তূর্য বাইনের ‘সরকারি স্কুল বাঁচানোর উপায়’ (৬-৫) প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই। যে হেতু শহরের চেয়ে গ্ৰাম-মফস্সলের অনেক বেশি পড়ুয়া সরকারি স্কুলের উপর নির্ভরশীল, সেই হেতু তাদের কথা সর্বাগ্ৰে ভাবা উচিত। তাই আপাতত উৎসশ্রী পোর্টালের মাধ্যমে শিক্ষক বদলি বন্ধ রাখা শ্রেয়। কেননা ইতিমধ্যে গ্ৰামাঞ্চলের অধিকাংশ স্কুলে তিন-চারটি করে শিক্ষকের পদ খালি। তার উপর প্রত্যন্ত গ্ৰামের স্কুল ছেড়ে শিক্ষকগণ বদলি হচ্ছেন এবং এক সঙ্গে অনেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ফলে নিয়মিত ক্লাস চালু রাখতে খুবই অসুবিধার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় কোনও কোনও স্কুলে করণিক বা গ্ৰুপ ডি কর্মীকে দিয়ে ক্লাস করাতে হচ্ছে। তাই ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে শিক্ষকের শূন্যপদগুলি পূরণ করে তবেই ‘উৎসশ্রী’ চালু করা উচিত। মাধ্যমিক স্কুলগুলির আর একটি বড় সমস্যা— বিজ্ঞানের কোনও ল্যাবরেটরি নেই। অথচ, পাঠ্যক্রমে রসায়নের বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলা আছে। আমরা বাধ্য হয়েই বোর্ডে এঁকে বোঝাই, কিন্তু তাতে রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি সম্পর্কে সঠিক ও সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠে বলে মনে হয় না। একমাত্র হাতেকলমে বিক্রিয়াটি করে দেখাতে পারলেই তা সম্ভব হত এবং ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্ৰহও বাড়ত। তাই ল্যাবরেটরি অপরিহার্য।অনেক স্কুলে ক্লাসঘর, বৈদ্যুতিক পাখা, পানীয় জলের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সুষ্ঠু পঠনপাঠনের লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসম্মত অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে এগুলির প্রতি সরকারের বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া উচিত। এ ছাড়া স্কুলশিক্ষাকে যাতে শিক্ষার্থীরা স্বচ্ছন্দে আনন্দের সঙ্গে গ্ৰহণ করতে পারে, তার জন্য স্কুলে স্মার্ট ক্লাসরুম, ডিজিটাল ল্যাব, প্লে জ়োন-এর ব্যবস্থা করা উচিত।সর্বোপরি সরকারি স্কুল বাঁচাতে হলে সরকারের সদিচ্ছা ও উদ্যোগ থাকা চাই।
শুভ্রা সামন্তবালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর
কেন কমছে ছাত্র
‘সরকারি স্কুল বাঁচানোর উপায়’ শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। এই রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলিতে ছাত্রসংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ বিবিধ। প্রধান কারণ নিয়মানুবর্তিতার অভাব ও শিক্ষকের অপ্রতুলতা। তা ছাড়া বহু স্কুলে শৌচাগার না থাকা, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষের অভাব, চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের ফলে সৃষ্ট বৈষম্যের কারণে স্কুলছুটের প্রবণতা বাড়ছে। সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণ বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের থেকে বেশি। তা সত্ত্বেও বেসরকারি স্কুলের নিয়মানুবর্তিতা, ইংরেজি শিক্ষার মান ও সময়োপযোগী পেশাসহায়ক পাঠ্যক্রমের কারণে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির কাছে বেসরকারি স্কুলগুলির আকর্ষণ বাড়ছে।রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলিতে ছাত্রসংখ্যা ক্রমশই কমে যাওয়ার জন্য এক শ্রেণির শিক্ষকের দায়বদ্ধতার অভাবও বহুলাংশে দায়ী। বহু স্কুলে যোগ্য শিক্ষকের পরিবর্তে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে রাজনৈতিক কর্মীরা ঢুকে পড়েছেন। ওই শিক্ষকরা স্কুলের পরিবর্তে দলের কাজে বেশি সময় দেন। সরকারি স্কুলে আরও একটা সমস্যা আছে, যেটা বেসরকারি স্কুলে নেই। মিড-ডে মিল, জনগণনা, ভোটার তালিকা তৈরি, ভোটের ডিউটির মতো নানা কাজ সামাল দিতে গিয়েও শিক্ষকদের অনেক সময় চলে যায়। ফলে ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাঁরা ঠিকমতো নজর দিতে পারেন না। এ ছাড়া গ্রাম শিক্ষা কমিটি বা স্কুল পরিচালন সমিতির নামে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও সরকারি স্কুলের পঠন-পাঠনের বহুলাংশে ক্ষতি করে।দিল্লিতে কেজরীওয়াল সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারি স্কুলগুলির অনেক উন্নতি হয়েছে। গত পাঁচ বছরে পড়াশোনার মান ও আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধার দিক থেকে সেগুলি এখন কার্যত গোটা দেশের কাছে মডেল হয়ে উঠেছে। দিল্লি সরকার শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে করেছে ২৪ শতাংশ। দিল্লির সাধারণ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবকরা বেসরকারি স্কুলের বদলে তাঁদের সন্তানদের ভর্তি করছেন সরকারি স্কুলে। এ রাজ্যেও যদি সরকারি স্কুলগুলির হাল ফেরানো যায়, তা হলেই সরকারি স্কুলে ছাত্র সংখ্যা বাড়বে, না হলে নয়।
রবীন রায়শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
পাল্টা মঞ্চ চাই
অন্যান্য রাজ্যের মতো এই রাজ্যেও বহু সরকারি স্কুল ছাত্রছাত্রীর অভাবে উঠে গিয়েছে। বহু স্কুল উঠে যাওয়ার মুখে। ধীরে ধীরে সরকারি স্কুল উঠে যাক এবং বেসরকারি স্কুল রমরমিয়ে গড়ে উঠুক— এটাই যেন এখন সব রাজ্যের সরকারের উদ্দেশ্য। এর ফলে শিক্ষার দায়িত্ব থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নিতে পারবে। দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা সম্পর্কিত কোনও প্রশ্ন উঠলেই টাকার সমস্যা আছে বলে সরকার জানিয়ে দেয়। অথচ, অন্য অনেক ক্ষেত্রে সরকারের টাকার অভাব হয় না। পশ্চিমবঙ্গে গত শতকের আশির দশকে প্রাথমিক স্তরে পাশ-ফেল তুলে দেওয়া হয়েছিল। নেতা-মন্ত্রীরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের এই সব স্কুল থেকে দূরে রাখলেন। পড়াশোনা না করে একের পর এক ক্লাসে ওঠা যায়, এই ধারণা ছাত্রদের মধ্যে গড়ে উঠল। এই ছাত্রছাত্রীরা পঞ্চম শ্রেণিতে উঠে দিশেহারা। সাধারণ যোগ-বিয়োগ বা অক্ষরজ্ঞান তো দূরের কথা, অনেক ছাত্রছাত্রী নিজের নাম পর্যন্ত সই করতে পারে না। অভিভাবকদের মনে দানা বাঁধল যে, সরকারি স্কুলে পড়াশোনা হয় না। ফলে সাধারণ পরিবারও ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ঘটিবাটি বিক্রি করে বেসরকারি স্কুলমুখী হলেন। দেখা যাচ্ছে, আশির দশকের পরে পশ্চিমবঙ্গে বেসরকারি স্কুল উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে যায়। পয়সা যার প্রকৃত শিক্ষা তার, এই পথ আরও প্রশস্ত হল।সরকারি স্কুল সম্পর্কে অভিভাবকদের মনে আরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল, যখন শিক্ষকদের জনগণনার কাজ, নানান কর্মশালা, ভোটের কাজে ব্যস্ত রাখা হল। শিক্ষকরা বহু সময় ছাত্রছাত্রী থেকে দূরে রইলেন এবং তাঁদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে থাকল। বর্তমানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল উঠে গিয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ প্রায় তলানিতে নেমে এল। বিভিন্ন অজুহাতে দিনের পর দিন স্কুল বন্ধ রাখা হল। আগামী দিনে পিপিপি মডেল-কে সামনে রেখে সুচতুর ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো উন্নতি করে স্মার্ট ক্লাসরুম, ডিজিটাল ল্যাব, প্লে জ়োন ইত্যাদি করা যেত না কি? নিশ্চয়ই যেত। সরকারি স্কুলকে বাঁচাতে হলে ছাত্র-শিক্ষক অভিভাবকদের পাল্টা মঞ্চ গড়ে তুলতে হবে।
নিখিল কবিরাজরামনগর, হাওড়া
ছুটি-সংস্কৃতি
বেসরকারি স্কুলমাত্রেই পরিকাঠামো বা শিক্ষক-শিক্ষিকার গুণগত মান প্রশ্নাতীত, এমনটা নয়। তথাপি অভিভাবকদের মধ্যে বেসরকারি স্কুলগুলিতে ছেলেমেয়েদের ভর্তির উৎসাহ বাড়ছে বই কমছে না। আসলে সরকার মানেই নিম্নমানের পরিষেবা, খারাপ পরিকাঠামো, পরিচালকমণ্ডলীর অপেশাদার মনোভাব, কর্মবিমুখ কর্মচারী— এই বিশেষণগুলি যে সরকারি ক্ষেত্রে শুরু থেকেই সাধারণের মধ্যে বদ্ধমূল ছিল, তা নয়। সময় সময় সরকারের ঘোষিত ভুল নীতি, সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের পরিষেবা প্রদানে চূড়ান্ত ঔদাসীন্যই সমাজে এমন ধারণা তৈরি করেছে। দিল্লির ক্ষেত্রে সরকারি স্কুলগুলির ঘুরে দাঁড়ানোর পিছনে রয়েছে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সরকারের বিভিন্ন দফতর যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা। কারণে-অকারণে অগুনতি ছুটি এবং ধামাধরা প্রশিক্ষণ পদ্ধতি সরকারি স্কুলগুলির থেকে বিমুখ হওয়ার আর একটি বিশেষ কারণ। ছুটি-সংস্কৃতি যে ছাত্রছাত্রীদের কোনও বিশেষ প্রাপ্তি নয়, আনন্দের বিষয়ও নয়, সেটা সরকারের বিবেচনা করা দরকার।
পিনাকী রুদ্র, কলকাতা-১২৪