আরজি কর-কাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
‘কোন নাগরিক, কোন জনতা’ (২৮-১০) প্রবন্ধে সাম্প্রতিক জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে শ্রেণি বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করেছেন রণবীর সমাদ্দার। সে দিক থেকে লেখাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বিষয়ে যা মন্তব্য করা হয়েছে, তা তথ্যানুসারী নয়। অবাক হয়েছি আশিরনখ দুর্নীতি এবং হুমকি-প্রথার বিষয়ে উল্লেখ না দেখে। বস্তুত যা যা সরকারি বক্তব্য জেনেছি, সে সবই খানিকটা তত্ত্বের মোড়কে এই লেখায় উঠে এসেছে।
৯ অগস্টের ঘটনার পর স্বতঃস্ফূর্ত এক অবস্থান শুরু করেন অভয়ার কলেজের সহপাঠীরা। পাশাপাশি, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির কয়েক জন মেয়ে ১৪ অগস্ট রাত দখলের আহ্বান জানান সমাজমাধ্যমে। এই দু’টি আন্দোলনের ডাক একটা বিন্দুতে গিয়ে মিলে যায়, কারণ দু’টিতেই নারীর সামাজিক অবস্থানে নিরাপত্তার অভাব ও প্রতিরোধের ডাক দেওয়া হয়েছে। জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের প্রধান দাবি অভয়ার ন্যায়বিচার এবং আর একটা অভয়া হতে না দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এর মধ্যে কি সার্বিক নারীসুরক্ষা পড়ে না? এই আন্দোলনে নিম্নবর্গের নারী-নির্যাতনের সমস্যা প্রাধান্য পায়নি, প্রবন্ধকারের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে জানাতে চাই, এই দু’টি আহ্বান এবং আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই নানা উদ্যোগ সংগঠিত হচ্ছে। নানা পদক্ষেপের প্রস্তাব উত্থাপিত হচ্ছে। ৩ অক্টোবর রাত ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত শ্যামবাজারের মোড়ে রাতের মিটিংয়ের অংশগ্রহণকারীদের সিংহভাগ ছিলেন গৃহকর্মে নিযুক্ত মেয়েরা। এ ছাড়াও, গড়িয়া, যাদবপুর ও বিভিন্ন মফস্সল শহরে যে মেয়েদের মিটিং আয়োজিত হয়েছে, সেখানে আশাকর্মী, মিড-ডে মিলের কর্মীরাই প্রধানত অংশগ্রহণ করেছেন। মতামত, সুবিধা অসুবিধার কথা বলেছেন। জঙ্গলমহলের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য। মেয়েদের আইনি অধিকার, ঘরের ভিতর এবং কর্মস্থলে যৌন হেনস্থা-সহ নানা অত্যাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো, সর্বোপরি এই বিষয়ে প্রশাসনকে কী ভাবে সক্রিয় করা যায়, সব বিষয়ই উঠে এসেছে এই সব মিটিংয়ে। লিঙ্গসাম্যের আন্দোলন যতখানি বাইরের, তার চেয়েও বেশি অন্দরের। তা সময়সাপেক্ষ, দীর্ঘ পদ্ধতি। এ দেশের আন্দোলনের ইতিহাস বলে, শ্রমিক আন্দোলন বা সামাজিক আন্দোলন, সব কিছুরই সূচনা হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে। জানতে ইচ্ছে হয়, শ্রমজীবী মেয়েদের সুরক্ষার জন্য আর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য রাজ্যের জনবাদী সরকার ঠিক কী কী পদক্ষেপ করেছে।
বোলান গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা-৩
অবিশ্বাস কেন?
রণবীর সমাদ্দারের প্রবন্ধটির প্রসঙ্গে বলতে চাই, জুনিয়র ডাক্তাররা সমাজ বদলের আন্দোলন করছেন না। এই ব্যবস্থার মধ্যেই যেটুকু যা সুযোগ আছে, তারই মধ্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কারটুকু চেয়েছেন। রেফারেল ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটানো গেলে সাধারণ রোগভোগে মানুষকে শহরের হাসপাতালের ভিড়ে অকারণে হয়রান হতে হবে না। স্থানীয় হাসপাতালেই অধিকাংশ চিকিৎসা হয়ে যাবে। এটা কি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নয়? এ কাজ কি কেবল ডাক্তারদের একার, আমাদেরও নয়? ডাক্তাররা যেখানে আটকাচ্ছেন, সেখানে আর পাঁচ জন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সুরক্ষার দাবি সরে গেল বললেই কি চুকে গেল? যত ক্ষণ সুরক্ষা না আসে, তত ক্ষণ সরকারের সঙ্গে আলোচনার প্রত্যাশাকে ঘিরে ডাক্তারদের সংহতি বাড়লে তো ভালই। তা সামাজিক ব্যাপকতাকে ত্যাগ করেই হতে হবে, প্রবন্ধকার এমন ধরে নিচ্ছেন কেন? কেনই বা নারীসুরক্ষার দাবিকে বিসর্জন দিয়েই তা করতে হবে? যতই আন্দোলন রাজনৈতিক রূপ নেবে, ততই সমাজ বাস্তব থেকে দূরে চলে যাবে— এই ধারণার ভিত্তি কী? প্রবন্ধকার বলেছেন, সিবিআই, আদালত, সিনিয়র ডাক্তারদের বিশিষ্টতা, বেসরকারি ব্যবস্থা, এই সব ব্যবহার করেই চিকিৎসক সমাজ আজ রাজনৈতিক শক্তিরূপে উঠে এসেছে। ঠিকই তো। আপত্তি কোথায়?
প্রবন্ধকার মনে করেন, উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত ডাক্তারদের কথা মানুষ অবিশ্বাসের সঙ্গে নেন। কারণ, তাঁরা সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতিতে আগ্রহী নন। আর জি কর কাণ্ডে তাঁদের প্রতি জনসমর্থনের প্রধান কারণ তরুণী চিকিৎসকের মর্মান্তিক হত্যা, এমনই মনে করেন প্রবন্ধকার। বলা জরুরি, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতিই আন্দোলনের অন্যতম দাবি। রেফারেল ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিটি তবে কী? হাসপাতালের ভিতরের নিরাপত্তা কি ডাক্তার ছাড়া অধস্তনদের জন্য নয়? স্বাস্থ্য, মেডিক্যাল শিক্ষা, হাসপাতাল তথা স্বাস্থ্য প্রশাসন, আধিপত্য, ভয়ের রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইও শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিমুক্ত সমাজের স্বার্থ রক্ষা করে।
পরিশেষে, রাজ্যের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আন্দোলনের স্থিতাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ডাক্তারদের আন্দোলন উৎসাহের জোয়ার তুলেছিল। রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলির সঠিক ভূমিকা থাকলে একে হয়তো আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত। সবই ডাক্তাররা করবেন, আর আমরা শুধু তার সুফল ভোগ করব, এমন মনে করলে তো যেমন চলছে, তেমনই চলবে।
শিবপ্রসাদ দাস, আন্দুল মৌরি, হাওড়া
তত্ত্বের পর্দা
রণবীর সমাদ্দার একটি নতুন বিষয়কে সামনে হাজির করেছেন— উচ্চ মধ্যবিত্ত-চালিত নাগরিক সমাজ, ও প্রান্তিক জনসাধারণের সংঘর্ষ। এই অবস্থানই নিয়েছে রাজ্যের শাসক দল। আর জি করের তরুণী চিকিৎসকের কর্মক্ষেত্রে নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতিকে সামনে রেখে শাসক দল দাবি করেছিল যে, সাধারণ মানুষ তথা প্রান্তিক মানুষ ওই ডাক্তারদের জন্যই চিকিৎসা পাচ্ছেন না। এ ভাবে ওই ডাক্তারদেরই প্রায় ‘গণশত্রু’ হিসাবে দাগিয়েছিল। এর পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলির সমর্থনকেও দায়ী করেছিল। কাজেই প্রবন্ধকার এখানে প্রচ্ছন্ন ভাবে রাজ্য সরকারের প্রতি সমর্থনকেই স্পষ্ট করেছেন।
অথচ, ২০২১-এ এই আর জি করে জুনিয়র ডাক্তারেরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। সে সময় প্রবন্ধকারের দৃষ্টিতে যাঁরা ‘সাংস্কৃতিক রসদে বলীয়ান মধ্যবিত্ত’ তাঁরা কিন্তু ওই আন্দোলনে জোটেননি। ২০২৪-এ জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাধারণ মানুষ জুটেছেন। তার কারণ, বর্তমান সরকার তথা ‘জনবাদী প্রশাসন’-এর সামনে ঘটতে থাকা একের পর এক ঘটনা— ৯ অগস্টের ধর্ষণ-হত্যা কাণ্ডের প্রমাণ লোপ করার চেষ্টা, অকারণে দ্রুত ময়নাতদন্ত, মা-বাবার আবেদন অগ্রাহ্য করে দ্রুত দাহ, ১৪ অগস্ট রাতে আর জি করের জরুরি বিভাগ তছনছ করা ও সেমিনার রুমের দরজা পর্যন্ত যাওয়ার এবং পুলিশের দুষ্কৃতীকে না আটকানোর চেষ্টা, ইত্যাদি। প্রায় প্রতি দিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মিছিল-সমাবেশে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ দিয়ে বলতে চেয়েছেন, যেখানে জীবন-মরণের প্রশ্ন, সেখানে বর্জ্য নিয়ে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে, পাশ-ফেল নিয়ে ক্ষমতাশালীদের কেলেঙ্কারি যুক্ত হয়ে হাসপাতালগুলিতে দুষ্কৃতীরাজ চলেছে। এখানে শাসক দলের ছত্রছায়ার বাইরে পড়ুয়া-চিকিৎসকদের টিকে থাকা মুশকিল।
প্রবন্ধকার কি জুনিয়র ডাক্তারদের সমাজ সংস্কারক মনে করেছিলেন? তাঁরা কিন্তু কোনও সময় তেমন দাবি করেননি। বরং তাঁরা সব সময়েই দু’টি দাবি তুলেছেন— তাঁদের সহকর্মী চিকিৎসক দিদির সঠিক বিচার এবং ভবিষ্যতে আর এ রকম ঘটনা যাতে না ঘটে তার ব্যবস্থা। সেই জন্য হাসপাতাল ও কলেজের নানা কমিটি ও কাউন্সিলে সুষ্ঠ নির্বাচনের ব্যবস্থা, এবং ডাক্তার, সেবাকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীদের নিরাপত্তা রক্ষায় নানা ব্যবস্থার দাবি করেছেন। তাই প্রবন্ধকারের এই প্রবন্ধে তত্ত্বগত ভূমিকা হয়তো রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এটি নানা দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ রাজ্য সরকারকে কিছুটা স্বস্তি দেবে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
তাপস কুমার, কলকাতা-৫৪