বিশ্ব ক্ষুধাসূচকের তালিকায় ভারত ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১ নম্বরে।
‘না খেতে পেয়ে প্রতি চার সেকেন্ডে মৃত্যু এক জনের’ এবং ‘আর্থিক বৈষম্যে দুশ্চিন্তায় শিল্পও’ (২১-৯) প্রতিবেদন দু’টিতে প্রতিফলিত হয়েছে, আজ বিশ্ব জুড়ে ধনী-গরিবের বৈষম্য কী বীভৎস চেহারা নিয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ল্যাব’-এর তৈরি করা বিশ্ব অসাম্য রিপোর্ট ২০২২-এ ভারতকে অভিহিত করা হয়েছে ‘দরিদ্র এবং অত্যন্ত অসাম্যের একটি দেশ’ বলে, যেখানে ‘উচ্চবর্গের লোকেরা খুবই ধনী’; উপরতলার ১০% ভারতবাসীর হাতে মোট আয়ের ৫৭%, নীচের অর্ধেকের ঝুলিতে সাকুল্যে শতকরা ১৩! বৈষম্যের এই বীভৎসতা সম্পাদকীয় কলামে (‘কিনবে কে’, ২০-৯) দেখিয়েছে যে, শরীরের সমস্ত রক্ত মুখে জমা হওয়া সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।
ভারতের স্বাধীনতার জন্য যাঁরা সংগ্রাম করলেন, ব্রিটিশের অত্যাচার সহ্য করলেন, জেলে গেলেন, আত্মবলিদান দিলেন, তাঁরা যে শোষণহীন, বৈষম্যহীন এক সমৃদ্ধ দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন সফল হওয়া দূরে থাক, আর্থিক অসাম্য এমন চেহারা নিয়েছে যা তাঁদের দুঃস্বপ্নেরও অতীত। জওহরলাল নেহরু ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট ঘোষণা করেছিলেন, স্বাধীনতার উদ্দেশ্য প্রতিটি মানুষের চোখ থেকে প্রতিটি অশ্রুবিন্দু মুছে ফেলা। আজ স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের পরেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব, অসহায় মানুষের চোখে জলধারা বইছে। এক বিরাট সংখ্যক মানুষের অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটছে, বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। দারিদ্র, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বিশ্ব ক্ষুধাসূচকের তালিকায় দেশ আজ ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১ নম্বরে।
অথচ, ৭৫ বছরে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি তো কম হয়নি। অথচ এর সুফল ভোগ করছে মুষ্টিমেয় মানুষ। করোনা অতিমারির সময়েই বিশ্বে ধনকুবেরদের সম্পদ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আমাদের দেশেও বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনীদের তালিকায় অনেকগুলি নাম যোগ হয়েছে। এই আর্থিক, সামাজিক বৈষম্য কি সত্যি সত্যিই মুছে ফেলা যেত না? বর্তমান কেন্দ্রের শাসক দল স্লোগান তুলেছিল, “সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বিকাশ কাদের হয়েছে! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পুঁজিপতি-শিল্পপতিদের দেশের সম্পদ অগাধ লুটতরাজের সুযোগ করে দিচ্ছেন আর সাধারণ মানুষকে দিয়েছেন তার স্বভাবসিদ্ধ বাচনভঙ্গিতে ‘জুমলা’। ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ল্যাব এবং অক্সফ্যাম-এর রিপোর্টে প্রশ্ন জাগে, ধনতান্ত্রিক সভ্যতা সমাজের বৃহত্তর অংশের মানুষকে কোন অতল গহ্বরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে?
স্বপন মুনশি, দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান
বিপদ কোনখানে
সুগত মারজিৎ কালো অর্থনীতি সম্পর্কে লিখেছেন, “বুদ্ধিমান সরকার চাইতেই পারে যে ফাঁক গলে বেশ কিছু টাকা অসংগঠিত ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হোক— ...দেশে খানিক দুর্নীতি বাড়লেই বা ক্ষতি কী?” (‘কালো টাকা যাঁদের বাঁচিয়ে রাখে’, ২২-৯) মূল আলোচ্য বিষয় হল, কালো টাকা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে, ফলে সরকারের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় না। সেটা গণতন্ত্রের পক্ষে ভাল। সুগতবাবু এটাও লিখেছেন, “সরকারের হাতে টাকা দেওয়াটা কি সমীচীন?... সরকার ও খানিকটা নিয়ন্ত্রণবিহীন অ্যানার্কি কি ভারতীয় অর্থনীতির বেঁচে থাকার উপায়?”
এখানে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করি। অন্য ভাবে ভাবলে কালো টাকার কিছু বিশেষ ক্ষেত্র আছে, যেমন— জমিবাড়িতে প্রচুর কালো টাকা বিনিয়োগ করা হয়, ফলে জমি/বাড়ির দাম অত্যধিক বেড়ে যায়, সাধারণ মানুষের পক্ষে এটা খারাপ। বেআইনি টাকার বড় সমস্যা এটাই যে, তা সব ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে খাটানো সম্ভব নয়। আমাদের অনেকের তার অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা আছে। এ ছাড়াও এক শ্রেণির অপরাধীর হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়, যেটা সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক ক্ষমতার থেকেও অনেক বেশি খারাপ, কারণ ওই টাকা অপরাধমূলক কাজকর্মে বিনিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ফলে কালো টাকা-নির্ভর অর্থনীতি কিছু ক্ষেত্রে দেশের জন্য সুবিধাজনক হলেও, তার ক্ষতিকর দিক কিছু কম নয়, বরং বেশি। অপরাধীদের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতার বৃদ্ধি হওয়া কোনও ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
তথাগত ঘোষ, কলকাতা-৭৪
আয়করের পরিধি
‘অনুদানও বদলায় জীবন’ (১৯-৯) প্রবন্ধে অশোক সরকার ২০১৫ সালের আয়কর দাতার সংখ্যা ১০ কোটি বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু উল্লিখিত নির্ধারণ বছরে সিবিডিটি-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আয়কর দাতা ছিল ৫ কোটি ৫৭ লক্ষ, যা দেশের জনসংখ্যার মাত্র ৪.৩৫% (উক্ত বছর জনসংখ্যা ১২৮ কোটি ধরে হিসাব করলে)। আর, নোটবন্দির নির্ধারণের বছরে, অর্থাৎ ২০১৬ সালে ৬ কোটি ৮৫ হাজার করদাতা নথিভুক্ত হন, কিন্তু সেই ফসল আদায়ে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। জনসংখ্যার নিরিখে আমাদের আয়কর দাতার সংখ্যা বিগত পঁচিশ বছরের চিত্র শতাংশের হিসাবে ৩% থেকে ৬% এর মধ্যেই থেকেছে! আরও লক্ষণীয়, আয়কর দাতার সংখ্যা ব্যক্তিগত রিটার্নে যতটা বেড়েছে, কর্পোরেট করদাতা তুলনায় কম বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের পরিকল্পনার ত্রুটির ফলে ব্যক্তিগত করদাতাদের কর প্রদানে কিছু ক্ষেত্রে অনিচ্ছুক মনোভাব রয়ে গিয়েছে। অন্য দিকে কর্পোরেট দাতাদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নির্ধারিত করের হার হ্রাস, বিভিন্ন রকমের ছাড় দিয়েও করদাতার সংখ্যা কমেছে!
প্রসঙ্গত, আয়কর দাতার সংখ্যা বিশেষ করে আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশে ৯০%-এর বেশি, আর এই চিত্র আমাদের দেশে বিপরীত। অন্য একটি কারণ, ওই দেশগুলির মন্ত্রী-বিচারক-আমলাদের কর প্রত্যক্ষ ভাবে উৎসমূলে কাটা হয়। কিন্তু ভারতে সমপদাধিকারীরা উল্লিখিত বন্ধন থেকে মুক্ত বলেই, তাঁদের অনেকেই আয়কর ফাঁকি দেওয়ার লক্ষ্যে ‘বিশেষ ভাবে-শিক্ষাপ্রাপ্ত-হিসাবরক্ষক’দের নিয়োজিত করেন!
সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের অনুদানের পরিকল্পনা করেছেন, করবেন। তার অনেকগুলিই মানবিকতার খাতিরে প্রয়োজন। কিন্তু লাগাতার অনুদান-খয়রাতি নিশ্চিত ভাবেই বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক! যেমন, কোটি কোটি টাকার ব্যাঙ্কঋণ গ্রহীতাকে সুদের উপর ভর্তুকি দিলে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করাই হয়। দেশের সরকারের অনুদান-ভিত্তিক পরিকল্পনা কোনও দীর্ঘমেয়াদি ফল উৎপন্ন করতে, বা জাতীয় সম্পদ সৃষ্টি করতে সম্পূর্ণ ভাবে ব্যর্থ। এই নিয়ন্ত্রণহীন কর্মকাণ্ডের জন্য জনসাধারণকে ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে। দেশের ঋণ (দেশ ও বিদেশ) বিপজ্জনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অর্থনীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিহীন। এতে আর্থিক সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হতে বাধ্য। বর্তমানে একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হয় প্রায় ১.২৫ লক্ষ টাকা ঋণের বোঝা মাথায় করে। যুক্তিযুক্ত সাময়িক অনুদান হোক, কিন্তু স্থায়ী ভাবে জনসম্পদকে নষ্ট করতে অর্থসম্পদের খরচ করা চলে না! এ ছাড়া, অবিলম্বে বৃহৎ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করুক সরকার।
আশীষ কুমার রায়, কলকাতা-৩৭
নির্লজ্জ
‘হায়াহীন’ (১৯-৯) সম্পাদকীয় যথার্থই বলেছে, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা বিরোধীদের প্রতি কুবাক্যের আগ্নেয়গিরি রচনা করে হাততালি পান স্তাবক-সমর্থকদের থেকে, কিন্তু নিজের কী ভাবমূর্তি তৈরি করলেন, ভেবে দেখেন না। না আছে অনুশোচনা, না ভুল স্বীকারের রীতি। গালাগালির বদলে সুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা হোক, শিল্প স্থাপনের প্রতিযোগিতায় শামিল হওয়ার প্রবণতা বাড়ুক, জনগণের সমস্যা ও সমাধান নিয়ে ভাবুন সকলে। না হলে আমরা কোথায় গিয়ে পৌঁছব?
সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা, কলকাতা-১৫৪