—ফাইল চিত্র।
বিন্দু আর আফসানা— নার্সারি থেকে এক সঙ্গে পড়েছে। থাকেও এক পাড়ায়। গলাগলি ভাব। অভাবের সংসারের দুই মেয়ে— বিন্দু আধখানা কলা খেয়ে রেখে দেয় বন্ধুর জন্য— আফসানা আচার খেয়ে বন্ধুর মুখে তুলে দেয়। রাস্তার কল থেকে জল আনতে গেলে একে অন্যের জলের বোতল ভরে আনে। এক জন ছুটি নিলে অন্য জনকে দেখে মনে হয় জীবনের সব আনন্দ মুছে গেছে।
সরস্বতী পুজোতে এখানে ছুটি হয় না। সকালের প্রেয়ারের পর এক-একটি শ্রেণির ছাত্রীরা পুজো মণ্ডপে যায়। প্রণাম করে— একটি প্রার্থনা সঙ্গীত গায়— প্রসাদ নিয়ে ক্লাসে চলে যায়। এমনই একটি সরস্বতী পুজোর দিন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীরা এসেছে সারিবদ্ধ ভাবে। হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছে তারা। পুরোহিত সবার হাতে ফুল দিলেন। পুষ্পাঞ্জলি দিল ছাত্রীরা। লক্ষ করলাম সবাই ফুল নেয়নি। এ বার প্রসাদ নেওয়ার পালা। ক্লাস টিচার সবার হাতে মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিচ্ছেন।
আফসানা নিল না সেই মিষ্টি। ক্লাস টিচার তাকে জোর করে হাতে ধরিয়ে দিলেন। আড়ষ্ট ভাবে যে নিল প্যাকেটটি। নিয়েই বন্ধুকে ধরিয়ে দিল। বাচ্চারা একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে হল থেকে। বিন্দু বার বার বন্ধুকে বলছে মিষ্টিটা খেতে। আফসানা কিছুতেই খাবে না। বন্ধুকে জানাল, মা বারণ করেছে, বলেছে প্রসাদ খাবে না, ওটা আমাদের খেতে নেই। বিন্দু বলছে, তুই তো আমার খাবার খাস, আফসানা উত্তর দেয়— তোরটা তো প্রসাদ নয়, মা প্রসাদ খেতে বারণ করেছে, প্রসাদ খেলে পাপ হবে। বিন্দু নাছোড়বান্দা, এত ভাল মিষ্টি, বন্ধু খাবে না! তা হলে সেও খাবে না। বলে, চুপিচুপি খেয়ে নে, কেউ জানতে পারবে না। আফসানার জবাব— মাকে কিছু লুকোনো যায় না, মা সব জেনে যায়, মা বলেছে। বিন্দু মরিয়া— তুই না খেলে আমিও খাব না। তাতে কিন্তু আমার পাপ হবে।
আফসানা পড়েছে মহা মুশকিলে। সে শুনেছে পাপ করলে ঈশ্বর শাস্তি দেন। তার জন্য বন্ধু শাস্তি পাবে, এটা হয় না। বন্ধুকে পাপ ভোগ থেকে বাঁচাতে মিষ্টি মুখে দেয় আফসানা। বিন্দু আহ্লাদে আটখানা। বন্ধু তার কথা রেখেছে। আসল ঘটনাটা ঘটল এর পর। মিষ্টি মুখে দিয়ে আফসানার মনে হল এক বার প্রণাম করা উচিত। সে বিন্দুকে বলল, চল প্রণাম করে আসি, আগে করিনি। দু’জন মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল ভক্তি ভরে। কোনও ধর্ম নয়, বাধ্যতা নয়, শাসন নয়, জয় হল বন্ধুত্বের। এইটুকুই তো চাওয়া— মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। প্রতিটি শিশু মিলেমিশে মানুষ হোক, সুস্থ পৃথিবী গড়ার কারিগর হোক।
জয়শ্রী বসু, নয়ডা, উত্তরপ্রদেশ
কবি ও গরম
সে বছর শান্তিনিকেতনে অনাবৃষ্টিতে ও প্রচণ্ড রৌদ্রের তাপে চার দিকের গাছপালা সব যেন ঝলসে গেছে। গাছগুলির যা অবস্থা, তাতে মনে হচ্ছিল যে সে বার যেন বেলফুল আর ফুটবে না। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল— একটু সৌন্দর্যের কাঙাল আমরা, তাতেও ঈশ্বরের এত কার্পণ্য! বলতে বলতে তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন। হুহু করে গরম হাওয়া বইছে। চার দিক থেকে গরম একটা তাপ উঠছে। কিন্তু এর মধ্যে তাঁর মুখের ভাব বদলে গেছে। আগের বিরক্তি সরিয়ে এক বিস্ময়মুগ্ধ ভাব ফুটে উঠেছে। কিসে যেন তন্ময় হয়ে গেছেন। ধীরে ধীরে বললেন— ভাল, বড় ভাল, বড় সুন্দর এই পৃথিবীটা। দু’চোখ মেলে যা দেখেছি, তা-ই ভালবেসেছি। বলতে বলতে ডান হাতখানি সামনে মেলে ধরে উৎফুল্ল হয়ে গেয়ে উঠলেন— ‘এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়’। ৯ মার্চ, ১৯৩৯ সালে রানী চন্দের দিনলিপির পাতায় গ্রীষ্মের প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথের অনন্য সম্পর্কের কথা ধরা রয়েছে।
গরমে কখনও তাঁর কাজের অভিনিবেশ নষ্ট হত না। গ্রীষ্মের দুপুরে দেহলী বাড়ির বারান্দায় বসে কবিতা লিখতেন। সেই রোদের ঝাঁঝ, হা-হা করা গরম হাওয়ায় তাঁর কবিতা লেখার আবেশ নাকি গাঢ় হয়ে উঠত। দরজা-জানলা বন্ধ করে যখন সবাই আরামে বিশ্রাম করছেন, তখন তিনি একটানা লিখে চলেছেন; হাতে একখানা হাতপাখা।
বরং বীরভূমের অসহ্য গরম রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতাকে বিচিত্র দিকে চালিত করত। যেমন গরমে বসবাসের উপযোগী বাড়ি তৈরির নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রথাগত মাটির দেওয়াল আর খড়ের চালের ঘরে গরম নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বেড়ে যেত। সেই সমস্যা সমাধানে ইটের ছাদ তোলা যায়। কিন্তু সাধারণ দরিদ্র মানুষের পক্ষে সেই ব্যবস্থা খরচসাপেক্ষ। তাই মাটির ছাদ তৈরি কথা ভাবলেন তিনি। শুধু ভাবলেনই না, হাতে-কলমে তৈরি করে দেখালেন ভুবনডাঙার গৌরদাস মণ্ডল মিস্ত্রির সাহায্যে। তৈরি হল শ্যামলী। ১৯৩৫ সালে তাঁর পঁচাত্তরতম জন্মদিন পালনের পর কবি এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। দেশীয় প্রযুক্তিভিত্তিক আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জনের এক মডেল যেন এই প্রয়াস। পরে আশ্রমের ছাত্রাবাসটিও তৈরি হয় সেই প্রযুক্তিতে।
এক বার চন্দননগরে থাকার সময় দেখেছিলেন হাঁড়ির গাঁথনি দিয়ে তৈরি দেওয়াল। সেই ভাবেই গড়ে তুললেন শ্যামলী বাড়ির উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরখানা। হাঁড়িগুলোর পিঠ রইল বাইরের দিকে আর মুখের দিক দেওয়ালের মধ্যে। এই নির্মাণের পিছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তি ছিল যে, গরম হাওয়ার ঝাঁঝ হাঁড়ির গহ্বরের মধ্য দিয়ে পেরিয়ে আসতে আসতে অনেকটা ঠান্ডা হয়ে যায়। ফলে ঘরের ভিতরের তাপমানও থাকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। সুধীরচন্দ্র কর তাঁর কবি-কথা গ্রন্থে জানিয়েছেন যে, এক জন পণ্ডিত গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে এসে ঘর ঠান্ডা রাখার এই অভিনব প্রণালীর সমর্থন করেছিলেন।
অমিতাভ পুরকায়স্থ, কলকাতা-১২৯
উৎসব
‘ষোলো কলা পূর্ণ’ (২৩-৪) শীর্ষক সম্পাদকীয় অত্যন্ত সাহসী এবং বর্ণে বর্ণে সত্য। এই রাজ্যে রামনবমীতে অস্ত্র ঝঙ্কার খুব বেশি বছর শুনছি না। যাঁরা শুরু করেছেন, তাঁদের প্রাথমিক লক্ষ্য অবশ্যই মুসলমানেরা। তাঁদের মহরমের মিছিলের পাল্টা কিছু করা। রাজ্যের শাসক দল, প্রধানত ভোট রক্ষার তাগিদে, প্রথমে প্রতিবাদ করত, বিবৃতি দিত। এখন তারা দল সরকার মিলেমিশে হিন্দুদের আশ্বস্ত করতে আসরে নেমে পড়েছে। এনআই অ্যাক্টে ছুটি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, সব কিছু বন্ধ থাকবে, দুই পক্ষই রামের নামে মুখোমুখি সমরে নামবে। দেশ রাজ্য সব জলাঞ্জলি যাক।
এমন নয় যে, আগে আমাদের রাজ্যে রামনবমী পালিত হত না। উত্তর কলকাতার শেষ প্রান্তে যে বিশাল আবাসনে আমরা বাস করি, সেখানে একমাত্র কার্তিক পুজো ছাড়া গণেশ পুজো থেকে শুরু হয়ে সরস্বতী পুজো অবধি সব পুজো হয়। দোল, হোলি, ক্রিসমাস, ইংরেজি বর্ষবরণ, পয়লা বৈশাখ ও রামনবমী পালিত হয়। সব ক্ষেত্রেই উৎসবের আমেজে মিলনমেলা। স্থায়ী মন্দিরে নীলপুজো, নবরাত্রির পাশাপাশি রামনবমী হয়। রামনবমীতে সারা দিন পুজোর পর সন্ধ্যায় আরতি-শেষে ভক্তিমূলক গানের আসর বসে। অতঃপর সকলের জন্যে ভরপেট খাওয়ার ব্যবস্থা। প্রতিটি অনুষ্ঠানে আনন্দ আর আনন্দ। এত দিন শুধু এলাকার কাউন্সিলর আসতেন।
আর এ বার! সেখানে তিনটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা হাজির। প্রথমে সন্ধ্যায় বিজেপির প্রার্থী, যথারীতি উত্তরীয় ইত্যাদি গলায় জড়িয়ে মন্দির প্রদক্ষিণ, জনসংযোগ। একটু বেশি রাতে তৃণমূলের প্রার্থী। ধরনধারণ মোটামুটি এক। আর এই দু’জনের মাঝামাঝি সময়ে এলেন বামপন্থী প্রার্থী। তাঁর গলায়ও উত্তরীয়। তিনিও মন্দিরে ঢুকলেন। এঁদের কাউকেই সে ভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তবে কী আর করা যাবে! হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট, দু’হাজার পেরিয়ে ভোটার, তিনটে বুথ। না এলে অন্যায় হবে না!
প্রসঙ্গত, আবাসনে নিজেদের ভোটও হয়। সারা রাত ধরে গোনা হয়, বিভিন্ন গোষ্ঠীর তরফে প্রার্থীরা থাকেন। না, কারও গায়ে রাজনৈতিক দলের তকমা থাকে না। এটিও আবাসনের আর একটি উৎসব।
বিকাশ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৫০