আবির্ভাব ভট্টাচার্যের ‘ইচ্ছেমতো ওষুধে বিপদ’ (২৮-৫) প্রবন্ধ নিয়ে কিছু কথা। প্রবন্ধকার যথার্থ বলেছেন, আমাদের মধ্যে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। তার কুফলগুলি যথাযথ ভাবে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে দোষারোপ না করে এর কার্যকারণ নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। অসুস্থ হলে হাসপাতালে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতা হল, শহরকেন্দ্রিক সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে হলে সাধারণ মানুষকে কাকভোরে গিয়ে সারা দিন অতিবাহিত করতে হয়, যা রোজগারের ক্ষতি করে। আর বেসরকারি হাসপাতালগুলির ডাক্তারদের কাছে চিকিৎসা করানো কতটা ব্যয়বহুল তার একটা মোটামুটি হিসাব— এককালীন নথিভুক্তিকরণের খরচ ২০০-৩০০ টাকা। তার পর ডাক্তারের ফি ৫০০-১৮০০ টাকা, এর পর আছে নানান ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ।
যদিও নিজের ইচ্ছায় ওষুধ খাওয়াতে বিপদের সম্ভাবনা যথেষ্ট, তথাপি এই প্রবণতার মূল কারণ হল চিকিৎসার খরচ সাশ্রয়ের প্রচেষ্টা। আর একটি অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক উপায় হল ইন্টারনেট সার্চ করে ডাক্তারি পরামর্শের উপর নির্ভরশীলতা। ইন্টারনেটে খোঁজ করলে যে কোনও অসুখ-বিসুখের একটা সাধারণ ধারণা পাওয়া যায়, কিন্তু সে মোতাবেক কোনও রোগ নির্ধারণের প্রচেষ্টা মূর্খামির নামান্তর। আর একটি বিষয় উল্লেখ্য, ডাক্তারবাবুর করা পুরনো প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী একই ধরনের উপসর্গের নিরাময়ের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া একই ওষুধ ব্যবহার করা। প্রবন্ধকার যথার্থ বলেছেন এমন অনেক ওষুধ আছে ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া যেগুলির বার বার ব্যবহার শরীরের ক্ষতি করে। ওষুধের দোকানগুলির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর হওয়া দরকার, যাতে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধ হয়। ওষুধপত্রের দামের বিষয়টিও উল্লেখ করা দরকার। ‘সবার জন্য সস্তা ওষুধ’ নামে ভারত সরকারের একটি জনহিতকর প্রকল্প চালু আছে। অবশ্যই দেশের মানুষ অত্যন্ত স্বল্প মূল্যে একই জেনেরিক কম্পোজ়িশনের ওষুধ (ব্র্যান্ডেড নয়) পাচ্ছেন এবং অনেক অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। কিন্তু কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনেক সময়ে কিছু ডাক্তারবাবুর ইন্ধনে ওই সব ওষুধের মান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। অবিলম্বে সরকারের তরফে এ ধরনের সংশয় দূর করার প্রচেষ্টা বাঞ্ছনীয়।
সুবীর ভদ্র, কলকাতা-১৫১
কাজের ভাষা
স্নাতকস্তরে এখন থেকে ‘কোর’ আর ‘ইলেকটিভ’-এর ধারণাটা বদলে যাচ্ছে। তার বদলে এসেছে ‘মেজর’ আর ‘মাইনর’। আসছে সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা, অনার্স-সহ গ্র্যাজুয়েশন ইত্যাদির ধারণা। এই অবস্থায় কাজের বাজারে বাংলা ভাষাকে আজকের ছেলেমেয়েরা কি শুধু ভালবাসার টানে সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমাস্তরে পড়তে চাইবেন? বাংলা পড়ে যাঁরা শিক্ষক-অধ্যাপকের চাকরি জোটাতে পারেন না, সমীক্ষা করলে দেখা যাবে তাঁদের অধিকাংশ শেষ পর্যন্ত যে চাকরিতে ঢুকলেন তার সঙ্গে বাংলা পড়াশোনার কোনও যোগাযোগই নেই। বাকিরা কোথায় যান, কী করেন, কী ভাবে তাঁদের জীবননির্বাহ হয়, তার খোঁজ আমরা কেউ রাখতে চাই না।
তার চেয়ে কাজের ভাষা ইংরেজিটা নেওয়াই ভাল, অথবা হিন্দি। আর যদি কোনও রাজ্য সরকার আশ্বাস দেয় যে, রাজ্যভাষা জানা থাকলে চাকরি পেতে সুবিধে হবে, সে ক্ষেত্রে সেই রাজ্যভাষা ছেলেমেয়েরা পড়বেন। বাংলামাধ্যম স্কুলগুলো একে একে মাধ্যম পরিবর্তন করে নেওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রী আসতে পারছেন না। আর কাজের জায়গা না থাকায় অনেকেই বাংলা নিয়ে পড়তে চাইছেন না। অনেকে বাংলাতে বিএ বা এমএ পাশ করে কোনও কোম্পানির ফ্রন্ট বা ব্যাক অফিসে কাজ খুঁজে নিয়েছেন। আবার যাঁরা কলেজে চাকরি পেয়েছেন, তাঁরা হাপিত্যেশ করে মরছেন ছাত্রের জন্য। এমন ভাবনাও আকাশে-বাতাসে ঘোরাফেরা করছে যাতে দু’-তিনটি কলেজের বাংলা বিভাগকে একটা ‘ক্লাস্টার’-এ রেখে দেওয়া যায়।
এখানে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবা প্রয়োজন কী ভাবে ভাষাকে বাজারমুখী করে তোলা যায় বা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী তাকে উৎপাদনক্ষম করে তোলা যায়। রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতির অভ্যন্তরীণ লক্ষ্য সেটাই— শিক্ষা হোক বৃত্তিমুখী, তার সঙ্গে স্বনির্ভরতা আসুক। সে দিক থেকে এখনও পর্যন্ত উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষা-সাহিত্যের যে পাঠক্রম চলছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, তা মোটেই বৃত্তিমুখী নয়, বা এতে কোনও ধরনের স্বনির্ভরতাও তৈরি হয় না। আজকে এক জন পরিবেশবিদ দরকার যিনি জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাগুলো অধ্যয়ন করে সেগুলো সমাধানের জন্য পুঁজি বিনিয়োগে সাহায্য করবেন, সেটা বাংলা ভাষায় সম্ভব কেন হবে না? কেন তাঁর অধ্যয়নের ভিত্তি গড়ে দিতে বাংলা সাহিত্য সহায়ক হতে পারবে না? এক জন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ দরকার, যিনি ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’কে বাংলা ভাষায় ব্যবহারের উপযুক্ত করে তুলতে পারবেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এটা সম্ভব করে তোলার মতো পাঠক্রমের কথা কেন ভাবা হবে না? কেন আমাদের পাঠক্রম সে ভাবে তৈরি হবে না, যাতে সবাই জানবে বাংলা ভাষায় মানববিদ্যাচর্চা আর সাহিত্যচর্চা পরস্পর সম্পৃক্ত— একটাকে ছাড়া অন্যটা কল্পনাও করা যায় না? পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত অনুবাদচর্চা কেনই বা শুধু কয়েকটা পাঠের পড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে? কেন সেটা অনুবাদকের চাকরি পাওয়ার উপযুক্ত হবে না? ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যায় বিশ্বে সাত নম্বরে দাঁড়িয়ে বাংলাভাষীরা, তবু কেন প্রধানত বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরাই এ কাজে এগিয়ে আসবেন? ভারতের বাঙালি ছেলেমেয়েদের জন্য অনুবাদ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজের পরিসর তৈরি হবে না কেন?
এখন যা অবস্থা, তাতে পঞ্চম শ্রেণির পর বাংলা মুখের ভাষা, সংস্কৃতিচর্চার ভাষা, গল্প-কবিতা-নাটক লেখার ভাষা হয়েই থাকবে। কাজের ভাষা কখনও নয়। কাজের ভাষা হিসাবে তৈরি করার জন্য প্রচুর পরিশ্রম দরকার। সেটা করার লোক কোথায়? আমাদের তো পরম নির্ভরশীলতা ইংরেজিতে। আমরা উদাহরণ দিই চিন-জাপান-রাশিয়া-জার্মানির, যারা নিজেদের ভাষাকে অত্যন্ত সম্মান করে, কিন্তু বাস্তবে নিজেদের কাজেকর্মে প্রমাণ করি ইংরেজিই শ্রেষ্ঠ।
জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত, গুয়াহাটি, অসম
ষষ্ঠীর ফলার
জামাইষষ্ঠীর ইতিহাস প্রাচীন। তবে বিগত দু’দশক আগের সঙ্গে এখনকার জামাইষষ্ঠীতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে জামাইষষ্ঠীর দিন জলপানি, বেলায় লুচি, আলুর দম ও ভাজাভুজি খেতে দেওয়া হত। এবং দুপুরে দই-চিঁড়ে, মুড়কি, মিষ্টি খাওয়ানোর ব্যবস্থা ছিল। বিকেলে ছিল বিভিন্ন ফলের, তথা ফলাহারের ব্যবস্থা। অর্থাৎ এই ষষ্ঠীর দিন ভাত, মাছ-মাংসের রেওয়াজ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ষষ্ঠীর দিন দুপুরে জামাইকে ভাত, তরকারি, ভাজাভুজি, মাছ, মাংস ও চাটনি ছাড়াও নানা পদ তৈরি করে খাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকে।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যেত, শ্বশুরবাড়ির পরিবারের লোকেদের, বিশেষত শালিদের নিয়ে স্থানীয় সিনেমা হলগুলিতে বিকালের দ্বিতীয় শো দেখার একটা রেওয়াজ ছিল। সিনেমা দেখা শেষ হলে হোটেলে খাওয়াতে জামাই পকেট থেকে খরচ করতেন। সেই ট্র্যাডিশন আজ সম্পূর্ণ বন্ধ বলা যেতে পারে। হাতপাখায় জামাইকে হাওয়া করার বদলে বিদ্যুতের পাখা, হাতে-করা শরবত থেকে বাজারের ঠান্ডা পানীয়, এগুলো অবশ্য স্বাভাবিক।
তবে শাশুড়ি-মায়ের জন্য জামাইয়ের শাড়ি, আর জামাইয়ের জন্য শাশুড়ি-মায়ের জামা-প্যান্ট উপহার দেওয়ার রেওয়াজ এখনও তেমনই আছে।
শ্রীমন্ত পাঁজা, গঙ্গাধরপুর, হাওড়া