‘সচেতনতা বাড়াতে প্লাস্টিক বর্জনের পথে হাঁটছে বহু স্কুল’ (১৮-৪) প্রতিবেদন পড়ে মনে হয়েছিল, এত দিনে একটু হলেও ইতিবাচক পথে এগোচ্ছে প্লাস্টিক বর্জনের উদ্যোগ। এই আন্দোলনের সুফল পেতে হলে শুধু কাগুজে আইন করে ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। নজরদারিও সমানে বাড়াতে হবে। অন্য যে পথটি নেওয়া যায় তা হল, প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকই শুধু তৈরি হোক। যা কোনও ভাবে নষ্ট করা যায় না, তা বাজারজাত করা অবিলম্বে আটকাতে হবে।
২০১৮ সালে ভারত বিশ্ব পরিবেশ দিবস আয়োজন করে ‘বিট প্লাস্টিক পলিউশন’ স্লোগানকে সামনে রেখে। বলা হয়, পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকই ব্যবহার করা যাবে, যা বাস্তুতন্ত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছড়াবে না। সস্তা প্লাস্টিক ব্যবহারে পশুপাখি বা জলজ প্রাণীর ক্ষতিসাধন তো হয়ই, নিকাশিব্যবস্থাও বাধাপ্রাপ্ত হয়। বড় রাস্তার নর্দমার মুখগুলো প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্যে আটকে আছে। পুরসভাগুলি নিয়মিত ভাবে খোলা নর্দমার প্লাস্টিক ও পাঁক পরিষ্কার করে বলে মনে হয় না। তাই এ বছরও বর্ষার শুরুতে জলমগ্ন হবে কলকাতা ও তাকে ঘিরে থাকা শহরতলি এলাকা। যে সমস্ত প্লাস্টিকের রাসায়নিক গঠন নির্ধারিত মাপকাঠি না মেনে উৎপাদিত হয়, তা মাটিতে মিশলে মাটি তার উর্বরতা হারায়। প্লাস্টিকের প্যাকেট, বোতল থেকেও নানা রোগ বাসা বাঁধে শরীরে।
স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের প্লাস্টিক দূষণের কুফল বোঝাতে অনেক স্কুল বর্তমানে যে কোনও রকমের প্লাস্টিকের সামগ্রী ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশের সঙ্গে জরিমানার নিদানও দিয়েছে। স্কুলগুলির নেওয়া এই জরুরি উদ্যোগ সফল করতে যাদের পানীয় জলের জন্য ধাতব বোতল কেনার সামর্থ্য নেই, সেই সমস্ত দুঃস্থ পরিবারের ছেলেমেয়েদের হাতে সরকারি ভাবে ধাতব বোতলের জোগান দিলে সমস্যার সমাধান হয়। সরকারি কত টাকাই তো যুক্তিহীন কাজে খরচ হয়, স্কুলগুলির এই কার্যকর উদ্যোগের কারণে যদি মারণ প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করা যায় বা ধীরে ধীরে কমানো যায়, তার চেয়ে ভাল বিষয় আর কী হতে পারে। এর জন্য স্কুলগুলির ক্ষেত্রে আলাদা করে সরকারি বরাদ্দ স্থির করা যায়। একই ভাবে, পানীয় জলের অপব্যবহার রোধ বা সামাজিক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিও সফল ভাবে রূপায়ণ করা সম্ভব হবে, তার জন্য বিজ্ঞাপনের ঢক্কানিনাদ দরকার হবে না।
সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা, কলকাতা-১৫৪
পরিযায়ী স্বার্থ
‘ইজ়রায়েল চলল দেশের মজুর’ (৯-৫) শীর্ষক রঞ্জিত শূরের প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় ভারতীয় শ্রমিক ও কর্মচারীরা কাজ পেয়ে ইজ়রায়েল পাড়ি দিচ্ছেন মূলত নির্মাণশিল্পে শ্রমিক ও নার্সের কাজ করতে। দুই দেশের সরকারের মধ্যে যথাযথ মজুরি, বাসস্থান, বিমা এই সব শ্রমিকস্বার্থ বিষয়ে রীতিমতো চুক্তি সম্পাদন করেই শ্রম ও পরিষেবার রফতানি চুক্তি কার্যকর হচ্ছে। গন্তব্য দেশের তালিকায় নাম আছে ইটালিরও। তাইওয়ানের সঙ্গেও কথা চলছে, হয়তো এক লক্ষ শ্রমিক কাজ নিয়ে যাবেন সেই দেশে। প্রবন্ধের শেষে আশঙ্কা, পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে যাওয়া শ্রমিকেরা কোনও ভাবে প্রতারিত হবেন না তো?
এইখানেই আসে পাল্টা প্রশ্ন। নিত্যদিন ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ থেকে অন্যান্য অনেক দেশ, বিশেষত পশ্চিম এশিয়ার ধনকুবের দেশগুলিতে ঠিকাদারের (বলা ভাল, দালাল) মাধ্যমে কাজ করতে যাচ্ছেন বিপুল সংখ্যায় শ্রমিক। শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আলাদা দৃষ্টিদান করা হয় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। কী ভাবে ও কোন পন্থায় এই ক্ষেত্রগুলিতে শোষণ চলে, সে বৃত্তান্ত অজানা নয়। প্রয়োজনীয় সীমাটুকু পেরোলেই পাসপোর্ট অর্থাৎ প্রাণভোমরাটি জমা পড়ে যায় দালালের হাতে। অসহায়তার কথাটা শ্রমিক যখন বোঝেন, তত ক্ষণে ফেরার দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেক সময় আলো-বাতাসহীন প্রকোষ্ঠে পশু-খোঁয়াড়ের চেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকতে বাধ্য করা হয় তাঁদের। মাঝে মাঝে কিছু টাকা দেশের অভাবগ্রস্ত বাড়িতে এসে পৌঁছয় বলে সবারই গলার জোর কমে আসে। অন্যথায় পেশি-আস্ফালনের শিকার হতে হয়। শ্রম সরবরাহরত দেশগুলি সাধারণ ভাবে জনবাহুল্য এবং বে-রোজগারির সমস্যায় ভারাক্রান্ত। তাই এই শোষণের বিরুদ্ধে সরকারও সচরাচর খুঁচিয়ে ঘা করতে চায় না। শোষিত শ্রমিকেরা মরে-দগ্ধে যে ভাবে হোক, তবু কিছু বিদেশি মুদ্রার আগমন ঘটাচ্ছেন।
শুধু বিদেশে শ্রম-রফতানির কথা কেন, দেশের মধ্যেই আমাদের রাজ্য ছেড়ে রাজ্যান্তরে যাচ্ছেন বিপুল সংখ্যায় পরিযায়ী শ্রমিক। তাঁদের অবস্থা যে কতখানি করুণ, তার দগদগে ছবি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি গত অতিমারির সময়। কর্মক্ষেত্র থেকে আক্ষরিক অর্থেই বিতাড়িত হয়ে স্ত্রী বাচ্চাকাচ্চা মালপত্র নিয়ে অবর্ণনীয় দুর্দশায় তাঁরা পাড়ি দিয়েছেন বিপুল দূরত্ব। বোঝাই যায়, অন্য রাজ্যে কী অবস্থার মধ্যে পড়ে থাকেন তাঁরা। এ দেশের যে দিকেই তাকানো যায়, শ্রমদাতা আর গ্রহীতার মধ্যে রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীর ক্ষীর খাওয়ার বৃত্তান্ত। ঘরের কাছে বা দূরে, অনিশ্চয়তাই শ্রমিক-কর্মচারীদের চাকরির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। কিছু ভাগ পেয়ে থাকে চুক্তি সম্পাদনকারী অফিস। এই ভাবেই চলছে ঠিকাদার-রাজ। শ্রমিকের গলায় দালাল-চক্রের ফাঁস এঁটে বসছে প্রতি দিন। রাতারাতি এই ব্যবস্থার পরিবর্তনের কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় যদি সরকারের মধ্যস্থতায় শ্রমিক-স্বার্থের নিয়ম-বিধি বা ‘প্রোটোকল’ মান্য করে বিদেশে কিছু কর্মসংস্থান হয়, তাকে পরিষেবা প্রদানকারীর পক্ষে মন্দের ভাল বলতেই হবে। ক্রমবর্ধমান বেকার এবং সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশে যত দিন না বিপুল শ্রমশক্তিকে যথাযথ কাজে লাগানোর উপযুক্ত ক্ষেত্র গড়ে ওঠে, তত দিন দালালতন্ত্র এড়িয়ে এই সাময়িক সমাধানকে শ্রেয় বলে মানতেই হবে। পেট বড় বালাই।
বিশ্বনাথ পাকড়াশি, শ্রীরামপুর, হুগলি
অসাম্য
‘অভিবাদনের পরে’ (১১-৫) সম্পাদকীয়তে যথার্থ ভাবেই বলা হয়েছে যে, শিক্ষা ছিল সাম্যের হাতিয়ার, কিন্তু বর্তমানে দ্রুত বাণিজ্যিকীকরণের ফলে তা ক্রমশই অসাম্যের হাতিয়ার হয়ে উঠছে। সরকার ও সমাজের দেখা উচিত অন্তত প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিশুরা যাতে কোনও অসাম্যজনিত কারণে শিক্ষার অধিকার থেকে বা সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্য সুনিশ্চিত করার অন্যতম আয়ুধ ছিল সরকারি বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলি। একটি সুচারু বিদ্যালয়ব্যবস্থা সহস্র সামাজিক অসাম্যের উত্তর হতে পারে। সরকারি বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলির মাধ্যমে প্রতি বছর নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বেশ কিছু ছেলেমেয়ে অন্ধকার থেকে আলোকবৃত্তে প্রবেশ করত। বড় হয়ে এরা বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়ে সমস্ত পেশাকে বৈচিত্র দান করত। এখনও যে করে না তা নয়, কিন্তু সংখ্যা কমে আসছে। যে আলোকোজ্জ্বল মুখগুলি দেখি, হয় তারা উঠে আসছে শিক্ষিত, উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে, নয়তো তারা প্রবল ভাবে ব্যতিক্রমী। কারণ, সংশ্লিষ্ট সকলের উদাসীনতায় সরকারি বিদ্যালয়গুলি রক্তাল্পতায় ভুগছে। পরিকাঠামো দেখে, পরীক্ষার ফলাফল দেখে এর আন্দাজ পাওয়া সম্ভব নয়। জানতে হলে অন্তরে উঁকি দিতে হবে। বিবিধ কারণে বিদ্যালয়গুলি আজ নানা রকম অনুষ্ঠান পরিচালনা ও পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থায় পরিণত হতে চলেছে। খানিকটা সরকারি সামাজিক প্রকল্পগুলির রূপায়ণের কেন্দ্রও বটে। পড়াশোনা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে বিদ্যালয়কে মানিয়ে নেওয়ার না আছে কোনও সুসংহত নীতি, না আছে কোনও স্থানীয় প্রচেষ্টা। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়ার আশা।
সৌমেন রায়, অরবিন্দনগর, পশ্চিম মেদিনীপুর