উত্তরাখণ্ডের জোশীমঠ। ফাইল ছবি।
উত্তরাখণ্ডের জোশীমঠের তলিয়ে যাওয়ার খবরে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। সম্পাদকীয় (‘বিপর্যয়?’, ১০-১) ও বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনগুলি পড়লে তা বোঝা যায়। ছোট পাহাড়ি শহরটির বসে যাওয়ার কারণগুলি নির্দিষ্ট ভাবেই লেখা হয়েছে। প্রথমে শিল্প বিপ্লব, তার পর এখনকার পুঁজিবাদী অর্থনীতির পরিণতি হল প্রকৃতির এই করুণ বিপর্যয়। ভবিষ্যতে এই পৃথিবী আর বাসযোগ্য থাকবে কি না, সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামও এই বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে গিয়েছেন। কী হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের? সেই অতি জরুরি কথাটি এখন কেউ ভাবছেন না, শুধু বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পরিবেশ নিয়ে একের পর এক নিষ্ফলা বৈঠক হয়ে চলেছে। সরকারের সাহায্যে কর্পোরেটদের আকাশছোঁয়া লোভের কাছে সাধারণ মানুষ আজ বড় অসহায় হয়ে পড়েছে।
জোশীমঠ আদি শঙ্করাচার্যের আশ্রম বা পীঠ। সেই কারণে, প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের ‘চারধাম’ সংযুক্ত করার প্রাপ্তি হল এই ধস। প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করে উন্নয়ন যে মূর্খামি, তার প্রমাণ আমরা নিয়মিত দেশ-বিদেশের খবরে দেখে থাকি। কিন্তু শাসকরা তা মানতে চান না। ওই অঞ্চলে টিহরী বাঁধ যে কী সর্বনাশ করতে চলেছে, টিহরী বাঁধ কর্তৃপক্ষের এক আধিকারিকের কাছে তা শুনেছিলাম ২০০৯ সালে।
মনমোহন সরকারের পাশ করা জঙ্গলের অধিকার আইনটি বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার বাতিল করেছে, ও বন্ধু শিল্পপতিদের আরও ধনী হওয়ার রাস্তা মসৃণ করে দিয়েছে। এখন যথেচ্ছ খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ওই শিল্পপতিদের দখলে চলে যাবে। আর জনজাতিরা অনিশ্চিত জীবন কাটাবেন। দেখা যাক, ধর্মের আফিম ও নাগপুরের পাঠশালার পাঠ আর কত দিন জনসমর্থন টিকিয়ে রাখে। হ্যাঁ, মানুষ জানে যে, ফ্যাসিস্ট-রাজ এখন গণতন্ত্রের নাম করেই চলে। নাৎসি নেতা জোসেফ গোয়েবলসের এক বিখ্যাত উক্তি আছে— একটি মিথ্যাকে গুছিয়ে, বিশ্বাসযোগ্য ভাবে বহু বার বললে মানুষ এক সময় সেই মিথ্যাকেই সত্যি বলে মনে করবে। ভারতে এখন সেই পর্বই চলছে।
প্রদীপকুমার চক্রবর্তী, কলকাতা-১০৮
প্রকৃতির বিরুদ্ধে
উন্নয়নের তকমার আড়ালে প্রাকৃতিক সম্পদের বিনাশ নতুন কিছু নয়। উত্তরাখণ্ডের (তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ) অলকানন্দা, মন্দাকিনীর তীরবর্তী অঞ্চলে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন রুখে দিয়েছিলেন সুন্দরলাল বহুগুণা, তাঁর যুগান্তকারী চিপকো আন্দোলনের মাধ্যমে। এক-একটি বৃক্ষ জড়িয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর এক-এক জন মহিলা সদস্য, যার পরিণামে তদানীন্তন সরকারকে পিছু হটতে হয়েছিল।
বেশ কয়েক দশক ধরে সরকারি স্তরে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের তোয়াক্কা না করেই পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, নদী, অরণ্যকে বাগে এনে উন্নয়নের জোয়ার আনার অপচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। উত্তরকাশী, কেদারনাথ, এবং সম্প্রতি জোশীমঠের প্রকৃতির প্রতিশোধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, উন্নয়নের নামে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করা কত ধ্বংসাত্মক হতে পারে। কিন্তু উন্নয়ন বড় বালাই! সব রাজ্যেই পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক দফতর, কমিটি আছে। কিন্তু সেগুলি মাঝেমধ্যে জেগে ওঠে, অন্য সময়ে সমাধিস্থ থাকে। পশ্চিমবঙ্গেও যেমন গঙ্গাসাগর-সহ বিভিন্ন মেলাতে কি পুরোপুরি দূষণমুক্ত পরিবেশ রক্ষা করা গিয়েছিল? এর জন্য দরকার জনসচেতনতা। এভারেস্ট শিখরে সর্বপ্রথম আরোহণ করে তেনজিং নোরগের সেই বিখ্যাত ক্ষমাপ্রার্থনা স্মর্তব্য— হে দেবতা, যদি আমাদের পদস্পর্শ তোমাকে অপবিত্র করে থাকে, তবে অবোধজ্ঞানে, সন্তানজ্ঞানে আমাদের ক্ষমা কোরো। এই উক্তি প্রকৃতিপ্রেমের এক অভিনব নিদর্শন!
সুবীর ভদ্র, ডানকুনি, হুগলি
খেসারত
হিমালয়ের কোলে গড়ে ওঠা পাহাড়ি শহর জোশীমঠ ক্রমশ পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তরাখণ্ডের এই জনপদ আজ বসবাসের উপযুক্ত নয়। এই বিপর্যয় কি প্রাকৃতিক বিপর্যয়, না মানুষের তৈরি? গাছ কাটা, পাহাড় কেটে জাতীয় সড়ক চওড়া করার কাজ, একাধিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ, চারধাম প্রকল্প, বহুতল ভবন, হোটেল, বাড়ি শুধু নয়, বিস্ফোরক ব্যবহার করে মাটির নীচে সুড়ঙ্গ করার কাজ, সব কিছু পরিবেশকে বিপন্ন করছে। অথচ, ১৯৭৬ সালে মিশ্র কমিশন জোশীমঠ নিয়ে সাবধান করেছিল। ভূমিকম্পপ্রবণ এই এলাকা অত্যন্ত আলগা ভূমিস্তরের উপরে অবস্থিত। বলা হয়েছিল, জোশীমঠে কোনও বড় নির্মাণ করা যাবে না, গাছ কাটা যাবে না, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করা একদমই নিরাপদ নয়। কিন্তু এ দেশে তো সবার উপরে রাজনীতি সত্য! ভোটের জন্য উন্নয়নের ডঙ্কা বাজাতে গিয়ে পরিবেশগত সমস্ত নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে দেওয়ার চরম খেসারত দিচ্ছে এই অঞ্চল।
প্রশ্ন হচ্ছে এর পর কে? হোটেল, বহুতল, রাস্তা, ব্রিজ নিয়ে তৈরি আজকের দার্জিলিঙে চা বাগান হয়েছে হোটেল, আর জঙ্গলে হয়েছে পার্ক। দিঘাকে আরও সুন্দরী করতে গিয়ে ঝাউগাছ কেটে বালিয়াড়ি ধ্বংস করে রাস্তা, পার্ক তৈরি করা হয়েছে, সমুদ্রতীর গ্রাস করেছে হোটেল। সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন বেআইনি নির্মাণ। যে বালিয়াড়ি প্রকৃতির তৈরি বাঁধের কাজ করত, উন্নয়ন তাকে খেয়ে ফেলেছে।
সুন্দরবনেও চলছে উন্নয়নের রথ। ম্যানগ্রোভ কেটে তৈরি করা হচ্ছে ভেড়ি। জঙ্গল কেটে তৈরি হচ্ছে হোটেল, রিসর্ট। ম্যানগ্রোভ শুধু সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখেনি, বৃহত্তর কলকাতাকে ঝড়, সাইক্লোন থেকে শতাব্দীর বেশি সময় ধরে রক্ষা করে এসেছে। উন্নয়নের ডঙ্কা যদি এই ভাবে বেজে চলে দিকে দিকে, তা হলে দার্জিলিং, দিঘা, সুন্দরবন, কোথায় গিয়ে শেষ হবে বিপর্যয়ের এই তালিকা, তা কেউ বলতে পারে না।
সৌগত মাইতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
তথ্য গোপন
‘জোশীমঠ নিয়ে মুখ খুলতে মানা নির্দেশিকায়’ (১৫-১) প্রতিবেদনটি কেন্দ্রীয় সরকারের অগণতান্ত্রিক মনোভাবের প্রকাশ। যে সংবাদে কেন্দ্রীয় সরকারের ভাবমূর্তির বিন্দুমাত্র ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তেমন সংবাদ আগামী ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে কিছুতেই যাতে প্রচারিত না হয়, তার চেষ্টা সব রকম ভাবে করে চলেছে বিজেপি সরকার। সেই জন্যই ইসরোর মতো সরকারি সংস্থাকেও রিপোর্ট প্রকাশ করে আবার ওয়েবসাইট থেকে মুছে ফেলতে হয়। যে সংবাদই হোক না কেন, যদি তা সরকারকে অপ্রিয় প্রশ্নের মুখে ফেলার সম্ভাবনা তৈরি করে, সরকার সেটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগবে।
এর আগেও আমরা দেখেছি, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা, বা দেশের বিভিন্ন সংবেদনশীল সীমান্তে চিনা সৈন্যের সঠিক অবস্থান নিয়ে সরকারি তরফে একটা ধোঁয়াশা তৈরির চেষ্টা চলেছে। এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে যে কোনও সচেতন নাগরিক বিভিন্ন সাইটে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারেন এবং তখনই হতে হয় ভুল তথ্য বা বিকৃত তথ্যের শিকার। তার চেয়ে সরকারই যদি কারচুপি না করে সঠিক তথ্য প্রকাশ করে, তবে দেশের মানুষই সাদরে তা গ্রহণ করবেন।
আজ জোশীমঠে যা দেখা যাচ্ছে, সেই অবস্থা যে কোনও দিন যে কোনও পার্বত্য শহরে দেখা যেতে পারে। অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, পরিবেশের প্রতি বিন্দুমাত্র মনোযোগ না দেওয়ার ফলে প্রায় সমস্ত পার্বত্য শহরই আজ বিপদের সম্মুখীন। যে ঘটনায় শাসকের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, সেই ঘটনার দামামা বাজানো হবে সারা দেশ জুড়ে। আবার যদি বিন্দুমাত্র সংশয় থাকে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার, তা হলে প্রকৃত তথ্য প্রকাশিত হবে না। ফলে, সাধারণ নাগরিক অসহায়।
সুরজিত কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি