সম্পাদক সমীপেষু: বিকল্প বামপন্থা

নাঁতেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্ক্সবাদী ছাত্রনেতা কোন বেনদিত ভ্রাতৃদ্বয় সোভিয়েত বিপ্লবে বলশেভিকদের ভূমিকার তীব্র সমালোচক ছিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৮ ০০:২১
Share:

‘ফ্রান্স, মে ১৯৬৮’ (১০-৫)শীর্ষক লেখাটির প্রেক্ষিতে বলি, সেই সময় বিশ্বে যে সব বামপন্থী ধারাগুলি জনপ্রিয় ছিল, অর্থাৎ স্তালিনের সোভিয়েত রাষ্ট্র মডেল, ক্রুশ্চেভ মডেল, মাও জে দং-এর চিন্তাধারা, ট্রটস্কিপন্থী আন্দোলন— এ সবের প্রতি ১৯৬৮-র মার্ক্সবাদ অনুপ্রাণিত ফরাসি ছাত্র আন্দোলন নিজেদের সমালোচনামূলক অবস্থান বজায় রেখেছিল। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বলশেভিক ধারার বিপরীতে তাঁরা একটি বিকল্প মার্ক্সবাদী বিপ্লবের মডেল তুলে ধরার চেষ্টা করেন, যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল বিপ্লবী স্বতঃস্ফূর্ততা ও স্বতঃপ্রণোদিত উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র গঠন। এই বামপন্থীরা ১৯২০ সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির দশম কংগ্রেসের আগে ও পরে আলেকজ়ান্দ্রা কোলনতাই ও ওয়ার্কার্স অপোজ়িশন মতবাদকে গুরুত্ব দিয়েছেন। লেনিন-ট্রটস্কিরা তখন কী তাত্ত্বিক, কী সাংগঠনিক— দু’ভাবেই এঁদের কচুকাটা করেছিলেন। পরবর্তী কালে বিদ্রোহী ফরাসি ছাত্ররা ট্রটস্কির স্বরূপ তুলে ধরে দেখিয়েছিলেন— সোভিয়েত রাষ্ট্রে শ্রমিককে সৈন্যশৃঙ্খলায় আবদ্ধ করাটাই তিনি উদ্দিষ্ট বলে মনে করতেন। গণতান্ত্রিক উদ্যোগের প্রতি তাঁর কোনও সমর্থন ছিল না।

Advertisement

নাঁতেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্ক্সবাদী ছাত্রনেতা কোন বেনদিত ভ্রাতৃদ্বয় সোভিয়েত বিপ্লবে বলশেভিকদের ভূমিকার তীব্র সমালোচক ছিলেন। ‘স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড নেচার অব বলশেভিজ়ম’ লেখায় তাঁরা স্পষ্ট বলেছিলেন, ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে বলশেভিকদের কাজ ছিল জনগণের বিদ্রোহকে পিছনে টেনে ধরা এবং পরবর্তী কালে তারা বিপ্লবকে আমলাতান্ত্রিক প্রতিবিপ্লবে পরিণত করে। কোন বেনদিতরা মনে করতেন, বলশেভিক পার্টির ধরন, কাঠামো এবং মতাদর্শ এর জন্য দায়ী (অবসলিট কমিউনিজ়ম, দ্য লেফট উইং অলটারনেটিভ, গ্যাব্রিয়েল ও দানিয়েল কোন বেনদিত, ১৯৬৮)।

তাঁরা বলতেন, বলশেভিক পার্টিকে গণতান্ত্রিক বলার অর্থ আত্মপ্রতারণার আশ্রয় নেওয়া। লেনিনের নেতৃত্বাধীন পার্টি আদৌ গণতন্ত্রকে ভিত্তি করেনি। এই দলকে লেনিন ‘বাইরে থেকে’ শ্রমিকদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যদি শ্রমিকরা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গঠন করতে সক্ষম হয়। রাজনৈতিক সাবালকত্ব অর্জন সম্ভব হয় একমাত্র বিপ্লবী সংগ্রাম ও প্রত্যক্ষ আক্রমণের মাধ্যমে। তাঁরা এমন এক বিকল্প বামপন্থী পথের কথা বলতেন, সেখানে ‘ডিটারমিনিস্ট’ রাজনীতির কোনও স্থান নেই।

Advertisement

শৈবাল বিশ্বাস কলকাতা-৩

ভারতে কেন

মধ্য ষাটের উত্তাল সংগ্রামী দিনগুলির বর্ণনা পড়ে আমরা একটা প্রশ্ন করতে পারি, কেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি স্থিতাবস্থা-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারেনি? গণবিক্ষোভ যথাযথ ব্যবহৃত হলে রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে যেতে পারত। দেশের বাম আন্দোলনের পুরোধা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গত ৭৫ বছর
যাবৎ উপলব্ধি করতে পারেনি, তাদের আসল গলদটা ছিল আনুগত্যবাদী রাজনীতিতেই।

১৯৪২, সোভিয়েত রাশিয়ার নির্দেশে পার্টিতে ‘জনযুদ্ধ’-এর লাইন চলছে, ফ্যাসিবিরোধিতাই তখন পার্টির ‘প্রধানতম কর্তব্য’। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চেয়ে বড় শত্রু হল সীমান্তে আগতপ্রায় জাপানি ফ্যাসিস্তরা। এই রাজনীতি কমিউনিস্ট পার্টিকে কার্যত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়ে পরিণত করল। সারা ভারতব্যাপী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে উত্তাল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেখান থেকে পার্টি দূরে সরে থাকলই এবং যারা স্বাধীনতার জন্য জীবনপণ সংগ্রাম করেছিল, তাদের ‘পঞ্চম বাহিনীর এজেন্ট’ বলে চিহ্নিত করল। এই সময়ে গণনাট্যের গানেও ব্রিটিশ-বিরোধিতা ছিল না।

হিটলার-মুসোলিনি-তোজো পরাজিত হওয়ার পরও কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশের সহযোগিতার লাইন আঁকড়ে থেকেছে, তখনও গাঁধী-জিন্নার মিলন তার প্রধান দাবি। অথচ দেশের সংগ্রামী শ্রমিক-কৃষক বার বার এই লাইন অস্বীকার করে বিদ্রোহ করেছে।

এই সময়ের ভারত কাঁপানো ঘটনা, ১৯৪৬ সালে বোম্বাইয়ের নাবিক বিদ্রোহ। পার্টিকে নেতৃত্ব দিতে নাবিকরা অনুরোধ করেছিলেন, উত্তরে পার্টির নেতৃত্ব সংগ্রামী নাবিকদের গাঁধী ও জিন্নার ঠিকানা দেখিয়ে দেন। ১৯৪৮ সালের দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসেই স্লোগান উঠল, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’। ভারতীয় জনগণ এই স্লোগান কখনওই গ্রহণ করেনি।

১৯৫১ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনের আর এক মুখ্য ধারা ছিল শান্তি আন্দোলন, যা শ্রেণিচরিত্র হারিয়ে আপসের চোরাবালিতে ডুবে কার্যত ওঁ শান্তি আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল এবং রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা থেকে দূরে সরে গেল।

আসলে, চল্লিশের দশকে পার্টির নেতৃত্বের বড় এক অংশ ইংল্যান্ডে পিএইচ ডি বা ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে কমিউনিস্ট হন। এঁরা যখন পড়তে যান, তখন ইংল্যান্ড এদের মাতৃভূমি, কমিউনিস্ট হওয়ার পর সোভিয়েত রাশিয়া হল পিতৃভূমি। বিদেশি অভিভাবক ছাড়া ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি কোনও দিন চলতে পারেনি। ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ লিখেছেন, ‘‘আমার পরিচিত এক বাঙালি বন্ধু, স্কলার, এক বার আমায় বলেন, ১৯৫৩ সালে স্তালিনের অসুস্থতাকালে পার্টির সদর দফতরে যেতেন। টেলিকম, টেলিগ্রাফের খবর উদ্বেগের সঙ্গে বসে শুনতেন। স্তালিনের মৃত্যুসংবাদ আসার পর ‘আমি এত নিঃসঙ্গ অসহায় বোধ করলাম, বাবার মৃত্যুর সময়ও এত নিঃসঙ্গ বোধ করিনি’।’’

উল্লেখ্য, স্তালিনের মৃত্যুর পর কলকাতায় বেরোয় এক নীরব শোকমিছিল। নেতৃবৃন্দ নগ্নপদে হাঁটেন।

‘‘তিন বছর পর স্তালিনের উত্তরসূরি ঘোষণা করলেন লোকটি ছিল শতাব্দীর ঘৃণ্যতম জল্লাদ। বন্ধুটি সিপিআই ছাড়লেন। অনেক ভদ্রলোক বললেন, এ সব বুর্জোয়াদের মিথ্যা প্রচার, আর এক দল নতুন পিতৃভূমির সন্ধান শুরু করলেন। চিনের চেয়ারম্যান হলেন আমাদের চেয়ারম্যান।’’

বিশ্বের সর্বত্র স্তালিনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলি মূলত আনুগত্যবাদী। নীতিগত দুর্বলতা, রণকৌশল মূল রণনীতিকে অতিক্রম করে যাওয়া, কখনও মস্কো কখনও চিন, আর আনুগত্যবাদ বিশ্বের ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিগুলিকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলেছে।

অশোক ঘোষ কলকাতা-১২

‘জরুরি নয়’

সম্প্রতি প্রকাশ্যে আলিঙ্গন, চুম্বন ইত্যাদি নিয়ে রাজ্য সরগরম ছিল। এক দল উন্নাসিক ‘বামপন্থী’ প্রগতিশীল আমাদের ভর্ৎসনা করেছিলেন এ সব তুচ্ছ বিষয়ে মন দেওয়ার জন্য। আজ যখন পৃথিবী ক্ষুধা, অশিক্ষা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ষণে গদ্যময়, তখন এ সব বিষয়ে ভাবা মধ্যবিত্তসুলভ বিলাসিতা।

১৯৬৮ সালের ফরাসি দেশের ছাত্র বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান দাবিটি ছিল মেয়েদের হস্টেলে ছেলেদের ঢোকার দাবি। এই আপাত উদ্ভট, বিপ্লবী নাসিকাকুঞ্চিতকারী আবদারটি কিন্তু ছাত্রসমাজে জনগ্রাহ্যতা অর্জন করেছিল। ধীরে ধীরে সে আন্দোলন সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাওয়ের রূপ নিল। প্রভাবিত করল শ্রমিক শ্রেণিকে। ফলে দখল হতে লাগল একের পর এক কারখানা। বিক্ষোভের বজ্রনির্ঘোষে, ইন্টারন্যাশনালের সুরে মোহিত হল প্যারিসের আকাশ বাতাস। শেষ অবধি সেনাবাহিনীর সাহায্য চাইতে দ্য গলকে ছাড়তে হল দেশ।

এ গণবিক্ষোভ এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। সমাজ একটি ল্যাবরেটরি নয়, যেখানে রাসায়নিক পদার্থের নির্দিষ্ট মিশ্রণে নির্দিষ্ট বিক্রিয়া জন্ম নেয়। গণআন্দোলন কোনও বাঁধাধরা ছক, কোনও পূর্ব সূত্রায়িত তত্ত্বের দ্বারা বিকশিত হয় না। সমাজে বিরাজমান নানা মত পথের গা-ঘেঁষা ঘেঁষি ও সংঘাত সৃষ্ট ফল দ্বারা নির্ধারিত হয় সামাজিক আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত গতি। সুযোগ্য নেতৃত্বের (তা যে পার্টিই হতে হবে, কোনও মাথার দিব্যি নেই) উপস্থিতি সে আন্দোলনকে একটি বিশেষ লক্ষ্যে ধাবিত করে।

অর্জুন সেনগুপ্ত কলকাতা-২৮

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement