন্তু এই ঘোর স্মার্টফোন সর্বস্ব দুনিয়ার সঙ্গে রীতিমত জুঝে তবু স্বমহিমায় টিকে আছে পূজা সংখ্যাগুলি। আজকাল খুব শোনা যাচ্ছে আজকাল কেউ আর বই বা ম্যাগাজিন কিনে পড়ছে না। কিন্তু পরিসংখ্যান তো তার উল্টো কথাই বলছে। বিশ্বের অপরাপর দেশের সাহিত্যপ্রেমী মানুষ জন শুনলে চমকে উঠবেন, শুধু দুর্গাপুজোকে ঘিরে সারা বিশ্বে বাংলা ভাষায় (ম্যাগাজিন ফরম্যাটে বা ই-ফরম্যাটে) প্রকাশিত পত্রপত্রিকার সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এদের মধ্যে কিছু বাণিজ্যিক, কিছু অবাণিজ্যিক, কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় এই সব পত্রপত্রিকার মধ্যে সংখ্যায় প্রায় হাজারের কাছাকাছি শিশু কিশোর সাহিত্যের ভান্ডার।
বিক্রির পরিসংখ্যানও খারাপ না। বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোর রিডারশিপ সার্ভে রিপোর্টই তার সব চেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ। ছোট মাঝারি পত্রিকাগুলোর বিক্রিও যে সন্তোষজনক, তা দিনে দিনে বৃদ্ধিপাওয়া পত্রিকার সংখ্যাই বলে দিচ্ছে। অনলাইন বিক্রি ও প্রি-বুকিং চালু হওয়ার পর থেকে লিটল ম্যাগাজিনগুলোর যে কোনও উৎকৃষ্ট সংখ্যা কোনওটাই হাজারের নীচে বিক্রি হয় না।
প্রবাসী বাঙালি ও বিদেশবাসীদের বঙ্গসন্তানেরা সারা বছর যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন, পুজো এলে তাঁরা বায়ু ও জলযান মারফত দেশ থেকে পুজোর সংখ্যা আনিয়ে রিলিজিয়াসলি পড়েন। আর মেল বা ফোন করে পাঠ প্রতিক্রিয়া জানান। সে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও বলতে পারি।
এ তো গেল এখনকার কথা। পুজো সংখ্যার একেবারে শুরুর দিকে কোনও একটি পত্রিকার সাধারণ সংখ্যার সঙ্গে শরৎকালে বিশেষ সাল্পিমেন্ট হিসাবেই ছাপা হতে থাকে পুজো সংখ্যা। সম্ভবত, কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ভারত সংস্কার সভার সাপ্তাহিক ‘সুলভ সমাচার’ বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করে ‘ছুটির সুলভ’ নামে। এক পয়সার এক বিশেষ সংখ্যা বেরোয় ১২৮০-এর আশ্বিন মাসে। তার পর থেকে ‘ভারতবর্ষ’, ‘বঙ্গবাণী’ প্রভৃতি পত্রিকা পুজো সংখ্যা প্রকাশ শুরু করে। তখনকার দিনের নামী লেখকেরা যেমন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এতে লিখতেন।
প্রথম শারদ উপন্যাস ছাপা হয় শারদীয় বসুমতীতে। ইংরেজি ১৯২৬ সালে প্রথম শারদীয় সংখ্যা বের করে আনন্দবাজার পত্রিকা। তার বেশ কিছু বছর পর তাতে প্রথম উপন্যাস ছাপা হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শহরতলী’ , রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত বড় গল্প ‘রবিবার’ প্রকাশিত হয় এখানেই। পরের বছরেই উপন্যাস ‘ল্যাবরেটরি’। দেশ পত্রিকার শারদ সংখ্যা প্রথম প্রকাশ পায় ১৩৪১ বঙ্গাব্দে আর সুবোধ ঘোষের ‘ত্রিযামা’ ছিল দেশ-এ প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস, যা বেরিয়েছিল ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে। এর পর ইংরেজি ষাটের দশক থেকে পুজোর সংখ্যায় আমরা দেখতে পাই এক একটি পূজাবার্ষিকীতে একাধিক, এমনকি ছয়-সাতটি করে উপন্যাস। সমকালের বিখ্যাত লেখকেরা সেগুলি লিখতেন। যেমন পুরনো দেশ পত্রিকার সংখ্যা খুললেই দেখা যাবে প্রথমেই অবশ্য উপস্থিতি রবীন্দ্রনাথের, তাঁর অপ্রকাশিত লেখা বা চিঠিপত্রের সম্ভার। তার পরেই থাকত বিষয়ক রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক প্রবন্ধ নিবন্ধ। তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতি, সতীনাথদের যুগের পর তাঁদের ব্যাটন ধরেন সমরেশ বসু, রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ মজুমদারেরা। সত্যজিতের হাত ধরে ফেলুদার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয় পুজো সংখ্যায়।
এ সব মূলত আশির দশকের গল্প, পুজো সংখ্যার স্বর্ণযুগের কথা। সাগরময় ঘোষ তখন দেশের সম্পাদক। তাঁর লেখা ‘সম্পাদকের বৈঠক’ থেকে জানতে পারি, সুবোধ ঘোষকে দিয়ে শেষ পর্যন্ত লেগে থেকে উপন্যাস লিখিয়ে নেওয়ার ঘটনা। দেশের দফতরে বসে শেষ মুহূর্তে লেখা শেষ করেছিলেন সুবোধ ঘোষ। আর সেই সব লেখার পাতা একটা একটা করে প্রেসে নিয়ে গিয়ে ছাপা হয়েছিল তাঁর শারদ উপন্যাস।
দু’হাজার সালের আশপাশ থেকে প্রথিতযশা লেখকদের পাশাপাশি নতুন লেখকদের সুযোগ দেওয়ার যে ধারা শুরু হয়, তা থেকে উঠে এসেছেন এই সময়ের বিখ্যাত সব লেখক। বাকি অনেকের মতো আমার ক্ষেত্রেও সাহিত্য জগতে পরিচিতি পেতে প্রভূত সাহায্য করেছে দেশ পত্রিকার শারদ সংখ্যা। এই শারদ উৎসব তাই শুরু খাওয়াদাওয়া আর হইচই-এর নয়, নিভৃত শারদ সংখ্যার মগ্ন পাঠকেরও।
লেখক সাহিত্যিক