মৈত্রীশ ঘটকের ‘কাজের বাজারে অন্ধকার’ (১-৩) প্রবন্ধটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বর্তমান ভারতের অবস্থার যথার্থ বিবরণ। এখন সংবাদমাধ্যমে শ্রম ও শ্রমিক সংক্রান্ত বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন বা আলোচনা স্থান পায় না বললেই হয়। এই প্রবন্ধে সহজ ভাষায় ও অল্প পরিসরে পরিসংখ্যান-সহ শ্রম ও অর্থনীতি বিষয়ে তথ্য ও ঘটনার বিবরণ রয়েছে। ভারতে বেকারত্ব কমেছে। কিন্তু কাজের বাজার ‘অন্ধকার’— এই কথাটির মধ্যেই বহু প্রশ্ন প্রোথিত। ভারতে ৩০০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে সম্পদের মালিকের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে কোভিড-পরবর্তী সময়ে। কেবলমাত্র দু’জন শিল্পপতির প্রতি সেকেন্ডের আয় কমবেশি ৫ লক্ষ টাকা।
এক জন শিল্পপতির ছেলের প্রাক্-বিয়ের অনুষ্ঠানে নাকি হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারত, অথচ দারিদ্রসীমার নীচে রয়ে গিয়েছেন দেশের ১০ শতাংশ মানুষ। এটা নীতি আয়োগের তথ্য। রাজ্য ভেদে এই মান এক-এক রকম। তথ্য (এনএসও) বলছে, ভারতের মাথাপিছু জাতীয় গড় বার্ষিক আয় ১ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা, যা ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষের দ্বিগুণের একটু বেশি। আবার ন্যূনতম মজুরির হার বিভিন্ন রাজ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন, এমনকি চার-পাঁচটি রাজ্যের অসংগঠিত ক্ষেত্রের কাজে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির হার একশো দিনের প্রকল্পের মজুরিরও কম।
সংগঠিত সংস্থার বিশাল সংখ্যক নিয়মিত শ্রমিকদের বার্ষিক আয় বৃদ্ধির কোনও ব্যবস্থা নেই। বার্ষিক আয় বৃদ্ধি না হলে ক্রয়ক্ষমতা প্রতি বছর কমতে থাকে। দেশের এমন কোনও আইন নেই যে, বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের মুদ্রাস্ফীতির হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি করতেই হবে, বা বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ নির্দিষ্ট রাখতে হবে কোনও পূর্ব নির্ধারিত হারে।
অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের অবস্থা ভেবে দেখার সময় কার আছে? অথচ, দেশের জিডিপির প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ অবদান অসংগঠিত শিল্প থেকেই আসে! এখন প্রয়োজন ভারতে মজুরিতে ঘাটতি (আন্ডার পেড লেবার) ও নিয়োগে ঘাটতি (আন্ডার এমপ্লয়মেন্ট)— এই দু’টির উপর আলোকপাত করা। আশা করি ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আরও প্রবন্ধ পড়তে পারব।
সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা-৫৯
সংখ্যার পিছনে
মৈত্রীশ ঘটকের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই চিঠি। যে কোনও আর্থিক পরিকল্পনায় পরিসংখ্যান বাস্তব ও সৎ হলে পরিকল্পনাটি সমৃদ্ধ হয়ে এগিয়ে যায়, তার অভাবে ঠিক ততটাই পিছিয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক প্রায় সব পরিসংখ্যান এখন ভারতীয় অর্থনীতির উন্নতির বিপক্ষে যাচ্ছে। ভারত সরকারের দাবির সঙ্গে কিছুতেই মিলছে না। এর দৃষ্টান্ত, ভারতে বেকারত্ব কমার সঙ্গে কর্মসংস্থানের মান নিম্নমুখী হওয়া। কিছু নতুন শব্দ জন্ম নিচ্ছে অর্থনৈতিক গবেষণায়, যা বাস্তব ধারণা গুলিয়ে দিচ্ছে।
বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতের স্থান ১১১টি দেশের পরে। দক্ষিণ এশিয়ায় ছোট ছোট বেশ কিছু দেশ অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভারতের থেকে এগিয়ে। সেখানে বর্তমানে ভারতে বেকারত্ব বিগত ৪০ বছরে সর্বাধিক। কিন্তু সরকারি ঘোষণায় ‘কর্মসংস্থান’ নাকি প্রচুর। এখন শ্রমের বাজারে নতুন মূল সূচক ‘লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট’ (এলএফপিআর), অর্থাৎ দেশে কর্মক্ষম বয়সের মানুষের কত জন কাজের বাজারে কাজ খুঁজছেন। কর্মক্ষম মানুষ সবাই কাজ চান। ভারতের সংবিধান নাগরিককে কাজের অধিকার দিয়েছে। তবেই তো জাতীয় উন্নয়নের সার্থকতা।
কিন্তু ক্ষমতা, যোগ্যতা অনুযায়ী সবাই কাজের সুযোগ পান না। প্রবন্ধ অনুযায়ী, এখন কাজের বাজার মোটামুটি তিন রকম। এক, দিনমজুরি, বেতনের কাজ, সাধারণ ভাবে যাকে চাকরি বলি। এমন মোট চাকরির সংগঠিত ক্ষেত্র মাত্র ৫%, বাকি ৯৫% অসংগঠিত ক্ষেত্র যা আবার অনেকটাই অপ্রথাগত। সংগঠিত ক্ষেত্র ক্রমশ নির্দিষ্ট অঙ্কে প্যাকেজ-চুক্তি হয়ে যাচ্ছে যেখানে পিএফ, গ্র্যাচুইটি, ছুটি ইত্যাদির বালাই থাকে না সাধারণত। দুই, ঠিকা-কাজ যা একেবারেই অনির্দিষ্ট, অদক্ষ শ্রমিকের দর-কষাকষির (কালেকটিভ বার্গেনিং) সুযোগ কম। এই বাজার বেশ বড়। ঠিকা-শ্রমিকের চাহিদা প্রচুর। তিন, স্বনিযুক্তির কাজ। অধিকাংশ দক্ষ মহিলা এখন এই বাজারে কাজ করছেন, যদিও অনেক ঝুঁকি নিয়ে। এই সামগ্রিক কাজের বাজার অত্যন্ত অগোছালো, অবিন্যস্ত, ঝুঁকিপূর্ণ, অনিয়মিত। এলএফপিআর ২০১৮-তে ৫২% থেকে ২০২২-এ ৫৮% হলেও, তাকে সামলাতে পারছে না। ছদ্ম-বেকারত্ব বাড়ছে নানা ভাবে। কাজের বাজারে ‘একশো দিনের কাজ’ কোন শ্রেণিতে পড়ে, বোঝা মুশকিল। দিনে কয়েক ঘণ্টা কাজ, তা-ও রোজ নয়। এতে সরকারি সংখ্যাতত্ত্বে ‘কর্মসংস্থান’ বাড়তে পারে, কিন্তু বাস্তবে অকেজো।
বেকারত্বের হার কাগজে-কলমে সরকারি পরিসংখ্যানে কমছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের দারিদ্র কমছে না, ক্রয়ক্ষমতাও বাড়ছে না। ভারতের জাতীয় অর্থনীতি বা সাধারণ মানুষের সঞ্চয় বাড়ছে না। কিন্তু সঞ্চয় বাড়ছে ক্ষমতাবান শাসক রাজনৈতিক নেতাদের, গুটিকয়েক কর্পোরেট গোষ্ঠীর। এই ফাঁক ও ফাঁকি বোজাতে এবং সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ আটকাতে হরেক রকম সরকারি অনুদান, খয়রাতির অঙ্ক বেড়ে চলেছে। রাষ্ট্রে আত্মনির্ভর শ্রমের বাজার নির্মাণে সরকার ব্যর্থ।
কাজের পরিবেশ নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর। ‘স্টেট অব ইন্ডিয়া’জ় এনভায়রনমেন্ট ২০২৪’ রিপোর্টে ১৬৬টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১১২। দেশের মাটি, জল, বায়ু ও আকাশ ক্রমশ চলে যাচ্ছে অসরকারি মালিকদের কাছে, যাঁরা যথেচ্ছ ভাবে পরিবেশ ও প্রতিবেশ দূষিত করে চলেছেন। এই অবহেলার প্রত্যক্ষ ফল জাতীয় অর্থনীতিতে পড়েছে। শ্রম আইন সংস্কার করেও শ্রমিকের উন্নয়ন হচ্ছে না। উৎপাদনশীলতা বাড়লে, বাজারের বিকাশ হলে, আমজনতার ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে তবেই দেশের উন্নয়ন হবে। তখন রাষ্ট্রীয় অনুদানের জন্য হাত পাততে হবে না। দুঃখের কথা, শাসক বা বিরোধী— কোনও রাজনৈতিক দল বিনাশ্রমে রাষ্ট্রীয় অনুদানের বিকল্প খুঁজে পাচ্ছে না।
শুভ্রাংশু কুমার রায়
চন্দননগর, হুগলি
জীবনের নিরিখে
মৈত্রীশ ঘটকের ‘কাজের বাজারে অন্ধকার’ (১-৩) প্রবন্ধ ও ‘কাজ কোথায়’ (৪-৩) সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা বিভিন্ন পরিসরে প্রচার করছেন যে, দেশে বেকারত্বের হার কমেছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীও তাঁর বাজেট ভাষণে বলেছেন, কাজের বাজারে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের যোগদান আগের তুলনায় বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭-১৮ সালে বেকারত্বের হার ছিল ৬.২%, ২০২১-২২’এ কমে হয়েছে ৪.২%। এই পরিসংখ্যানটি সঠিক। কিন্তু এই শুষ্ক পরিসংখ্যানের সঙ্গে দেশ জুড়ে বেকারত্বের বাস্তব অবস্থার কোনও মিল নেই।
কাজের বাজারে যোগদানকারী মানুষের হার, বা লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট বৃদ্ধি পেলেও, ন্যায্য মজুরি দিতে পারে, এমন কাজের জোগান নিম্নমুখী। দেশের বেশির ভাগ শ্রমিক কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হন, কারণ কাজের বাজারে কাজের তুলনায় কাজ-খোঁজা মানুষের সংখ্যা বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বনিযুক্ত ব্যবসায়ীরা তাঁদের ছোট এবং মাঝারি ব্যবসায় তীব্র প্রতিযোগিতা সামলে যে লাভ করে থাকেন, তাতে ব্যাঙ্কের ঋণের কিস্তি শোধ দেওয়ার পরে তাঁদের হাতে বিশেষ কিছু থাকে না। প্রবন্ধে সঠিক ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কল্যাণ অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেশের সার্বিক আয় বৃদ্ধির সঙ্গে শ্রমের বাজারে কাজের গুণগত মান ও মজুরির বর্তমান চিত্রটি উদ্বেগজনক। সুতরাং, সত্যিই কাজের বাজার অন্ধকার।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
ভদ্রেশ্বর, হুগলি