স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘কল আসছে, কিন্তু জল?’ (২৫-৪) শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ে মনে পড়ল, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ে এক নিকট আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছি বেশ কয়েক বার। কিন্তু গত মার্চ মাসে গিয়ে দেখলাম ক্যানিংয়ের মতো আধা শহরে পানীয় জলের কী শোচনীয় অবস্থা। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ফি বছর ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল— এই পাঁচ মাস সমগ্র ক্যানিং মহকুমা জুড়ে দেখা যায় পানীয় জলের হাহাকার। সবচেয়ে বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হন দিঘিরপাড়, মাতলা-১, মাতলা-২ পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দারা। এই সময় মাঠে বোরো ধান চাষের জন্য সেচের জলের প্রধান উৎস হিসেবে শ্যালো ও হাউস পাম্প ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয়। ফলে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর মাত্রাতিরিক্ত ভাবে কমে যায়। যার জেরে বাড়িতে-বাড়িতে, এমনকি পঞ্চায়েত ব্যবস্থাপনায় রাস্তার নলকূপগুলি থেকেও জল ওঠে না। ফলে স্নান, শৌচ, বাসন মাজা, কাপড় কাচা ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ সবই পুকুরের জলে সারতে হয়। বাজার থেকে পানীয় জল কিনে খেতে হয়। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা।
জলের অভাবে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমেই দুঃসহ হয়ে উঠছে। বয়স্ক ও মহিলাদের চরম দুরবস্থার শিকার হতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে দিঘিরপাড় পঞ্চায়েত এলাকার কিছু কিছু গ্রাম্য এলাকায় পানীয় জল সরবরাহের পাইপ লাইন বসানোর কাজ শুরু হলেও রামমোহন পল্লি, সঞ্জয় পল্লি-সহ একাধিক এলাকায় এখনও কাজ শুরু হয়নি। গরমে পানীয় জলের অভাবে মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়ছে। ভোট আসে, ভোট যায়। পানীয় জলের আশ্বাস নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মতোই মিলিয়ে যায়। তৃষ্ণার্ত মানুষ তবুও ভোটের লাইনে দাঁড়ায় হয়তো এক ফোঁটা জলের আশায়।
মৃণাল কান্তি ভট্টাচার্য
কেতুগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান
আসন্ন সঙ্কট
স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘কল আসছে, কিন্তু জল?’ এবং সুপ্রতিম কর্মকারের ‘পানীয় জলে স্বনির্ভরতা কবে’ (২৫-৪) গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। সংসারের সবার প্রয়োজনীয় জল জোগানের দায়িত্ব মহিলাদের। দূর-দূরান্ত থেকে খুব কষ্ট করে বয়ে আনতে হত সেই জল। ক’মাস আগে আমার গ্রামে সবার বাড়িতে জল পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু জলের ধারা দিন দিন সরু হতে হতে এখন ধারাহীন। এই সমস্যায় জর্জরিত অনেক গ্ৰাম। গাঁয়ে বড় হয়েছি। দেখেছি, চার দিকে ডোবা, পুকুর, খাল-বিল, নদী-নালা— সব জলে ভর্তি। শুধু পানীয় জলের কিছু সমস্যা ছিল। নলকূপগুলো দূরে দূরে। মাঝেমধ্যে কোনওটা আবার খারাপ হয়ে যেত। তখন পানীয় জলের কষ্টটা বুঝতাম। আমাদের ছাত্রজীবনে স্কুলে-কলেজে জল সংরক্ষণ বিষয়ে চর্চা হয়নি। ছোটবেলায় গ্ৰামের জমি একফসলি ছিল। বাড়ির কাছাকাছি বা খালের পাশের জমি দু’বার চাষ হত পুকুর বা খালের জলে। হঠাৎ দেখলাম, গাঁয়ে ‘ডিপ টিউবওয়েল’ ‘মিনি ডিপ টিউবওয়েল’ বসল, সেই জলে অনেক জমি দ্বিতীয় বার চাষ শুরু হল। প্রচুর ফলন, প্রচুর লাভ। জলের অপচয় গেল বেড়ে।
কয়েক বছর পরে আমরা পানীয় জলটুকুও মাটির তলা থেকে পাব না। বাড়ছে জলের আর্সেনিক দূষণ। সেই দূষিত জল পানীয়ের মাধ্যমে ও উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে বিষক্রিয়া ঘটাচ্ছে। সম্প্রতি চেন্নাইয়ের জলসঙ্কট ও নীতি আয়োগের রিপোর্ট আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করেছে। এখনও এই তথ্য শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই বিষয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে যায়নি সাধারণ মানুষের মধ্যে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৪০-৫০ সালের মধ্যে ভারতও জলশূন্য হয়ে যেতে পারে। প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী রাজভবনে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ও তার ব্যবহার করে রাজ্যবাসীর কাছে এই সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বিষয়ে বার্তা দিয়েছিলেন। তাঁর সেই প্রচেষ্টাকে মান্যতা দিয়ে জলের অপচয় বন্ধ, জল সংরক্ষণ, পুনর্নবীকরণ বিষয়ে সকলে এখনই সচেতন না হলে অচিরে আমাদের চরম জল সঙ্কটে ভুগতে হবে।
গৌতম পতি
তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
চাই স্বচ্ছ পুকুর
‘কল আসছে, কিন্তু জল?’ সুন্দরবন অঞ্চলের বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে লেখা। আশা করা যায়, এতে সরকারের দরজায় আঘাত পড়বে। ২০২৪ সালের ভোট লক্ষ্য করে কেন্দ্রীয় সরকার ‘জলজীবন মিশন’ ও রাজ্য সরকার ‘জলস্বপ্ন’ প্রকল্প শুরু করেছে মানুষের দরজায় জল পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু গত তিন বছরে মাত্র কুড়ি শতাংশ কাজ হয়েছে। সে জলের চাপ অত্যন্ত কম, এই চিত্র বাস্তব। আমরা যারা আমপান-ইয়াস বিধ্বস্ত সুন্দরবনে ত্রাণ বিতরণ করতে যাই, তারা গ্রামের মহিলাদের এই দুঃসহ অবস্থা প্রত্যক্ষ করি। এত কম চাপে পানীয় জলটুকুই পাওয়া দুষ্কর, রান্নার জলের জন্য দূরের ডিপ টিউবওয়েল থেকে জল আনতে হয়। কারণ, এ ছাড়া সব জলের উৎসই লবণাক্ত। আমরা দেখেছি বিশেষত গরম কালে এই এলাকার সব পুকুর-ডোবার জলে সবুজ, আঠালো বিষাক্ত একটা সর পড়ে। মহিলারা অনন্যোপায় হয়ে সেই জলই বাসন ধোয়া, কাপড় কাচা বা শৌচকর্মের জন্য ব্যবহার করেন। নির্বাচনের প্রেক্ষিতে সরকার ‘কলশুমারি’ দেখাবেন, কিন্তু সে কলে যে জল আসে না, বা খুবই কম আসে, তা সরকারের প্রতিনিধিদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে।
সুন্দরবন-সংলগ্ন মাতলা ও নিমানিয়া নদী দিয়ে ঘেরা কৈখালি গ্রামের রামকৃষ্ণ মিশনের গাছপালা-ছাওয়া বিশাল এলাকায় দেখেছি বেশ কয়েকটি পরিষ্কার জলের পুকুর, কোনওটিতে মাছ ধরা হচ্ছে অতিথিনিবাসের জন্য, কোনওটিতে ছাত্রাবাসের ছেলেরা আনন্দে স্নান করছে। একই ভাবে সরকার সুন্দরবন অঞ্চলের পুকুরগুলিকে বড় এবং গভীর করে কেটে, শোধন করে, লবণমুক্ত করে, ব্যবহারোপযোগী করতে পারেন।
শিখা সেনগুপ্ত
কলকাতা-৫১
থার্মোকলের ফাঁদ
শ্বেতশুভ্র থার্মোকলের রূপের ফাঁদে বন্দি সকলে। সর্বত্রই থার্মোকলের থালা-বাটির জয়জয়কার। দাম কম, দেখতে ভাল, পরিষ্কার করার ঝামেলা নেই, ফেলে দিলেই হল, এত সুবিধা দেখিয়ে থার্মোকল দ্রুত বাজার জয় করেছে। একটি জার্মান সংস্থার গবেষকরা পলিস্টাইরিন অণুর পুনর্গঠন ঘটিয়ে ‘স্ট্রেচ পলিস্টাইরিন’ তৈরি করেন। এই স্ট্রেচ পলিস্টাইরিন-ই হল থার্মোকল। সহজে বিশেষ প্রক্রিয়ায় কারখানায় এটি তৈরি করা যায়।
সহজলভ্য বস্তুটির এখন বিশ্ব জুড়ে সমাদর, বিশেষ করে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল বিশ্বে। হোটেল-রেস্তরাঁ, মিষ্টির দোকান, সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে থার্মোকলের থালা-বাটি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন মেলা ও উৎসবেও থার্মোকলের বাটি-প্লেট দেদার ব্যবহৃত হয়। আমরা ভাবি না, এগুলি পরিবেশ-বান্ধব নয়। এগুলি মাটিতে মেশে না। মাটিতে বা পুকুর ডোবায় পড়ে থেকে পরিবেশের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে। মাটি উর্বরতা হারায়, জলাভূমিতে মাছ ও জলজ প্রাণী খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। জলনিকাশি নালাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। থার্মোকল পোড়ালে প্রায় ৯০ রকম গ্যাস বাতাসে মেশে, অধিকাংশই ক্ষতিকর।
থার্মোকলের বাসনে খাওয়াতেও ঝুঁকি আছে। গরম খাবার থার্মোকলের পাত্রের উপরের স্তরকে গলিয়ে ফেলে ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পেটের মধ্যে প্রবেশ করে। দীর্ঘ দিন এ রকম চললে কিডনি, লিভার, স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেখা দিতে পারে ক্লান্তি, অনিদ্রা, দুর্বলতার মতো উপসর্গ। এর বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হোক শালপাতার থালাবাটি, যা পরিবেশ-বান্ধব। এগুলি মাটিতে পচে-গলে মিশে গিয়ে মাটির উর্বরতাকেই বাড়ায়। সুদৃশ্য করতে শালপাতার উপর কলাপাতাকে পেস্টিং করা যেতে পারে। সুপারির পাতা থেকেও পরিবেশ-বান্ধব থালা-বাটি তৈরি করা যায়, তবে তা কিছুটা ব্যয়বহুল। দেখতে হবে, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য যেন সর্বদাই অগ্রাধিকার পায়।
প্রদীপ রঞ্জন রীত
আমতা, হাওড়া