Indian Media

সম্পাদক সমীপেষু: সত্য জানার অধিকার

কথায় আছে, হয়কে নয় করা। অর্থাৎ, সত্যকে মিথ্যা করে, মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে যে বিকৃত খবর পরিবেশিত হচ্ছে তা গণতন্ত্রের পক্ষে কতটা বিপজ্জনক, বোঝা কঠিন নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২৪ ০৪:১৬
Share:

মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিত্ত যেথা ভয়পূর্ণ’ (১৭-৫) শীর্ষক প্রবন্ধটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই প্রাসঙ্গিক। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যম আজ শাসক দলের দ্বারা আক্রান্ত। শাসক দলের অনুসারী না হলেই সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের কর্ণধারকে গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ভরা, ভীতিপ্রদর্শন, হয়রানি, সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত করা ইত্যাদি চলতে থাকে। কিছু সংবাদমাধ্যম শাসক দলের কাছে মাথা নুইয়ে ফেললেও এখনও ভারতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কিছু সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিক আছেন, যাঁদের কাজই হল সত্যকে সকলের সামনে তুলে ধরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এই কাজটি তাঁদের করতে হয়। সত্য জানার অধিকার সকলের আছে।

Advertisement

কিন্তু বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে যা ঘটছে, তাতে ভীষণ অবাক হতে হচ্ছে। কথায় আছে, হয়কে নয় করা। অর্থাৎ, সত্যকে মিথ্যা করে, মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে যে বিকৃত খবর পরিবেশিত হচ্ছে তা গণতন্ত্রের পক্ষে কতটা বিপজ্জনক, বোঝা কঠিন নয়। নিউজ়ক্লিক-এর কর্ণধার প্রবীর পুরকায়স্থের গ্রেফতারকে সুপ্রিম কোর্ট যে ভাবে বেআইনি বলে রায় দিয়েছে, তাতে প্রমাণ হয়, সত্যমেব জয়তে। কিন্তু এই জয় সহজে আসেনি। আন্তর্জাতিক সংস্থা, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর রিপোর্ট অনুযায়ী সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সূচকে ভারতের অবস্থান বর্তমানে পিছিয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫৯তম। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে দমানোর অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। এর জন্য স্বাধীনচেতা সাংবাদিকদের ধন্যবাদ দিতে হয়। তাঁরা নিজেদের কথা না ভেবে সব সময় সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে বা সৎ সাংবাদিকতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। অমর্ত্য সেন বলেছেন গণতন্ত্রে নীরবতা এক ধরনের অপরাধ। আমরা বিভিন্ন সময়ে শাসক দলের তল্পিবাহক হয়ে গণতন্ত্রের স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিচ্ছি না তো?

অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ

Advertisement

হেনস্থা

মণিদীপা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতে সংবাদ সংস্থা ও সাংবাদিকদের হেনস্থার যে ছবি তুলে ধরেছেন, তা আসলে হিমশৈলের চূড়ামাত্র। প্রকৃত চিত্র নিঃসন্দেহে আরও ভয়াবহ। এ কথা ঠিক যে, সাংবাদিক নিগ্রহ ও শাসক-বিরোধী খবরে লাগাম পরানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক রং নির্বিশেষে সব দলই কম-বেশি পারদর্শী। তবে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি এ ক্ষেত্রে অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করার প্রশ্নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব সমীক্ষায় এ তথ্য প্রমাণিত। ‘প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্স’-এ মোদীজির জমানায় ভারতের স্থান ৫০ ধাপ নীচে নেমেছে। কেবল এই তথ্যটুকু থেকেই ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সারাৎসার বুঝে নেওয়া যাবে। কিন্তু শাসকের চরিত্রে লজ্জা, অনুতাপ জাতীয় বৈশিষ্ট্য যে-হেতু অনুপস্থিত থাকে, তাঁরা সমস্ত অভিযোগ নির্মম ঔদাসীন্যে অবজ্ঞা করতে পারেন।

‘শাসন’ কথাটির সঙ্গে ক্ষমতার প্রতাপ ও প্রভুত্বের দ্যোতনা জড়িয়ে আছে। সব শাসকের মধ্যেই স্বৈরাচারী সত্তা ঘাপটি মেরে থাকে। তবে সকলের স্বৈরাচারের প্রকাশভঙ্গি এক রকম নয়। রাজতন্ত্রের কালে রাজা ছিলেন ঈশ্বরের প্রতিভূ। তাঁর পারিষদেরা প্রজাদের মনে শাসকের সম্পর্কে এই ধারণা গেঁথে দিতে চেষ্টার কসুর করত না। শাসক যতই অত্যাচারী, নৃশংস ও ক্ষমতান্ধ হন, তাঁকে মহান ও তাঁর আচরণকে ন্যায়সঙ্গত হিসেবে দেখাতে লেখানো হত ফরমায়েশি জীবনচরিত। যে কোনও শাসনব্যবস্থায় শাসক ও ক্ষমতাতন্ত্রকে যারাই প্রশ্ন করেছে, তাদের পরিণতি হয়েছে দুর্বিষহ। পরাধীন ভারতে বহু সংবাদপত্র ইংরেজ শাসকের রোষে পড়েছে। প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করার জন্য তাঁরা এক গুচ্ছ দানবীয় আইন প্রণয়ন করেছিলেন। যুগান্তর, সাধনা, সন্ধ্যা, বলশেভিক, সংগ্রাম, শনিবারের চিঠি, ধূমকেতু— অজস্র পত্রপত্রিকা বাজেয়াপ্ত করা হয়, নতুবা লেখক, সম্পাদক বা প্রকাশকদের জেল-জরিমানা হয়।

উনিশ শতকে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেনের মতো সাহিত্যিকের দেশাত্মবোধক রচনা শাসক গোষ্ঠীকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। তাঁরা সকলেই সরকারের বিষনজরে ছিলেন। যদিও হেমচন্দ্র ছাড়া বাকি সকলেই ছিলেন পদস্থ রাজকর্মচারী। রাজরোষ এড়াতে বঙ্কিমচন্দ্রকে তাঁর আনন্দমঠ উপন্যাসের পাঁচটি সংস্করণে শতাধিক পরিবর্তন করতে হয়। ‘বন্দে মাতরম্’ গানটিও নিষিদ্ধ হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বকেও ইংরেজ সরকার নানা ভাবে হেনস্থা করেছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন গবেষক-সাংবাদিক শিশির কর, ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই-এ।

ঔপনিবেশিক শাসনের পরে সাংবাদিক নিগ্রহের একটা গুরুতর অধ্যায় আমরা দেখেছি জরুরি অবস্থার সময়। পুলিশকর্তা কে পি এস গিল-এর আমলেও পুলিশি বর্বরতা, সাংবাদিক নিগ্রহ অন্য মাত্রা পেয়েছিল। আর এক পর্ব দেখা গিয়েছে মোদীজির রাজত্বে। যে যে রাজ্যে তাঁর দল ক্ষমতায় আছে, সেখানে তাদের সমালোচকরা রাষ্ট্রীয় হেনস্থার শিকার হয়েছেন, তিনি সাংবাদিক, সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ, কার্টুনিস্ট, যে-ই হন না কেন। ভুয়ো অভিযোগে তাঁদের নাজেহাল করা, বিনা বিচারে জেলবন্দি রাখা, কথায় কথায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার ধারা দেওয়া, এ সব এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।

প্রবন্ধকার হয়তো স্থানাভাবে উল্লেখ করেননি কোভিডকালে সাংবাদিকদের হেনস্থার কথা। দেশের ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা অন্তত ৫০ জন সাংবাদিককে সে সময় জেলে পুরে দেওয়া হয়েছিল মিথ্যা অভিযোগে। কাশ্মীরে কর্মরত সৎ, সংবেদনশীল সাংবাদিকদের উপর নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচারের কথাও তাঁর লেখায় অনুল্লিখিত। সেখানে সরকার বহু সংবাদমাধ্যমকে বন্ধও করে দিয়েছে। নিউজ়ক্লিক প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর পুরকায়স্থের বেআইনি গ্রেফতারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়টি নিশ্চয়ই এ দেশের দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যমকে কিছুটা হলেও ভরসা জোগাবে। গত বছর অক্টোবরে তাঁর গ্রেফতার পর্বের সময়েই দিল্লি পুলিশের স্পেশাল টিম (যারা মূলত সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগ তদন্ত করে) ৯ জন মহিলা সাংবাদিক-সহ ৪৬ জনের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালায়। জিজ্ঞাসাবাদের নামে দীর্ঘ সময় তাঁদের আটক করে রাখে। ভারতে সাংবাদিকতার ইতিহাসে এ হল এক নজিরবিহীন কলঙ্কজনক ঘটনা।

দেবকুমার হালদার, কলকাতা-৩৬

কেবল উৎসব?

সাধারণ নির্বাচন সমাধা হল, তার ফলও বেরিয়ে গেল। তবু একটা প্রশ্ন থেকে যায়। কী ভাবে আমরা ভোট দেওয়ার শিক্ষা আয়ত্ত করি? আমরা যারা ভোট দিয়ে থাকি, তারা অগ্রজদের কাছে জানতে পারি, তাঁরা অমুক দলকে ভোট দেন। প্রথমে অভিভাবকের কথা, পরে লোকমুখে শুনে, বন্ধুবান্ধবদের আলোচনা থেকে একটা অস্পষ্ট ধারণা নিয়েই ভোট দিয়ে আসছি।

ক্লাস ওয়ান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত আমরা প্রচুর বিষয়ের বই পড়ে ফেলি, কিন্তু রাজনীতি বিষয়ের বই কতটুকু পড়া হয়? মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত খুব সামান্যই তা পড়ানো হয় সিভিক সায়েন্স বিষয়ের মধ্যে, আর উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কিছুটা বেশি থাকলেও তা সীমিত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পঞ্চম শ্রেণি থেকে থাকবে না? দেশ এবং দেশ চালানোর পদ্ধতিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের অধীনে রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন নীতি গ্রহণের বিষয়টি অল্প করে হলেও তো বালক, কিশোর জেনে উঠতে পারে।

একটা নির্বাচন করতে যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়, সেখানে ভোটাররা একটা ‘উৎসব’ পালন করে, যা বিরক্তিকর। হিংসা, মারামারি, দাঙ্গাবাজি, অগ্নিকাণ্ড ঘটতে থাকে। এই সবের পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্রে ভোটারদের অবস্থান কোথায় দাঁড়ায়, সেটাই প্রশ্ন।

সমীর চক্রবর্তী, রামরাজাতলা, হাওড়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement