এই আমার দেশ ভারতবর্ষ।
সেমন্তী ঘোষের লেখা, ‘কিছু শিখলাম না কেন’ (১৪-৮) শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ে মনে হল, প্রতিটি অক্ষরই ঠিক। আমরা মানুষ হতে পারিনি, শুধু নুনের পুতুল হয়ে নুনসাগরে মিশে গেলাম। ধর্মভেদ, জাতিভেদ নিয়ে প্রবল গর্জন তুললাম, কিন্তু কী পেলাম? শুধু দ্বেষই রইল সম্বল, আমার দেশ কোথায় দূরে হারিয়ে গেল। আমি আর ‘মানুষ’ পরিচয়ে বাঁচি না, কোনও বহুমাত্রিক পরিচয়েও নয়, শুধু একক পরিচিতির সঙ্কীর্ণ পরিসরে থাকি এই আমার আমি। তাতেও রক্ষা নেই। পার্কে শুয়ে থাকা প্রৌঢ় আচমকা আক্রমণে বিমূঢ়। দেখাতে পারেননি আধার কার্ড, বলতে পারেননি তিনি হিন্দু না মুসলিম। আমি দেশের নাগরিক, এমত বলার স্পর্ধা তো তাঁর হয়ইনি। এই আমার দেশ ভারতবর্ষ।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই তাঁর ভাষণে জওহরলাল নেহরু গান্ধীজির নাম না করেও বললেন, এই সময়ের শ্রেষ্ঠ মানুষ চাইছেন যেন প্রত্যেক দেশবাসীর চোখের জল মোছানো হয়। কিন্তু আজও ক্ষুধার নিরিখে ভারত বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে পিছনের সারিতে। পরিসংখ্যান বলছে, ছোট ছেলেমেয়েদের সঠিক বৃদ্ধি হচ্ছে না পুষ্টির অভাবে। আর কিসের স্বাধীনতার মহোৎসব? টাকার পাহাড় জমানো দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘বন্দে মাতরম্’ বলা নিজেরই অপমান। মনটা হাহাকার করে ওঠে যখন রাজস্থানের স্কুলছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় উচ্চবর্ণের শিক্ষকের জল খাওয়ার পাত্র ছুঁয়ে ফেলার জন্যে, এই স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উদ্যাপনের আগের দিনেই। এর চেয়ে বরং আমি ‘একা’ হয়েই বাঁচি।
স্বাধীনতার প্রারম্ভকাল থেকেই রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতার লোভে দেশ তিন টুকরো হয়েছিল। আমার শিক্ষক পিতার কাছে স্বাধীনতা ও দীর্ঘশ্বাস সমার্থক ছিল। বলতেন, এটি দেশভাগ দিবস। জন্মেছিলেন, অবিভক্ত ভারতের খুলনা জেলার গ্রামে। কপোতাক্ষের ঘাট থেকে সোজা স্টিমার আসত কলকাতার ঘাটে। এখানেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। সে সময়ের আর পাঁচ জনের মতো তিনিও ‘স্বদেশি’ ছিলেন। বাবা দুঃখ করে বলতেন, ভারতের পশ্চিম ভাগে বসে কবি ইকবাল ভাবতেও পারেননি যে, তাঁর ‘হিন্দুস্তা’ খণ্ডিত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান হয়ে যাবে। আমার বাবা-পিসিরা স্বাধীনতার সোনার স্বপ্নে আগে থেকেই কয়েকটা খাদির কাপড়ের তেরঙা পতাকা তৈরি করে রেখেছিলেন ওই বিশেষ দিনে পতাকা তুলবেন বলে। কিন্তু গভীর হতাশায় তাঁরা দেখলেন যে, তাঁদের ‘সাত পুরুষের বাস্তুভিটে’ পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেছে। খাদির তেরঙা বাক্সবন্দি হয়ে রইল।
আন্দামানে সেলুলার জেল মিউজ়িয়ামে যখন এক সঙ্গে তিন জনকে ফাঁসি দেওয়ার জায়গাটায় আলো ফেলে, বিপ্লবীদের বলিদান গাথা শোনানো হয়, তখন সবার চোখ জলে ভেসে যায়। কাঁদো, ভারতবাসী কাঁদো, স্বাধীন ভারতে নিজেদের পরিস্থিতির জন্যেও। কখনও রাজনীতির রথীরা হুমকি দেন, এ মাটি থেকে উৎখাত করে দেবেন বলে। পতাকা তোলার সময় জোরে ‘জয় হিন্দ’ বলতে বুক কাঁপে। অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগি। মনে মনে আওড়াই, “আমারই হাতের স্নেহে ফুটেছিল এই গন্ধরাজ/ যে-কোনও ঘাসের গায়ে আমারই পায়ের স্মৃতি ছিল...।”
শিখা সেনগুপ্ত, কলকাতা-৫১
স্বপ্নের ময়নাদ্বীপ
‘কিছু শিখলাম না কেন’ শীর্ষক প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে কিছু কথা বলতে চাই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে হোসেন মিয়া কি মুসলমান? সমস্ত উপন্যাসে তাঁর ধর্মাচরণের চিহ্ন নেই। রহস্যহময়, ভয়ঙ্কর মানুষটির একমাত্র স্বপ্ন ময়নাদ্বীপে নতুন এক পৃথিবী গড়ে তোলা। সেখানে শুধু মানুষের আশ্রয়, পরিশ্রমী, প্রজননক্ষম সম্পূর্ণ মানুষ। সে জন্য তাঁর সাফ কথা— “হিঁদু নিলি মসজিদ দিমু না। ...মুসলমানে মসজিদ দিলি, হিঁদু দিব ঠাকুরঘর— না মিয়া, আমার দ্বীপির মদ্যি ও কাম চলব না।” তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা এতটাই প্রবল যে, বিপিনকে করেছে সে দ্বীপের মোড়ল, তাঁর নৌকার বড় মাঝি কুবের। দু’জনেই হিন্দু। এমনকি, বৃদ্ধ বসির মিয়ার ‘ছেলেমানুষ বউটি’র সঙ্গে এনায়েতের প্রগাঢ় সম্পর্ক হেতু তাদের নিকা করতে বাধে না তার।
উপন্যাসের কোনও চরিত্রই সাম্প্রদায়িকতার শিকার নয়। এই সমাজে সম্প্রদায় ভেদে ধর্ম যতই পৃথক হোক, দিনযাপনের মধ্যে তাদের বিশেষ পার্থক্য নেই। “সকলেই তাহারা সমভাবে এক বড় অধর্ম পালন করে— দারিদ্র।”
জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ভারত জোড়া বিভাজনই এখন দেশীয় রাজনীতির মূলমন্ত্র। সচ্ছলতা নয়, শিক্ষা নয়, খেত নয়, কারখানা নয়— ভোট দাও ধর্ম দেব— মন্দির দেব, মসজিদ দেব, অন্ধকার দেব, কূপমণ্ডূকতা দেব। তাই সংখ্যালঘুর পক্ষে মূলস্রোতে মিশে যাওয়া প্রয়োজনহীন। সংরক্ষিত অঞ্চলের গণ্ডিতেই তাঁরা আবদ্ধ থাক। আর হিন্দুরা প্রকৃতই প্রতিপালক। সে ক্ষেত্রে অন্যদের মাঝেমধ্যে স্মরণ করানো যেতেই পারে যে, তারা হিন্দুদের সহৃদয় গৃহপালনের অধিক মর্যাদাসম্পন্ন নয় আদপেই। সে কারণে তো প্রসূতি সদন থেকেই নির্দিষ্ট আছে চিহ্নিতকরণের সুস্পষ্ট প্রকল্পনা। ধর্মের থাকে সুনির্দিষ্ট দর্শন। রক্তপাতের কোনও দর্শন নেই। আসলে ধর্ম এখন এক সংবেদনশীল শোষণ উপাদান। তার আশ্রয়ে বহুমাত্রিক বজ্জাতিরও ভিন্ন মাত্রা দান করা খুবই অনায়াস সাধ্য।
দেশে ইংরেজদের সক্রিয় প্ররোচনাতেই গড়ে উঠেছিল বিভেদপন্থী দু’টি সাম্প্রদায়িক দল— হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগ। ইংরেজের ফাঁদে পা দেওয়া মুসলমান সমাজ সাম্প্রদায়িক স্বার্থে বঙ্গদেশকে আশীর্বাদ স্বরূপ জ্ঞান করলেও, হিন্দু বুদ্ধিজীবী সমাজ এর বিরুদ্ধে সার্বিক প্রতিরোধে সক্রিয় হয়। মুসলিম নেতারা স্বদেশ চিন্তায় উদ্বুদ্ধ বৃহত্তর মুসলমান গোষ্ঠীকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতায় শামিল করতে ব্যর্থই হয়েছিলেন। হিন্দু শোষণ অপেক্ষা তাঁরা ইংরেজদের আধিপত্যকে শ্রেয় মনে করেছিলেন। অবশেষে ভারত ভাগের মাধ্যমে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসীন হয়। ক্ষতচিহ্ন থেকেই যায়। এবং ক্রমেই তা আরও বিষাক্ত হয়ে উঠতে থাকে। বার বার নিরর্থক রক্তে ভিজে যায় মাটি। রক্তের তো স্বতন্ত্র কোনও রং মহিমা নেই— মিশে যায় দুই সম্প্রদায়ের রক্ত একই প্রবাহে। তবুও সমাজের ভেদবুদ্ধি বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলেছিলেন, শুভবুদ্ধি দিয়ে ভেদাভেদের বুদ্ধিবৃত্তিটুকু বাদ দিতে হবে। আর শুভ বুদ্ধি হবে শিক্ষা দিয়ে।
এই শিক্ষা কোন শিক্ষা? আমাদের মধ্যে যাঁরা অতি শিক্ষিত, তাঁদের মধ্যেই দেখা যায় ভেদবুদ্ধি প্রবল। রবীন্দ্রনাথের সময়কার প্যালেস্টাইনের ইহুদিরা অশিক্ষিত নন, আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশরা অশিক্ষিত নন। আমাদের এখনকার যুগোস্লাভিয়ায় আলবেনিয়ানরা অশিক্ষিত নন। এটা তা হলে সাবেক শিক্ষা নয়, নৈতিক শিক্ষা।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
জনসম্পদ
সেমন্তী ঘোষের ‘কিছু শিখলাম না কেন’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়লাম। সত্যি তো, আমরা আমাদের দেশের এই বিশাল জনসংখ্যা সম্বন্ধে প্রায় কিছুই শিখিনি। জনগণের এত ভাগ এত বিভিন্ন ভাবে বিভক্ত, যা কল্পনাও করা যায় না। কখনও জাতিভেদ, কখনও ধর্মভেদ, কখনও বিত্তভেদ, কখনও লেখাপড়ায় ভেদ— এত ভেদ নিয়ে এই জাতি। জনগণের শিক্ষা এবং অর্থে সাম্য আনার চেষ্টা তৎকালীন সরকারের প্রথম প্রচেষ্টা হওয়া উচিত ছিল। সেটা হলে মানুষে মানুষে ভেদ অনেক কমে যেত। মানুষ প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হলে জাতিভেদও কমে যেত।
যাঁরা শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা আর পিছনের দিকে ফিরে তাকাননি। এখন তো অনেক ভেদই ক্রমবর্ধমান। চুইয়ে পড়ার নীতি এখন সরকারের নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণকে বোঝা না ভেবে তাই সরকারের এ বার উচিত শিক্ষার দিকে যথাযথ নজর দেওয়া এবং নীচের তলার সমস্ত মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ানো।
সঞ্জয় চৌধুরী, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর