Asia Cup 2022

সম্পাদক সমীপেষু: ক্রিকেটে যুগ্ম জয়ী

দুর্নীতিগ্রস্ত পারিবারিক শাসনে জ্বালানি তেল, গ্যাস এক ফোঁটাও ছিল না। ছিল খাদ্যের অভাব। আমদানি করার মতো অর্থও ছিল না সরকারের হাতে। সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ থাকলেও খাবার, জ্বালানি সরবরাহের অভাবে না পারছিলেন খেতে, না পারছিলেন কোথাও যেতে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:০৯
Share:

চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা।

একটা দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি বিধ্বস্ত। জনরোষে দেশ থেকে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী— দু’জনেই পালিয়েছেন। যদিও হালে পালিয়ে যাওয়া প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফিরে এসেছেন। ক্রুদ্ধ জনতা প্রেসিডেন্টের বাসভবন দখল করে নিয়েছিল। দুর্নীতিগ্রস্ত পারিবারিক শাসনে জ্বালানি তেল, গ্যাস এক ফোঁটাও ছিল না। ছিল খাদ্যের অভাব। আমদানি করার মতো অর্থও ছিল না সরকারের হাতে। সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ থাকলেও খাবার, জ্বালানি সরবরাহের অভাবে না পারছিলেন খেতে, না পারছিলেন কোথাও যেতে।

Advertisement

অন্য দেশটি বহু বছর ধরে এক ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিপন্ন। তীব্র অর্থ সঙ্কটের সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর আইনশৃঙ্খলা-জনিত সমস্যা রয়েছেই। মৌলবাদী, সন্ত্রাসবাদী, সামরিকতন্ত্র মিলে দেশটার নাজেহাল অবস্থা। সরকার আসে-যায় মিলিটারির ইশারায়। আইনশৃঙ্খলার সমস্যা এমন, কোনও দেশ কিছু দিন আগে পর্যন্ত এ দেশে খেলতে আসত না। ক্রিকেটের হোম ম্যাচ এরা খেলত বিদেশে। এদের রাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতার এত অভাব যে, এরা নিজেদের ভেঙে পড়া অর্থনীতি মজবুত করার জন্য আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থার কাছ থেকে ঋণ পর্যন্ত পাচ্ছে না। প্রকৃতিও এই মুহূর্তে দেশটির উপরে বিমুখ। দেশের বিস্তীর্ণ অংশ বন্যার প্রকোপে ছারখার হয়ে গিয়েছে। এত কিছু ছাড়াও দু’দেশের মধ্যে আরও একটা সাধারণ বিষয় আছে। উভয়ই চিনের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে একটা দেশ বর্তমানে পুরোপুরি দেউলিয়া, অপরটি হওয়ার পথে।

এই রকম মানসিক অবস্থা নিয়ে খেলতে এসে তুলনায় সচ্ছল ভারত এবং বাংলাদেশকে উড়িয়ে দিয়ে এশিয়া কাপ ক্রিকেটের ফাইনালে ওঠে শ্রীলঙ্কা আর পাকিস্তান। আর ঠিক এখানেই ওরা জিতে গিয়েছে। হাজার সমস্যাকে পাশে ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে তাদের ফাইনালে ওঠা মানে বিজয় কেতন ওড়ানো। দিনের শেষে মাঠের খেলায় হয়তো শ্রীলঙ্কা একা জিতেছে, এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা, কিন্তু জীবনের খেলায়, দেশবাসীর ক্লিষ্ট মুখে হাসি ফোটানোর খেলায়, এই দু’দলই জয়ী।

Advertisement

পার্থ নন্দী, শেওড়াফুলি, হুগলি

প্রত্যাবর্তন

অবশেষে শ্রীলঙ্কা সগৌরবে তার ক্রিকেট মহিমায় ফিরল, অনেকটা রূপকথার মতো। গত কয়েক মাস ধরে দেশটা চরম অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। এখনও অবস্থা যে স্থিতিশীল, বলা যাবে না। টুর্নামেন্টের শুরুর আগেও এই টিমকে নিয়ে কেউ বিশেষ স্বপ্ন দেখেনি। প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের কাছে বিধ্বস্ত হওয়ার পর বলাবলি শুরু হয়ে যায় যে, শ্রীলঙ্কা হয়তো সুপার ফোরেই উঠতে পারবে না। সেখান থেকে টানা পাঁচ ম্যাচ জিতে এশিয়া কাপ জয়। এই জয় গোটা দেশকে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখাবে, তা বলাই যায়। কুমার সঙ্গকরা, মাহেলা জয়বর্ধনেদের অবসরের পর গরিমা হারিয়েছিল শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট। দাসুন শনকার এই টিম শুধু এশিয়া সেরা হল না, একই সঙ্গে পুনর্জন্মও ঘটল শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের।

গত কয়েক বছর ধরে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল সে ভাবে নিজেদের মেলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছিল। এই বছরের শুরুতেই অস্ট্রেলিয়া নিজের দেশের মাটিতে টি-টোয়েন্টি সিরিজ়ে এবং পরে ভারতও নিজের দেশের মাটিতে আয়োজিত টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতায় শ্রীলঙ্কাকে পর্যদুস্ত করে। এমনকি নিজেদের দেশের মাটিতেও অস্ট্রেলিয়ার কাছে টি-টোয়েন্টি সিরিজ়ে পর্যদুস্ত হয় তারা। এর পরেই খেলা ঘুরতে থাকে। নিজেদের দেশের মাটিতেই অস্ট্রেলিয়াকে ওয়ান-ডে সিরিজ়ে তারা ৩-২ ব্যবধানে হারিয়ে দেয়। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তিন টেস্টের সিরিজ় ড্র করেছে তারা। একটি ম্যাচে ইনিংস জয়ী হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে শেষ বারের মতো অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে টেস্ট ম্যাচে জয়ী হয়েছিল শ্রীলঙ্কা। অতএব বিগত দু’মাসের মধ্যে যে ভাবে সমস্ত প্রতিকূলতা সামলে নিজেদের ঘর গুছিয়ে নেয় ক্রিকেট দলটি, তাতে এই এশিয়া কাপ জয় তাদের প্রাপ্যই ছিল।

প্রতিযোগিতার শুরুতে আফগানিস্তানের কাছে হার যে তাদের মনোবলে একটুও চিড় ধরাতে পারেনি, তা সামগ্রিক পরিসরে তাদের ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে। টি-টোয়েন্টিতে ক্রমপর্যায়ে ভারত এক নম্বর স্থান দখল করে থাকলেও তাদের বিপক্ষে খেলতে নেমে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের মনে জেতার চেয়েও ভাল খেলার জেদটা অফুরান ছিল। অন্য দিকে, সেটার যথেষ্ট অভাব ছিল ভারতীয় ক্রিকেটারদের মানসিকতায়। বিপরীতে শ্রীলঙ্কা খেলাটাকে উপভোগ করেছে, নিজেদের সমস্তটুকু উজাড় করে তারা খেলে গিয়েছে। ফলস্বরূপ, এশিয়া ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ আসনটি দখল করেছে তারা। সাহসে ভরপুর এই শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। প্রতিকূলতাকে পাশে রেখে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে ক্রিকেট মহলে দাগ কেটে যাওয়ার যে ইতিবাচক মানসিকতা ও পেশাদারিত্ব তারা দেখিয়েছে, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।

দাসুন শনকার ক্রিকেটসুলভ শীতল মানসিকতা এখানে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির কথা মনে করিয়ে দেয়। ভারতীয় ক্রিকেট দলেরও শ্রীলঙ্কার এই ইতিবাচক মানসিকতাকে গ্রহণ করা উচিত। শুধুমাত্র আইপিএল-এর মতো জনপ্রিয় লিগে পেশাদারিত্ব ফুটিয়ে তুললে হয় না, অন্যান্য টুর্নামেন্টেও সেটা প্রকাশ করা প্রয়োজন। এর জন্য অদম্য এক মানসিকতা প্রয়োজন হয়। ভারতীয় ক্রিকেটারদের এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। এই বছরেই অস্ট্রেলিয়ায় আয়োজিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এই শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল যে নতুন এক সমীকরণের জন্ম দিতে চলেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

শুভজিৎ বসাক, কলকাতা-৫০

ব্যর্থ ভারত

২০১৩ সালে শেষ বার মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের পর গত ন’বছরে আর কোনও আইসিসি খেতাবের মুখ দেখেনি ভারত। মাঝে ওয়ান-ডে বিশ্বকাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ-সহ মোট সাতটি বড় আইসিসি টুর্নামেন্টে অংশ নিলেও প্রত্যেকটি থেকেই খালি‌ হাতে ‌ফিরতে‌‌ হয়েছে টিম ইন্ডিয়াকে। এ বছরই আইপিএল-এ দাপিয়ে পারফর্ম করা তারকা ক্রিকেটাররা আইসিসি টুর্নামেন্টে দেশের জার্সিতে প্রয়োজনের সময়ে বারংবার ব্যর্থ হয়েছে। এখানেই আইপিএল এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়।

গত কয়েক মরসুমে আইপিএল নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড যে পরিমাণ মাতামাতি করছে, তাতে আর্থিক দিকটা বাদ দিলে ভারতীয় ক্রিকেটের সার্বিক মানের কতটা উন্নতি হয়েছে, সেই বিষয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যায়। এক দিকে আইপিএল মরসুমের দৈর্ঘ্য বেড়েছে, অন্য দিকে একের পর এক আইসিসি টুর্নামেন্টে ব্যর্থতাকে সঙ্গী করে খালি হাতে ফিরে এসেছেন কপিল, ধোনির উত্তরসূরিরা। আগামীতে আইপিএল মরসুম আরও দীর্ঘ করার কথা ফলাও করে ঘোষণা করেছে বিসিসিআই। সোনার রাজহাঁস দিয়ে কোষাগার পূর্ণ করার নেশায় মত্ত বিসিসিআই। কিন্তু তারা একের পর এক আইসিসি টুর্নামেন্টে দেশের ব্যর্থতার লম্বা তালিকাটা বেমালুম এড়িয়ে ‌যেতে চাইছে।

অন্য দিকে, নিউজ়িল্যান্ড, ইংল্যান্ডের মতো দল আইপিএল-এর ন্যায় অর্থসমৃদ্ধ টুর্নামেন্ট ছাড়াই নিয়মিত আইসিসি খেতাবগুলি জিতে নিচ্ছে। বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্রিকেট বোর্ডের বোঝা উচিত, গাওস্কর, সচিন, কুম্বলে বা আজকের বিরাট কোহলিরা কেউই আইপিএল-এর সৌজন্যে এমন শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে পৌঁছয়নি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই এঁদের ‘লেজেন্ড’ বানিয়েছে।

সুতরাং, বিশ্বমঞ্চে সমীহ আদায় ‌করতে ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক— উভয় ধরনের ক্রিকেটকেই সমান প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন।

সুদীপ সোম , হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement