জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের “‘ফাঁসি চাই’ যখন শর্টকাট” (৬-৯) প্রবন্ধের সঙ্গে সহমত পোষণ করে কিছু কথা। আশির দশকের শুরুর দিকে আমি মাধ্যমিক পাশ করি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে স্কুল শিক্ষকতার চাকরি পাই। সুতরাং, বাম আমলেই আমার শিক্ষার চেতনা, বাম আমলেই রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান। সেই সময়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দেখেছি বামফ্রন্টের ছাত্রসংগঠন এসএফআই-এর দাপট। কথায় কথায় বাংলার অলিতে গলিতে দেখেছি বামফ্রন্টের মিছিল-বিক্ষোভ-আন্দোলন। ধর্মঘট ছিল তার দোসর। বাম শাসনের এক দশক পেরিয়ে নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকে যখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-চিকিৎসালয়-সরকারি অফিস দফতরগুলিতে বাম শাসনের দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে উঠছে, সেই সময়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপ জ্যোতি বসু সরকারের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস এমনকি তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসও দেখাত না। এক সময় রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের অবস্থা এমন হয়েছিল যে, অনেকেই তখন কংগ্রেসকে সিপিএমের ‘বি টিম’ বলে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি। সেই সময় বামফ্রন্টের সামনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘একা কুম্ভ’ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রবন্ধকার ঠিকই বলেছেন, নব্বইয়ের দশকে রাজ্যে যখন একের পর এক নারী-নির্যাতন ও ধর্ষণ-খুনের ঘটনা ঘটছে, সেই আবহে এক মূক-বধির ধর্ষিতা বালিকাকে নিয়ে মহাকরণে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জ্যোতি বসু সরকারের কাছে বিচার চাইতে। সে দিন জ্যোতিবাবুর পুলিশ তাঁর চুলের মুঠি ধরে বার করে দিলেও মমতার এই প্রতিবাদকে সরবে-নীরবে অনেকেই সমর্থন করেছিলেন।
১৯৯৩ সাল। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেসের ‘আগুনে নেত্রী’ তথা সভাপতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচনে সিপিএমের ছাপ্পা-রিগিং বন্ধ করতে ও নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনতে সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের দাবিতে ২১ জুলাই মহাকরণ অভিযানের ডাক দেন। সেই অভিযানে পুলিশের গুলিতে যুব কংগ্রেসের একাধিক আন্দোলনকারী প্রাণ হারান। তার পর তৃণমূল কংগ্রেস গঠন, বিধানসভা ভাঙচুর, সিঙ্গুরে জমি আন্দোলন— অনেক জল বয়ে গেছে গঙ্গা দিয়ে। তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাতা ও সুপ্রিমো হিসাবে বাম জমানার অন্যায়, অবিচার ও অরাজকতার বিরুদ্ধে তিনি হয়ে উঠেছিলেন রাজ্যবাসীর প্রতিবাদী মুখ। তারই প্রতিফলন ঘটেছিল ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে।
কিন্তু ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত পার্ক স্ট্রিট থেকে আর জি কর— সিন্ডিকেট-দালালরাজ-কাটমানি-মহিলা নির্যাতন-গুন্ডারাজ-স্বজনপোষণ-ছাপ্পা-রিগিং-ঔদ্ধত্য— সবেতেই বামফ্রন্ট যেখানে ছেড়ে গেছে তৃণমূল সরকার ঠিক সেখান থেকেই শুরু করেছে। প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন, কাঠুয়া-উন্নাও-হাথরস-মণিপুর প্রসঙ্গে মমতা অতিশয় সরব থাকেন, অথচ নিজ রাজ্যে নারী-নির্যাতন ও ধর্ষণ-খুনের গুরুতর বিষয়গুলি তিনি উড়িয়ে দিতে চান। এ এক অদ্ভুত দ্বিচারিতা।
ইতিপূর্বে রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে এই সরকার যেমন সংগঠিত অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও ঠিক সেই একই অভিযোগ উঠেছে। আর জি কর-কাণ্ডে পুলিশের কাণ্ডজ্ঞানহীন ভূমিকা নাগরিক সমাজের মনে চরম আঘাত হেনেছে। এই ঘা শুধুমাত্র বিধানসভায় অপরাজিতা বিল পাশে বিন্দুমাত্র উপশম হবে না, তা তিনি বিলক্ষণ জানেন।
হারান চন্দ্র মণ্ডল
কলকাতা-১২৩
অসাম্য বাড়ছে
জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা প্রবন্ধটি পড়ে কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তার প্রথমটি হল— ক্ষমতায় থাকার একটা দম্ভ ও অহঙ্কার এ ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে-হেতু পঞ্চায়েত স্তর থেকে লোকসভা পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে একক ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে এই সরকার, তাই সে যা বলবে, যা করবে, সব ঠিক। বাকিরা যে যা-ই বলুক, সেটা ভুল— এ রকম ভেবে নেওয়াটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। এই কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ফাঁসির কথা, এনকাউন্টারের কথা এসেছে। আর জি করের বিচার চাই— সবাই বলছে। কিন্তু নাগরিক সমাজের চাওয়া, বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিচার চাওয়া, আবার শাসক দলগুলোর বিচার চাওয়া— সব কি এক? কার কাছে কে বিচার চাইবে? খাস কলকাতায় আর জি কর হাসপাতালের ভিতরে এক নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে এক কর্তব্যরত চিকিৎসককে। সুতরাং, রাজ্যের শাসক দলের কাছেই তো বিচার চাইবে জনগণ। এখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী যিনি, পুলিশ মন্ত্রীও তিনি, আবার মুখ্যমন্ত্রীও তিনি। আবার প্রধান বিরোধী দল যে রাজ্যগুলোতে শাসক, সেই সব রাজ্যেও আকছার এমন ঘটনা ঘটেছে। তার বিচার কতটা পাওয়া গিয়েছে, দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, ঘটনা যা ঘটছে, তার জন্য যে বা যারা দায়ী, তারা কোনও না কোনও ভাবে শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ। ফলে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। এমনকি টাকার বিনিময়ে মুখ বন্ধ করাতে চাওয়া, সাক্ষীদের দুর্ঘটনায় আহত, নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আসামিদের ধরতে গড়িমসি করা হয়, ধরলেও তারা জামিন পেয়ে যায় সহজেই, তাদের আবার মালা পরিয়ে মিছিল বার করে অভ্যর্থনা জানানো হয়। সত্যিই যদি সকলে এক সঙ্গে বিচার চাইত, তা হলে ঘটনা ঘটার পর থেকে এত বাহানা, এত অসঙ্গতি, এত প্রশ্নচিহ্ন কি থাকত?
সমাজের নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের যে অবক্ষয় ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী, সে দিকে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকগোষ্ঠীর খেয়াল আছে কি? পর্নোগ্রাফি, অশ্লীলতা ও অপসংস্কৃতির প্রভাব যে ভাবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মদতে ঘটে চলেছে, তা কি রোধ করতে কোনও ব্যবস্থা করা যায় না? দুর্নীতি রোধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা উচ্চ স্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিতে পারতেন না? শিক্ষাব্যবস্থাও কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কল্যাণে আজ সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। শিক্ষার মানের ক্রমাগত অবনমনের ফলে সমাজের মধ্যে থাকা বিবেক ও মনুষ্যত্বকে তা ধ্বংস করে দিতে চাইছে। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য জলাঞ্জলি যাচ্ছে। সে দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। কিন্তু ধনবাদী যুগে রাজনৈতিক দলগুলো উদ্যোগপতিদের সেবা করতে গিয়ে এক দিকে দেশের সমস্ত জনতাকে ছিবড়ে বানিয়ে দিচ্ছে, অন্য দিকে নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ধারেকাছে না গিয়ে চূড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাঝখানে ধনীর ধনসম্পদ বাড়ছে শুধু নয়, বেশির ভাগ সম্পদ মুষ্টিমেয়র হাতে সঞ্চিত হচ্ছে। পরিণামে মানুষে মানুষে সম্পর্কগুলো নষ্ট হচ্ছে, লিঙ্গ অসাম্য বাড়ছে।
বিদ্যুৎ সীট
জগদল্লা, বাঁকুড়া
(অ)ধর্মের কল
“‘ফাঁসি চাই’ যখন শর্টকাট” শীর্ষক প্রবন্ধটি অত্যন্ত সময়োচিত এবং শক্তিশালী। আর জি করের ঘটনা আমাদের চেতনার ভিতকে নাড়িয়ে তছনছ করে দিয়েছে। নাগরিক সমাজ যে ভাবে গর্জে উঠেছে, তাতে শাসকের অনাচারের দাপট ফিকে হতে চলেছে। এ ভাবে যে এত বড় আন্দোলন বাংলার বুকে গজিয়ে উঠবে, তা সাধারণ মানুষ কেন, শাসকরা স্বপ্নেও ভাবেননি। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে যেমন, তেমনই অধর্মের কলও বাতাসে নড়ে। মিথ্যাচার, চালাকি দিয়ে শাসনতন্ত্র চালানো সাংঘাতিক দ্বিচারিতা। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রক্রিয়া দিয়ে ভোট নামক মচ্ছব পার করা যায়, কিন্তু গণরোষ-আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বেরিয়ে আসে, তাকে কিছুতেই রোধ করা যায় না।
আর জি করের বিচার চাই— এই তীব্র কণ্ঠস্বর যে এত উত্তাল হবে, শাসক কল্পনা করতে পারেননি বলেই তাঁদের কণ্ঠেও ‘ফাঁসি চাই’ বলা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। দেরিতে হলেও মানুষ বুঝতে পেরেছেন, অনির্দিষ্ট কাল ধরে এ ভাবে বহুস্তরীয় দুর্নীতির সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সুফল ক্ষমতাধারীরা ভোগ করে যেতে পারেন না।
মনশ্রী চৌধুরী
কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান