রমজান আলির চিঠি (‘উপন্যাস?’, ৮-৪) প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চাই। ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের ১৭ পৌষ (১ জানুয়ারি, ১৯৪১) পুলিনবিহারী সেন প্রকাশিত তিনটি গল্পের সঙ্কলন তিনসঙ্গী-তে গল্প হিসেবেই ‘ল্যাবরেটরি’ লেখাটি জায়গা পেলেও আনন্দবাজার পত্রিকা-র শতবর্ষে উপন্যাসের যে সঙ্কলনটি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে রবীন্দ্রনাথের ‘ল্যাবরেটরি’ রচনাটিকে উপন্যাস হিসেবে প্রথমেই স্থান দেওয়া হয়েছে। এর কারণ সহজ ও স্পষ্ট। আনন্দবাজারের শারদীয়া সংখ্যা ১৩৪৭-এর প্রচ্ছদে লাল হরফে পাঠকদের জানানো হয়েছিল এই সংখ্যার বিশেষ আকর্ষণ, “রবীন্দ্রনাথের নূতন উপন্যাস— ‘ল্যাবরেটরি’।” এই বিজ্ঞপ্তির বিরোধিতা সে দিন কেউ করেননি— রবীন্দ্রনাথও করেননি। সুতরাং, আনন্দবাজারের ইতিহাসে ‘ল্যাবরেটরি’ থেকে গিয়েছে ‘নূতন উপন্যাস’ হিসেবে।
প্রসঙ্গত, খেয়াল করা ভাল, রবীন্দ্রনাথ নিজে অনেক সময় শিথিল ভাবে গল্প ও উপন্যাস শব্দ দু’টিকে সমার্থক অর্থে ব্যবহার করতেন। যেমন, ‘বিচিত্রা’ পত্রে যখন ‘তিনপুরুষ’ নামের উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছিল, তখন মাঝপথেই তার নাম বদলে হয় ‘যোগাযোগ’। রবীন্দ্রনাথ সেই সময় লিখলেন, “তিনপুরুষ নাম ধ’রে আমার যে গল্পটা বিচিত্রায় বের হ’চ্চে তার নাম রক্ষা করতে হবে এমন কোনো দায় নেই।” এখানে ‘গল্প’ বলতে ‘উপন্যাস’ই বুঝিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। গল্পরসিক পাঠকদের তিনি অনাদর করেন না, সাহিত্যের বিভিন্ন বর্গের জল অচল ভাগ সে জন্য অনেক সময়েই তাঁর কাছে গ্রাহ্য নয়। একের মধ্যে ঢুকে পড়ত অন্য রূপের বৈশিষ্ট্য।
‘ল্যাবরেটরি’ পরবর্তী কালে সাহিত্য সমালোচকদের সূক্ষ্ম বিচারে যে রূপের স্বীকৃতিই লাভ করুক না কেন, রবীন্দ্রনাথের এই নতুন ভাবের ও নতুন ভাষার লেখাটিকে আনন্দবাজার তার পাঠ-সংস্কৃতির ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে উপন্যাস হিসেবেই প্রকাশ করেছে।
অন্বেষা দত্ত
কলকাতা-৬৪
নিষ্ঠুর পরিহাস
লস এঞ্জেলসের অস্কার মঞ্চে যা ঘটল, তা মোটেও সুখকর নয়। স্ত্রী জেডাকে নিয়ে রসিকতা করার জন্য সঞ্চালক ক্রিস রককে সপাটে থাপ্পড় মারেন ২০২২ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতা উইল স্মিথ। স্মিথ তাঁর আচরণের জন্যে দুঃখপ্রকাশ করেছেন, যদিও আমার মতে স্ত্রী’র প্রতি সম্মানহানিকর কথা বললে স্বামী প্রতিবাদ করবেন, এটা স্বাভাবিক। সে প্রতিবাদের ধরন নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে। সঞ্চালকরা পরিহাস করেই থাকেন। কিন্তু মেয়েদের মাথার চুল খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। একটা সময় আমাদের সমাজেও কোনও মহিলা ‘অপরাধ’মূলক কাজ করলে তাঁর মাথা নেড়া করে সাজা দেওয়া হত। রসিকতা বা পরিহাস করতে গেলে স্থান-কাল-পাত্রকে গুরুত্ব দিতে হয়। ক্রিস জানতেন না, কোনও মহিলার চুল নিয়ে সভাতে রসিকতা করলে তার পরিণাম কী দাঁড়াতে পারে।
বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা করতে গেলে পাণ্ডিত্য ও মেধা লাগে। পরিহাস করতে গিয়ে পা ফস্কালে পাহাড়ের চূড়া থেকে একেবারে অতলস্পর্শী খাদে গিয়ে পড়তে হয়। একটি উদাহরণ, নোবেল পুরস্কারজয়ী বিজ্ঞানী টিম হান্ট দক্ষিণ কোরিয়ায় বিজ্ঞান সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পরিহাস করে বলেন— “মেয়েরা ল্যাবে থাকলে বড় সমস্যা, হয় তারা প্রেমে পড়বে, নয় তো অন্য পুরুষ বিজ্ঞানীরা তাদের প্রেমে পড়বে। আর সমালোচনা করলে তারা কান্নাকাটি করবে।” তাঁর এই মন্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর হইচই পড়ে যায়। বিশেষত মহিলাদের তরফ থেকে তীব্র সমালোচনার ঝড় ওঠে। এই মন্তব্যের জন্য তিনি ক্ষমা চেয়ে বলেন, “আমি স্রেফ রসিকতা করে বলেছিলাম, এটা যে এত গুরুত্ব পাবে দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।” এই পরিহাসের খেসারত হিসেবে তাঁকে ইউরোপিয়ান রিসার্চ কাউন্সিল, রয়্যাল সোসাইটি, ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডন ইত্যাদি জায়গার পদগুলি হারাতে হয় (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮-০৬-২০১৫)। ২০২২ সালে অস্কার মঞ্চের অপ্রীতিকর ঘটনাটি পরিহাসের পরিণাম বিষয়ে আবারও সতর্ক করে দিয়ে গেল।
মৃণাল মাইতি
ডিভিসি, বাঁকুড়া
শূন্য খাতা
শৈবাল বসুর ‘এই নিঃসঙ্গ, নির্লিপ্ত কৈশোর’ (৩০-৩) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই চিঠি। এ বারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় নজরদারির সময় প্রবন্ধকারের মতোই আমারও প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতা হল। দীর্ঘ কুড়ি বছরের শিক্ষকতা জীবনে এমন শান্ত, নিরুপদ্রব ভাবে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা দিতে সত্যিই প্রথম বার দেখলাম। এ তো ভাল লাগারই বিষয় হতে পারত। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, বেশ কিছু পরীক্ষার্থী উত্তরপত্রে স্মল লেটার ও ক্যাপিটাল লেটার মিশিয়ে অতি কষ্টে নিজের নামের বানান লিখেছে। বেশির ভাগেরই উত্তরপত্রের অধিকাংশ পৃষ্ঠাতে কলমের আঁচড়টুকু পড়েনি। গত দু’বছরে করোনা অতিমারি আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। এই কালান্তক সময় পর্বে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত থেকেছে শিশু-কিশোরদের লেখাপড়া। এই ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের কথা ভাবলে আতঙ্কিত হতে হয়। দীর্ঘ বিরতির পর পুনরায় বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে। তাদেরও লেখাপড়ার হাল তথৈবচ। কিছু আদর্শবান দায়িত্বশীল শিক্ষক লড়াই শুরু করেছেন ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণির উপযুক্ত মানে পৌঁছে দিতে। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যালয়গুলির পরিকাঠামো শোচনীয়। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে দীর্ঘ দিন ধরে একাধিক শিক্ষক পদ শূন্য, পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে সব শ্রেণির সব ক্লাস নিয়মিত করা যাচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলিতে না আছে উন্নত মানের বীক্ষণাগার, না আছে পাঠাগার। খেলার মাঠও যথাযথ নজরদারির অভাবে বিনষ্টপ্রায়। আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে সরকারের উচিত, শিক্ষার হাল ফেরাতে জরুরি ভিত্তিতে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও পরিকাঠামোর উন্নতিতে নজর দেওয়া।
কৌশিক চিনা
মুন্সিরহাট, হাওড়া
বহুরূপী
বহরমপুরে ভাগীরথী নদীর পশ্চিমপারের বসন্ততলা বহু দিন থেকে স্থানীয় মানুষদের কাছে পরিচিত ‘বহুরূপীদের গ্রাম’ বলে। এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষই বহুরূপী। বংশপরম্পরায় এখনও অনেকে বহুরূপী সাজাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এই গ্রামের বহুরূপী শিল্পীরা প্রতি দিনই বাঘ, সিংহ, হনুমান, রাম, রাবণ, দুর্গা, কালী প্রভৃতি পৌরাণিক চরিত্রের সাজপোশাক পরে উপার্জনের আশায় বিভিন্ন বড় শহরে ট্রেনে, বাসে চেপে বেরিয়ে পড়েন। উপার্জন দৈনিক তিন-চার কেজি চাল, আর নগদ একশো-দু’শো টাকা।
বর্ষার সময়টাই বহুরূপীদের সবচেয়ে কষ্টের সময়। জল-কাদায় ডুবে যাওয়া গ্রামগঞ্জের রাস্তাঘাট দিয়ে যাতায়াত করা যায় না। শরৎকালে দুর্গাপুজোর সময়ে সবচেয়ে বেশি রোজগার হয়। বীরভূমের লাভপুরের বিষয়পুর, চারকল, হুগলির তারকেশ্বরের জোতশম্ভু প্রভৃতি এলাকাতেও আগে অনেক বহুরূপী শিল্পী পরিবার বাস করত। বাংলার বিখ্যাত বহুরূপী শিল্পী প্রয়াত সুবল দাস বৈরাগ্যও চারকল গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। পূর্ব বর্ধমান এবং নদিয়া জেলাতেও বেশ কয়েক ঘর বহুরূপী শিল্পী রয়েছেন। তবে বাংলার এই প্রাচীন লোকায়ত ধারাটি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। নবীন প্রজন্ম আর আসতে চাইছে না এই পেশায়। ১৯৮৮ সালে বহুরূপী শিল্পীদের সমস্যা নিয়ে বহরমপুরের রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম বহুরূপী রাজ্য সম্মেলন। তাঁদের দাবি ছিল— বহুরূপীদের লোকশিল্পী হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি ও দুঃস্থ শিল্পীদের আর্থিক সাহায্য দেওয়া হোক। সেই দাবির প্রেক্ষিতে নব্বইয়ের দশক থেকে কোনও কোনও বহুরূপী শিল্পী মাসে এক হাজার টাকা করে ভাতা পান লোকশিল্পী হিসেবে, কিন্তু তা-ও অনিয়মিত ভাবে। তাই অনেক প্রবীণ শিল্পীরই গলায় রয়েছে আক্ষেপের সুর, কত দিন আর এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে?
তুষার ভট্টাচাৰ্য
কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ