‘ওষুধের দাম, প্রাণের মূল্য’ (২১-১১) শীর্ষক প্রবন্ধে জয়ন্ত ভট্টাচার্য অত্যাবশ্যক ওষুধগুলির দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার নড়বড়ে পরিকাঠামোর কথা যথার্থ আলোচনা করেছেন। এগারোটি অত্যাবশ্যক ওষুধের মূল্যের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার কারণে দাম বৃদ্ধির ব্যাপারটা সত্যিই অসুস্থ মানুষজনের চিন্তার কারণ, যে-হেতু ওষুধগুলো হাঁপানি, গ্লুকোমা, থ্যালাসেমিয়া, টিবি ও মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। চিকিৎসা ব্যবস্থায় সরকারি নিয়ন্ত্রণে শিথিলতার কারণে গরিব বা প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত মানুষজনদের কাছে চিকিৎসা করানো এতটাই ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে যাচ্ছে যে, তাঁরা অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে সাহস পাচ্ছেন না। একটু সুস্থ হলেই মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিচ্ছেন শুধুমাত্র অত্যধিক চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে না পেরে।
এখানে প্রবন্ধকারের কথাই ঠিক যে, গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থার এতটাই ভগ্নদশা যে, সেখানে নামমাত্র চিকিৎসাও পাওয়া যায় না। তার ফলে অধিকাংশ মানুষকে শহরের সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়। সেখানেও অপর্যাপ্ত শয্যাসংখ্যা ও দালাল চক্রের রমরমার কারণে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া মুশকিল। তাই কঠিন অসুখে পড়েও মানুষ ধারদেনা করে অন্যত্র চিকিৎসা করাতে বাধ্য হচ্ছেন। চিকিৎসা করাতে যদি আয়ের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যয় হয়ে যায়, তা হলে পরিবার-সহ জীবনধারণ এক রকম অসাধ্য হয়ে পড়ে। এই অত্যধিক চিকিৎসা ব্যয় ও সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় গড়িমসি এবং অব্যবস্থার কারণেই অধিকাংশ বয়স্ক মানুষজন অসুস্থতা যতটা সম্ভব লুকিয়ে রাখেন। আর পরিসংখ্যান যেখানে বলছে অনেক প্রথম বিশ্বের দেশও জিডিপির ১৮ থেকে ২০ শতাংশ ব্যয় করেও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ব্যর্থ দেশগুলির অন্যতম হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে ১৪০ কোটিরও অধিক নাগরিকের জন্য জিডিপির ২ শতাংশের কম স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করা— সরকারি চিকিৎসার ক্ষেত্রে এটা একটা প্রহসন নয় কি?
সবার জন্য চিকিৎসায় সরকারি স্বাস্থ্যবিমার সুযোগ থাকলেও তা সর্বত্র সঠিক সময় পাওয়া যায় না। এ ছাড়া যদিও বা চিকিৎসা পাওয়া যায়, স্বাস্থ্যবিমার মাধ্যমে সেখানেও রোগীর তরফ থেকে কিছু টাকা প্রদান করতেই হয়। তার পর চিকিৎসার পরেও যে ওষুধগুলি জটিল রোগের জন্য নিয়মিত সেবন করতে হয়, সে ক্ষেত্রে ওষুধের দাম বৃদ্ধি সত্যি উদ্বেগের কারণ। পাশাপাশি খবরে প্রকাশ, স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়ামের হার আগামী দিনে আরও বৃদ্ধি পেতে চলেছে। যে বয়সের রোগের প্রকোপ বেশি, সেই বয়সেই মানুষকে স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়ামের টাকা অনেক বেশি দিতে হবে। অত্যাবশ্যক ওষুধের দাম বৃদ্ধি, চিকিৎসা ক্ষেত্রে সুস্থ পরিকাঠামোর অভাব, স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়াম বৃদ্ধি, লাগামছাড়া চিকিৎসার খরচ ইত্যাদিতে যদি সরকারি নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির অভাব থাকে, তা হলে রাজনৈতিক দলাদলি, প্রতিহিংসা ও দুর্নীতির কারণে চিকিৎসা পরিষেবা পেতে যন্ত্রণা বাড়বে বই কমবে না।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০
অত্যাবশ্যক নয়?
‘ওষুধের দাম, প্রাণের মূল্য’ শীর্ষক লেখাটি খুব প্রাসঙ্গিক। অত্যাবশ্যক তালিকাভুক্ত ওষুধের দাম এ বছর ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির খবর নিঃসন্দেহে চিন্তার কারণ। তবে গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারদের উপর অনেক দোষারোপ করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, ভারতের ৭০ শতাংশ গ্রামবাসীর কাছে এঁরাই কিন্তু ভগবান। শহরে বসে শহুরে চিন্তাভাবনায় এটা মনে হতেই পারে, কিন্তু গরিবগুর্বো মানুষ এবং তাঁদের রোগগুলিকে হাতের তালুর মতো চেনেন এই আরএমপি বা হাতুড়ে ডাক্তাররাই। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি অভিজ্ঞতার কথা জানাই। সরকারি হাসপাতালের পাশের ওষুধ দোকানগুলোতে ৬০ শতাংশ ছাড়ের ওষুধ (যার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন আছে) কিনতে অনুরোধ করা হয়। শহুরে মানুষের কাছে অনেক বিকল্প আছে। কিন্তু গ্রামের মানুষের কাছে বড় বড় বিজ্ঞাপন ও নেতাদের বেদবাক্যই ভরসা। অতি সাধারণ মানুষ ওষুধের দোকানে প্রেসক্রিপশন নিয়ে গিয়ে বলেন— “কত পড়বে? ৫০০ টাকার মধ্যে যা হয় দিন।” গ্রামীণ হাসপাতালে প্রযুক্তি পরিষেবার মান নিয়ে কথা বলা মূর্খামি। অত্যাবশ্যক পণ্যের মধ্যে এই ওষুধগুলো কি আসতে পারে না? নির্বাচনী বন্ড-এর দায়বদ্ধতা ও রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের জাঁতাকলে সবাইকে সারা জীবন ফাঁকা আওয়াজ শুনতে হবে। কেন্দ্র-রাজ্য লোকদেখানো দ্বন্দ্ব চলতেই থাকবে, আর নিঃশব্দে ভুগবেন আমজনতা।
রাধারমণ গঙ্গোপাধ্যায়, বজবজ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
বাজির বিপদ
‘দূষণ উৎসব’ (৬-১১) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার’ থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, দীপাবলির ঠিক আগে-পরের সময়কালে সিন্ধু-গাঙ্গেয় অববাহিকা-স্থিত সবচেয়ে কম দূষিত শহরগুলির মধ্যে কলকাতা ছিল অন্যতম। কলকাতাকে অনেক পিছনে ফেলেছে গাজ়িয়াবাদ, বিকানের ও দিল্লি। অন্য একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, এ বছর কালীপুজো ও দেওয়ালি অপেক্ষা কলকাতা, সল্ট লেক ও সংলগ্ন এলাকায় অনেক বেশি বাজি পুড়েছে সেই সপ্তাহান্তে। সেই সময় বাতাসে পিএম ২.৫ এবং পিএম ১০— দুইয়েরই পরিমাণ বেড়ে যায় অনেকখানি এবং বাতাসের গুণমান ঘোরাফেরা করেছে ২০০ থেকে ৩০০-র মধ্যে।
রাজ্যের শীর্ষ আদালত এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নিয়ম অনুযায়ী, দেওয়ালি ও কালীপুজোর রাতে দু’ঘণ্টা (৮টা থেকে ১০টা) এবং ছটপুজোর দিনে (সকাল ৬টা থেকে ৮টা) দু’ঘণ্টা শুধুমাত্র সবুজ বাজি পোড়ানো যাবে। অন্য সময় নির্দিষ্ট কারণ সাপেক্ষে সর্বাধিক ২ ঘণ্টা সবুজ বাজি পোড়ানোর নির্দেশ দিতে পারে প্রশাসন। আর সবুজ বাজি পোড়ানো মানে দূষণ কম হওয়া, দূষণ হবে না তা নয়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এত কম সময়ের জন্য বাজি পুড়লে সাত দিনের বাজির বাজার, বাজির ক্লাস্টার গড়ে তোলার তো প্রয়োজন পড়ে না। বরং যে-হেতু এই বাজি থেকে পরিবেশ দূষণ, নানা রকম দুর্ঘটনা ঘটে ও বহুবিধ ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই যায়, সেই কারণে বাজি উৎপাদনে সরকারের উৎসাহ না-দেখানোটাই স্বাভাবিক ছিল। পুলিশের পক্ষ থেকে অবশ্য বেশ কিছু স্থানে অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ বাজি উদ্ধার করা হয়েছে এবং এ ধরনের বাজি-বিক্রেতাদের গ্রেফতারও করা হয়েছে। এটাও ঠিক যে, তাঁদেরও কাজ করতে হয় ‘কর্তা’র ইচ্ছা ও মর্জির উপর নির্ভর করে। কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এ বছরও কালীপুজোর রাতে ও পরে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, এ বার গ্রামীণ এলাকায় বাজির দাপট ছিল কম। তবে সেটা কতটা স্বেচ্ছায়, আর কতটা মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায়, প্রশ্নটা রয়েই গেল। বাজেয়াপ্ত করা বাজি ঘুরপথে বাজারে চলে আসছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে পরিবেশ কর্মীদের। কারণ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশ অনুযায়ী, সমস্ত বাজি বিশেষ পদ্ধতিতে নিষ্ক্রিয় করার জন্য হলদিয়াতে পাঠানোর কথা বলা হলেও পঞ্চাশ কেজির কম বাজি স্থানীয় স্তরে কোনও ফাঁকা জায়গায় বা নদীর ধারে নিষ্ক্রিয় করা হয়ে থাকে বলে জানা যাচ্ছে। এ রকম খোলা জায়গায় বিপুল পরিমাণ বাজি নিষ্ক্রিয় করা হলে মাটি, বাতাস ও জল দূষণ হবে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।
সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অভ্যাস বদলাতে শাসকের মনোভাব এক বড় ভূমিকা নেয়। এটা ইতিহাস বারে বারে আমাদের জানিয়েছে। সুতরাং সুদিনের প্রত্যাশায় সচেতনতার প্রচার চলতে থাকুক আগামী দিনগুলিতেও।
প্রশান্ত দাস, খলিসানি, হুগলি