রবিবাসরীয় ‘অকালবোধনের কাছে হেরে গেল বাসন্তী পুজো’ (১১-৯) লেখাটির সূত্রে কিছু বিষয়ের অবতারণা করছি। শরৎকালের শিউলি, আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ও ঝলমলে রোদ জানান দেয়, পুজো আসছে। সকলেই নব আনন্দে মেতে ওঠেন। আমরা প্রায়ই শুনি দু’শো, তিনশো, চারশো বছরের প্রাচীন পুজোর কথা। অনেকে আবার আরও প্রাচীন পুজো বলে নিজেদের পুজোকে অভিহিত করেন। কিন্তু, যতই প্রাচীন হোক না কেন, তার একটা তথ্যনির্ভর ইতিহাস থাকতে হবে; কাল্পনিক বা মনগড়া ইতিহাসের কোনও ভিত্তি নেই। সে দিক দিয়ে বলতে গেলে, আমরা শরৎকালে যে দুর্গাপুজো করি, সেটি শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধন হিসেবেই কথিত। পুরাণে দেবী চণ্ডীর কথা বলা আছে, সেখানে চণ্ডী স্তোত্রও আছে, তা আনুমানিক কয়েক হাজার বছর আগের। আবার পুরাণ এও বলছে, রাজা সুরথই বঙ্গদেশে প্রথম দুর্গাপুজো করেন। তবে মনে রাখতে হবে, সেটা ছিল চৈত্র মাসে, এখন যা বাসন্তী পুজো নামে অভিহিত। কিন্তু পুরাণে কোথাও শারদীয়া দুর্গাপুজো বা শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনের উল্লেখ নেই, যেটা আমরা শরৎকালে করে থাকি। আদিকবি বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণেও দুর্গাপুজো বা শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনের তত্ত্ব নেই। কিন্তু বাংলার আদিকবি কৃত্তিবাস রচিত রামায়ণে প্রথম পাওয়া গেল অকালবোধনের কথা। কৃত্তিবাস তাঁর রচিত ‘রামায়ণ’-এ এই তত্ত্ব সংযোজন করলেন।
চৈত্র মাস নয়, শরৎকালে দেবী দুর্গার পুজো হয়েছিল বলে সেটি অকালবোধন, যা বাঙালির অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব। এর থেকে একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া যায়, বঙ্গদেশে শারদীয়া দুর্গাপুজোর ইতিহাস বা প্রাচীনত্ব সবটাই কৃত্তিবাসের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। যে-হেতু কৃত্তিবাসের রচিত রামায়ণেই আমরা শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনের তত্ত্ব বা শরৎকালে দুর্গাপুজোর কথা প্রথম জানতে পারি, কাজেই সেই সময়কার বাঙালি সমাজ তার অব্যবহিত পরেই শরৎকালে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন, তার আগে নিশ্চয়ই নয়! তথ্য বলছে, কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামচন্দ্রের অকালবোধনের কথা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে এই উপমহাদেশের তৎকালীন বঙ্গদেশের তাহিরপুরের (বর্তমান বাংলাদেশ) ধর্মপ্রাণ রাজা কংসনারায়ণ ১৪৮০ সালে মহাসমারোহে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। তার পর থেকেই বঙ্গদেশে শরৎকালে দুর্গাপুজোর চল শুরু হয় নিষ্ঠাবান সচ্ছল পরিবারে, যা ব্যাপক ভাবে বিস্তারলাভ করেছিল কোম্পানির শাসনকালে। শোনা যায়, কোম্পানির শাসনকালে সাবেক কলকাতায় দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে রাজন্যবর্গের মনোরঞ্জনের জন্য এলাহি ব্যবস্থার আয়োজন থাকত। পরে কলকাতার মতো গ্রামেও রাজা ও জমিদাররা দুর্গাপুজো শুরু করেন।
প্রসঙ্গত, ১৮৪০ সালে ইংরেজ সরকার ‘দশ নম্বরি’ নামে আইন জারি করে হিন্দুদের উৎসব ও পুজো-পার্বণে ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করলে হুগলির গুপ্তিপাড়ায় বারো জন বন্ধু মিলে দুর্গাপুজো শুরু করেন, যা পরবর্তীতে বারো ইয়ারির পুজো বা বারোয়ারি পুজো নামে খ্যাত হয়। এর পর থেকেই শুরু হয়েছিল চাঁদা তুলে শারদীয়া দুর্গাপুজোর প্রচলন, যার ধারাবাহিকতা শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনের কাহিনির পর থেকেই চলে আসছে।
পরেশনাথ কর্মকার
রানাঘাট, নদিয়া
পুজোর উত্তরণ
জহর সরকারের ‘এও এক কঠিন প্রতিযোগিতা’ (১৪-৯) প্রসঙ্গে বলি, কলকাতার পুজোকে ‘ঐতিহ্য’ বলাটা সত্যের অপলাপ হবে। ১৯৮৫ সালে এক কর্পোরেট রং কোম্পানি নিজেদের নামে শারদ সম্মান ঘোষণা করে সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল আপাতনিরীহ একটি স্লোগান, ‘শুদ্ধ শুচি, সুস্থ রুচি’। এর প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী হবে, তা কেউ কল্পনা করতে পারেনি।
পুজোর আদি পর্বে থাকত সাদামাটা বাঁশের কাঠামোর উপর নীল সাদা লাল রঙের ডেকরেটারের কাপড়। আর চটুল হিন্দি গান, আলোর সর্পিল সচলতা। মূর্তি গড়ার একদম প্রথম শ্রেণির কারিগর বলতে রমেশ পাল, রাখাল পাল ছিলেন। তাঁরাই ভিড় টেনে দিতেন। তখন ছিল দমকল, বাগবাজার, সঙ্ঘশ্রী প্রভৃতি নামকরা দুর্গাপুজো। এর পর কলকাতায় হাজির জঙ্গলমহলের এক টুকরো নিজস্ব সংস্কৃতি, ছৌ নাচ, ঢেঁকি, দক্ষিণ ভারতের কোনও মন্দিরের প্রতিরূপ। মণ্ডপের অভিনবত্বে প্রথম নজর কাড়ে ভাঁড়ের প্যান্ডেল। শুরু হল মাটির প্রদীপ, কল্কে দিয়ে দৃষ্টিনন্দন কলাশিল্প। পরতে পরতে সৃষ্টিশীলতা— রাগরাগিনীর আলাপ শোনা গেল পুজোমণ্ডপে। হিন্দি গান নিল বিদায়।
নতুন করে পাওয়া গেল মূর্তি গড়ার ধরন, প্যান্ডেলের আঙ্গিকের ধারা, আলোর রোশনাইয়ের যথাযথ ব্যবহার। দু’শো-আড়াইশো বছরের বনেদি পুজোর ঘরানাকে বংশ পরম্পরায় ধরে রাখা সনাতন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এর সঙ্গে মিশে থাকে। সাবেক একচালার প্রতিমা, সঙ্গে বাহারি ডাকের সাজের সূক্ষ্ম কারুকার্য। উত্তরণের সর্বশেষ সংযোজন রেড রোডে প্রতিমার বিশেষ রোড শো। এ সবের নির্যাস বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেওয়া, সবই একই সূত্রে বাঁধা।
অঞ্জন কুমার শেঠ
কলকাতা-১৩৬
বাঙালির প্রাপ্তি
‘ইউনেস্কো-র গন্তব্যের ২৪টি পুজো বাছাই নিয়ে বিতর্ক’ (১৯-৯) সংবাদটি পড়ে মনে হল, ১ সেপ্টেম্বর সংবর্ধিত হওয়া ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরা ‘বাংলার দুর্গাপুজো অনুভব করতে’ তিন সপ্তাহ পরে কলকাতায় আসার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। সে সুযোগ যখন ছিল, তখন তড়িঘড়ি পুজোর এক মাস আগে ওঁদের এনে নানা রকম সমালোচনার মুখোমুখি হয়ে পদযাত্রা, কর্মদিবস নষ্ট, স্কুল ছুটি ও পরীক্ষা বাতিল করে কী প্রমাণ করা হল? দুর্গাপুজো কেন্দ্রিক স্বীকৃতি উদ্যাপন ও ইউনেস্কো কর্মকর্তাদের হাতেগরম উচ্ছ্বাস বা শহরের নাগরিক উন্মাদনা দেখানোর বড় সুযোগ ছিল তো তখনই। সে রকম কথা বলে রাখলেই হত তাঁদের সঙ্গে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যেত। দু’বার ঢালাও খরচের বোঝা বইতে হত না আর্থিক টানাটানিতে জর্জরিত রাজ্য সরকারকে।
সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা
কলকাতা-১৫৪
সবার পুজো
রাজ্য সরকার পুজো কমিটিগুলোকে অনুদানের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাতে কি পুজোর নান্দনিক দিকগুলো স্বচ্ছ হচ্ছে? একটি ছোট পাড়ায় পুজোর জন্যও চাঁদা ধার্য হয়। পাড়ার উদ্যমী অল্পবয়সিরা চাঁদা সংগ্রহ করতে গিয়ে অষ্টমী পুজোয় পঙ্ক্তি ভোজে অংশগ্রহণ করার কুপন বিতরণ করে। মুশকিল হল, যে পরিবারে সদস্যসংখ্যা বেশি তাদের নিয়ে। অর্থাৎ, সংসারে পাঁচ জনের বেশি সদস্য হলেই চাঁদার পরিমাণ বাড়াতে হবে! মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি দিন দিন পুজোর অনাবিল আনন্দ থেকে সরে যাচ্ছি? বাজেটকে ধরাশায়ী করে না-ই বা হল পঙ্ক্তি ভোজে পোলাও, সুস্বাদু উপকরণ ও দই-মিষ্টি। যদি পাড়ার সবার স্বতঃস্ফূর্ত ভিড়ে উপচে পড়ে উৎসব-অনুষ্ঠান, তার মাহাত্ম্য কি বেশি নয়?
নারায়ণ সাহা
কলকাতা-৮৪
পুকুর সংস্কার
বোলপুরে ভুবনডাঙা অঞ্চলের দু’টি বড় পুকুর দীর্ঘ দিন যাবৎ কচুরিপানায় পরিপূর্ণ। এই পুকুর দু’টি এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। এ দু’টির সংস্কার করা জরুরি। কিছু মানুষ বলেন, এই পুকুর বিশ্বভারতীর অধীন। আবার কেউ বলেন, বোলপুর পুরসভা এদের মালিক। মালিক যে-ই হন না কেন, এই পুকুরগুলির সংস্কার হলে মানুষের ও প্রকৃতির মঙ্গল। তাই প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
দীপাঞ্জন বাগচী
শান্তিনিকেতন, বীরভূম