প্রতীকী ছবি।
উত্তরপ্রদেশের হাথরসে যা দেখা গেল, তা অত্যন্ত উদ্বেগের। নির্যাতিতার পরিবার চরম নিরাপত্তাহীন। এ কোন রাজত্ব, যেখানে অপরাধীরা প্রকাশ্য দিবালোকে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর অভিযোগকারীদের নিরাপত্তার জন্য সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেতে হচ্ছে? আর সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করলেই যোগী আদিত্যনাথের সরকার রাজনীতিক থেকে সাংবাদিক, সকলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করছে। সরকার ধর্ষক ও খুনিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনের ৩৭৬, ৩০২ ধারা প্রয়োগ করতে পারে না, অথচ নির্যাতিতার পরিবারের পাশে কেউ দাঁড়াতে গেলে তাঁর উপর ১৪৪, ১৮৮ ধারা প্রয়োগ করা হয়। যে সরকার অপরাধীদের বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী মামলা করতে পারে না, সেই সরকারের পুলিশ প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে ১৯টি এফআইআর করার স্পর্ধা পায় কী করে? এটাই কি রাম রাজত্ব?
আমরা দেখছি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ধৃতরাষ্ট্রের মতো চুপ করে বসে আছেন। এই অন্যায়ের বিচার কি হবে না? নারীর প্রতি অন্যায়, নির্যাতনের বিচার না হলে কত ভয়ানক সংঘাত লাগতে পারে, তার সাক্ষী দিচ্ছে প্রাচীন মহাকাব্য। জনগণ চাইলে এক দিনে সমাপ্তি ঘটতে পারে অধর্মের শাসনের। তার পর জন্ম নেবে এক নতুন ভারত, যেখানে মনুবাদ প্রতিষ্ঠা করার কেউ থাকবে না। প্রতিষ্ঠিত হবে বিজ্ঞানমনস্ক চেতনা এবং ন্যায়।
সনাতন পাল
বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর
সাহায্যের হাত
সুযোগসন্ধানীরা যখন দেখে শত অপরাধ করলেও সে শাস্তি পাবে না, অপরাধীর সংখ্যা তখন বাড়বেই। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা অসহায়কে আরও অসহায় করে দেয়, অপমানিতকে আরও জীবনবিমুখ করে। এমন তো ছিল না আমাদের জীবন! প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কখনও মনে পড়ে না সহ-পড়ুয়াদের থেকে আদবহীন ব্যবহার পেয়েছি। বরং কত জনের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছি। নিজেদের সন্তানের জন্য তেমনটা করতে কি আমরা ব্যর্থ?
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া। হুটহাট ভার্সিটি বন্ধ হয়ে যেত দু’দল ছাত্রের মারামারিতে। আর আমরা যারা দূরের যাত্রী, তাদের হত বিপদ। সে-বারও সুপারের আদেশ মেনে হস্টেল থেকে সকাল আটটায় রওনা দিলাম বাগেরহাটের পথে। দশটায় গাবতলি থেকে বাস ছাড়ল। যাত্রী কম, মহিলা আরও কম। বেলা চারটেয় বাস খুলনা পৌঁছনোর পর ফেরি ধরে পাঁচটায় বাগেরহাটের বাস ধরায় সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। নানা কারণে বাসটা সে দিন অনেক দেরি করল। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। বুঝে নিয়েছি, বাগেরহাট যাওয়ার বাস আজ আর পাব না। দুই সহযাত্রী বলে গেলেন, বাস সুপারভাইজ়ারের সাহায্য নিতে। বাস থামলে মিলন নামের এক অল্পবয়সি সুপারভাইজ়ার আমার সমস্যা শুনলেন। বাড়ির অবস্থান জেনে নিয়ে মাত্র দশ মিনিটে আমাকে পৌঁছে দিলেন গন্তব্যে।
সে দিনের সেই সহযাত্রী দুই নাম-না-জানা তরুণ এবং সুপারভাইজ়ারের প্রতি শ্রদ্ধা আজও অটুট। এখনও হয়তো তেমন পড়ুয়া আর সুপারভাইজ়ার আছেন, কিন্তু বিশ্বাসটা আর শক্তপোক্ত নেই।
তপতী রায়চৌধুরী
দক্ষিণপাড়া, বারাসত
শুধুই রাজনীতি
ভারতের যে কোনও প্রান্তে, ধর্ষণের ঘটনা ঘটুক না কেন, সেখানে তখন একটা ‘নির্বাচিত’ সরকার থাকে। তা সে যে-দলেরই হোক। ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে নৃশংসতার ‘ধরন’ নিয়ে আলোচনা করা বিকারগ্রস্ত রাজনীতিকদের কারবার, ধর্ষণকাণ্ড যাঁদের পরবর্তী নির্বাচনের মূলধন মাত্র। দিল্লির মুনিরকা, পশ্চিমবঙ্গের বানতলা কিংবা কামদুনি, উত্তরপ্রদেশের হাথরস যখন এক সারিতে দাঁড়ায়, তখন সেগুলো ‘রাজনৈতিক’ সমস্যা হিসেবে হাজির হয় ভোটসর্বস্বদের সামনে। এ প্রসঙ্গে আবার ১৯১৭ সালের রবীন্দ্রউক্তি আমাদের মনে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে, ‘‘ভারতে আমাদের প্রধান সমস্যা রাজনৈতিক নয়, সামাজিক’’ (‘ন্যাশনালিজ়ম ইন ইন্ডিয়া’, ১৯২১)।
কোনও শাসক যখন ধর্ষণের প্রতিবাদ হলেই বলে ওঠেন ‘বিরোধীরা রাজনীতি করতেই ব্যস্ত’, কিংবা ‘এ রকম তো কতই হয়’ বা ‘এটা সাজানো ঘটনা’— ধর্ষিতার স্বজনেরা তখন শাসক দলের ঝান্ডার রং দেখে শান্তি পান বলে মনে হয় না! বরং সংসদীয় রাজনীতির ঘৃণ্য ও অমানবিক চেহারাটাই তখন উলঙ্গ হয়ে পড়ে। কয়েক জন অপরাধীর ফাঁসি হলে, কয়েক জন পুলিশকে ‘শাস্তি’ দিলেও, ধর্ষণের মতো গভীর মানবিক-সামাজিক অবক্ষয়ের শিকড়কে তা কোনও দিন স্পর্শও করতে পারবে না। কিন্তু সে দিকে বাস্তবিকই নজর দিতে গেলে পরবর্তী নির্বাচনে ভোট কমে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল! এমতাবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক কর্মসূচির বদলে শুধুই চটকদার এবং সঙ্কীর্ণ, সাময়িক ‘রাজনৈতিক’ প্রতিবাদের রাস্তায় হাঁটাই তো সংসদীয় রাজনীতির কারবারিদের পক্ষে স্বাভাবিক। যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে।
কংগ্রেস রাজত্বে কোথাও ধর্ষণ হলে আমরা কি কংগ্রেসি নেতা-নেত্রীদের প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখি? বাম আমলে সিপিআই(এম) নেতা-নেত্রীদের, কিংবা তৃণমূলের শাসনকালে সেই দলের নেতা-নেত্রীদের ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কর্মসূচিতে কখনও শামিল হতে দেখেছি? বিজেপি রাজত্বে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনার পরেও বিজেপি নেতা-নেত্রীরা যে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠেন না, তা কি সত্যিই আশ্চর্য হওয়ার মতো ঘটনা? বরং যাঁরা প্রকৃতই সামাজিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের রাস্তায় হাঁটার চেষ্টা করেন, সেই প্রতিবাদী শক্তিকেই ‘মাওবাদী’, ‘দেশবিরোধী’ তকমা লাগিয়ে শাসক দলের তরফে সর্বদা হুমকি-ধমকি দিতেই আমরা দেখি।
দীপক পিপলাই
কলকাতা-৩৮
আশ্চর্য শক্তি
‘‘তরণী ডুবছে কিন্তু আমি সূর্যোদয় দেখব’’— দার্জিলিং পাহাড়ে বসু ভিলায় ১৩ অক্টোবর, ১৯১১ সালে অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে ভগিনী নিবেদিতার শেষ কথা। উত্তরবঙ্গের এই শহরটিকে নিবেদিতা সত্যিই খুব ভালবেসে ফেলেছিলেন। কলকাতার প্রচণ্ড গরমে আলোপাখাহীন ঘরে বাস করা, বই লেখা, পল্লির ঘরে ঘরে গিয়ে বিদ্যালয়ের জন্য ছাত্রী জোগাড় করা দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিস্মিত হয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘‘নিজেকে এমন করিয়া সম্পূর্ণ নিবেদন করিয়া দিবার আশ্চর্য শক্তি আর কোন মানুষে প্রত্যক্ষ করি নাই।’’
এক আইরিশ কন্যা তাঁর পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, আশা, স্বপ্ন, সব কিছু পিছনে ফেলে কী করে এক ব্রহ্মচারিণীতে পরিণত হলেন, সে এক বিরল ঘটনা। ১৮৯৯ সালে প্লেগ মহামারিতে আক্রান্ত কলকাতার বস্তিতে অবিরত সেবা করেছেন তিনি। নিজের জীবন বিপন্ন করে বাগবাজার পল্লিতে স্বামী সদানন্দকে নিয়ে তিনি সেবাকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যদুনাথ সরকার লিখছেন, ‘‘একদিন বাগবাজারের রাস্তায় দেখলাম ঝাড়ু ও কোদালি হাতে এক শ্বেতাঙ্গিনী মহিলা স্বয়ং রাস্তার আবর্জনা পরিষ্কার করিতে নামিয়াছেন। তাঁহার দৃষ্টান্তে লজ্জাবোধ করিয়া বাগবাজারের পল্লীর যুবকেরাও অবশেষে ঝাড়ুহাতে রাস্তায় নামিল।’’ নিবেদিতার নিঃস্বার্থ সেবাকাজের সীমা নির্ধারণ করা কঠিন। তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ দার্জিলিঙের এক প্রান্তে অনাড়ম্বর ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাতে লেখা, ‘‘হিয়ার রিপোজ়েস সিস্টার নিবেদিতা হু গেভ হার অল টু ইন্ডিয়া।’’
নিবেদিতার প্রয়াণ সংবাদ শহরে ছড়িয়ে পড়লে বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তাঁর শেষযাত্রায় অংশ নেন। পুজোর ছুটি থাকায় তাঁরা সে সময় দার্জিলিঙেই উপস্থিত ছিলেন। জগদীশচন্দ্র বসু, নীলরতন সরকার, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখ ছিলেন শেষযাত্রায়। বিশ্ববাসীর কাছে লেবং কার্ট রোডের রায় ভিলা পরিণত হয়েছে এক পবিত্র তীর্থস্থানে।
সত্যজিৎ চক্রবর্তী
বিবেকানন্দ পাড়া, ধূপগুড়ি
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।