Sourced by the ABP
প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘পদত্যাগ এবং সাপলুডো’ (১৯-৯) পড়ে মনে হল, রাজনীতিতে সততা আর ক্ষমতা একে অন্যের হাত ধরে চলে না। আর জি কর কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তিনি চেয়ার চান না, এমনকি তিনি পদত্যাগ করতেও রাজি আছেন, যদি তা মানুষের স্বার্থে হয়। আর জি করের কাণ্ড বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বহু বছর ধরে চলতে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির এক খণ্ডচিত্র মাত্র। তা প্রশাসনের সার্বিক ব্যর্থতাকেই তুলে ধরে। মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তারদের দাবি মেনে নিয়ে কয়েক জন পুলিশকর্তা ও স্বাস্থ্যকর্তাকে সরিয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর অপরাধীদের আড়াল করা নিয়ে যে প্রশ্ন সামনে এসেছে, তা কি এতটুকু ম্লান হয়েছে? আর জি কর কাণ্ডের দায় স্বীকার করে যদি তিনি পদত্যাগ করতেন, এবং নতুন করে জনগণের রায় চাইতেন, তাতে তাঁর ‘সততার প্রতীক’ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারত। কিন্তু মমতা সেই পথে হাঁটলেন না। ২০২৬-এ পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার ভোট, তত দিনে আর জি কর কাণ্ডের স্মৃতি ফিকে হয়ে আসবে— এটাই হয়তো তাঁর হিসাব।
অন্য দিকে, আবগারি মামালায় জামিন পেয়ে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের পদত্যাগ করাটা নেহাত ছেলে ভোলানোর মতো। কেজরীওয়ালের মুখ্যমন্ত্রিত্বের বাকি মাত্র ছ’মাস। জামিনের শর্ত অনুযায়ী এই ছ’মাস মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর কোনও কার্যক্ষমতা থাকবে না। কাজেই ক্ষমতাহীন মুখ্যমন্ত্রী থাকার চেয়ে পদত্যাগ করে সহানুভূতির হাওয়া তোলার চেষ্টাই তিনি শ্রেয় মনে করেছেন। যদি বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর মতো কেজরীওয়ালের মুখ্যমন্ত্রিত্বের কাল আরও কয়েক বছর থাকত, তা হলে তিনি পদত্যাগ করতেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
মিহির কানুনগো, কলকাতা-৮১
কথার কথা
প্রেমাংশু চৌধুরী অরবিন্দ কেজরীওয়াল ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে তুলনা টেনেছেন। দুই মুখ্যমন্ত্রীর কাপড়েই দুর্নীতির কালি লেগেছে কি না, তা আদালতের বিচারে বেরোবে। কেজরীওয়াল জামিনে মুক্ত হয়ে পদত্যাগ করে প্রায় বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, কয়েক বছর আগে লালকৃষ্ণ আডবাণীও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগে অবশ্য সাংসদ পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এ রাজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ আলাদা। মুখ্যমন্ত্রী প্রায়ই বলে থাকেন, তাঁর গদির মোহ নেই, যে কোনও দিন পদত্যাগ করতে পারেন। আন্দাজ হয়, এ সব হল কথার কথা। আর জি কর নিয়ে অভূতপূর্ব, স্বতঃস্ফূর্ত নাগরিক আন্দোলনে সরকার তথা শাসক দলের ভিত বেশ নড়বড়ে হয়েছে সন্দেহ নেই। জুনিয়র ডাক্তাররা তাঁদের দাবিগুলি নিয়ে আন্দোলন করছেন, তাঁদের একাংশ অনশনেও বসেছেন। তাঁরা কলকাতা পুলিশ কমিশনার, স্বাস্থ্যসচিব প্রমুখের অপসারণ চাইলেন, কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পুলিশমন্ত্রীর অপসারণ চাইলেন না, এতে অবাক হতে হয়। বিভাগীয় মন্ত্রী কি মেডিক্যাল কলেজে এই ধর্ষণ-হত্যার দায় এড়াতে পারেন?
স্বাস্থ্য ভবনে দুর্নীতির ঘুঘুর বাসা সম্বন্ধে তিনি নাকি কিছুই জানতেন না, এ কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী যথারীতি দুর্নীতির দায় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কথাটা নাগরিকের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য? প্রবন্ধকারের সঙ্গে সহমত হয়ে বলা যায়, গভীরে গিয়ে সঠিক তদন্ত করলে মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে আর জি কর কাণ্ডে দায় এড়ানো কঠিন হবে।
অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, গড়িয়া, কলকাতা
ক্ষোভের প্রকাশ
‘পদত্যাগ ও সাপলুডো’ প্রসঙ্গে বলতে চাই, সম্প্রতি দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গ দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করতে চেয়েছেন। কারণ একটাই, দুর্নীতি। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আবগারি মামলায় জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। সাধারণত কোনও আধিকারিক বা মন্ত্রী কোনও মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জেলে গেলে নৈতিকতার দায়ে পদত্যাগ করেন। কেজরীওয়াল কিন্তু সেই পথে হাঁটলেন না। তিনি জেলে বসে মুখ্যমন্ত্রীর কাজ চালালেন। জামিনে মুক্তি দিলেও আদালত শর্ত দিয়েছে, তিনি কোনও ফাইলে সই করতে পারবেন না এবং কোনও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এই অবস্থায় তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে থাকার অর্থ হয় না। এই শর্ত না দিলে তিনি পদ ছাড়তেন কি? নৈতিকতার অবস্থান নিলে তো সে দিনই পদত্যাগ করতেন, যে দিন তিনি জেলে গেলেন। জামিন পাওয়ার পরে পদত্যাগ করে তিনি জনসমক্ষে একটা উজ্জ্বল ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলেন। ভোট বাক্সে তার প্রতিফলন কতটা পড়বে, তা সময় বলবে।
এ বার আসা যাক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রসঙ্গে। বিভিন্ন দুর্নীতির মামলা সামনে এসেছে ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মতো হেভিওয়েট মন্ত্রী, ওজনদার বেশ কয়েক জন আমলা এখনও জেলে। চাকরি চুরি, খাদ্য দুর্নীতি, অথবা গরু, কয়লা, পাথর নিয়ে দুর্নীতি, সব ক্ষেত্রেই শাসক দলের মন্ত্রী, নেতাদের নাম জড়িয়েছে। এক তরুণী চিকিৎসকের হত্যা স্বাস্থ্য দফতরের দুর্নীতিও বে-আব্রু করে দিল। আগের দুর্নীতির ঘটনাগুলো, বিশেষ করে স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতি ব্যাপক ভাবে নাড়া দেয় জনমানসে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সন্দেশখালির মেয়েদের মর্যাদার জন্য আন্দোলন। ফলে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল, নাহলে শুধুমাত্র আর জি করের ঘটনা এমন ভাবে তৃণমূল সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারত না। মমতা বলেছেন, জনতা চাইলে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন। এটা শুধুই কথার কথা। দিল্লির মতো যদি এ রাজ্যেও বিধানসভা নির্বাচন ছ’মাস পরেই হত, তা হলে হয়তো কেজরীওয়ালের মতো পদত্যাগ করে একটা ঝুঁকি নিলেও নিতে পারতেন মমতা। কেজরীওয়ালের কাছে যা বাধ্যতামূলক, মমতার কাছে তা নয়— এটাই আপাতত তাঁর ‘অ্যাডভান্টেজ’।
তারক সাহা, হিন্দমোটর, হুগলি
শ্রমিকরাও
‘বিচারের দাবিতে এ বার পথে শ্রমিক কৃষকরাও’ (২২-৯) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনও পর্যন্ত আর জি করের ঘটনার প্রেক্ষিতে ছাত্র, যুব ও মহিলারা ধারাবাহিক ভাবে সম্মিলিত আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়েছেন। কিন্তু এই বিষয়ে শ্রেণিগত সংগঠনের পথে নামা এটাই প্রথম। এটা বাস্তব ঘটনার প্রতিফলন নয়। এই নারকীয় ঘটনার অব্যবহিত পরে কলকাতা বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা নেতাজি সুভাষ ডকের সাত নম্বর গেটে বিক্ষোভ সভা করে। অল ইন্ডিয়া ডিফেন্স এমপ্লয়িজ় ফেডারেশন অনুমোদিত ইছাপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিজ় মজদুর ইউনিয়ন-এর উদ্যোগে ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরি ও মেটাল অ্যান্ড স্টিল ফ্যাক্টরির কর্মচারীরা এবং ‘সিকিউ’-এর শ্রমিক-কর্মচারীরা ঐক্যবদ্ধ মিছিল করেন ২২ অগস্ট। মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি এবং শিল্পভিত্তিক নানা ফেডারেশনের যৌথ মিছিল হয় ২০ অগস্ট। অ্যাপ ক্যাব, অ্যাপ বাইক চালক, বিভিন্ন ডেলিভারি পরিষেবার রাইডার, রিকশা চালকরাও মিছিল বার করেন। বিভিন্ন জেলায় শ্রমিক, কৃষক, দিনমজুররা ‘শ্রমিক-কৃষক দিচ্ছে ডাক, আর জি কর বিচার পাক’ স্লোগান দিয়ে একাধিক মিছিল সংগঠিত করেন। এ এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শ্রমজীবী মানুষরাও ছিলেন এবং থাকছেন।
আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেছিলেন শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষেরা। জীবনধারণের উপকরণ সংগ্রহে বিপর্যস্ত, সরকারি অনুদান থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে সঙ্কুচিত খেতমজুর-দিনমজুরের পক্ষে সংগঠিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো তুলনায় কঠিন। তবু এই আন্দোলনে তাঁরা প্রথম থেকেই রাস্তায় নেমেছেন।
কমল কুমার দাশ, কলকাতা-৭৮