তৃষ্ণা বসাক তাঁর ‘বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি’ (১১-১১) শীর্ষক প্রবন্ধে মানবজীবনের সঙ্গে ব্যবহৃত বাসনকোসনের যে সম্পর্ক এঁকেছেন, তা যথার্থ। বাসনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশ, কাল, সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিত্ব এমনকি ভালবাসা। অর্ধ শতক আগে পূর্ববঙ্গে আমার ছোটবেলায়, ধবধবে সাদা থান পরা, ছোট করে চুল ছাঁটা বিধবা ঠাকুরমা একমাত্র শ্বেতপাথরের থালা, বাটি, গেলাসেই খেতেন। তিনি ছিলেন প্রাচীন জমিদার বাড়ির বধূ। জমিদারি প্রথা অবলুপ্ত হলেও তিনি ঠাটবাট বজায় রেখে চলতেন। বাড়িতে কালো পাথরের বাসনও ছিল। সেগুলিতে শিন্নি মাখা, ফল কেটে রাখা হত। ঠাকুরমা কোনও দিন কালো পাথরের থালায় খাননি। কাশী থেকে আনা পিতলের ঘটিটি কারও ধরার অনুমতি ছিল না। তাঁর নিজস্ব একটা ভারী ডালাওয়ালা বড় কাঠের বাক্সে ছিল অনেক রুপোর বাসন। একমাত্র ছেলে বা নাতিদের জন্মদিনে সে বাসন বার হত। আমরা মাটিতে কাঠের পিঁড়ি পেতে কাঁসার থালা, বাটি, গেলাসে ভাত খেতে বসতাম।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতায় সব ফেলে রেখে এ-পার বাংলায় চলে আসতে হয়েছিল। টানাটানির সংসারে মায়ের হাতে কিছু টাকা জমলেই দুপুরে যে কাঁসারি ফেরিওয়ালারা তখন ঢং ঢং শব্দ করে যেতেন, তাঁদের কাছ থেকে তিনি দু’-একটা করে কাঁসার বাসন কিনতেন। অথচ, আমরা তখন স্টিলের বাসনে খাই, কাজের মাসিও কাঁসার বাসন মাজতে রাজি নন। মা হেসে বলতেন, গৃহস্থের বাড়িতে ও-সব রাখতে হয়। কলেজে স্পোর্টসের ‘যেমন খুশি সাজো’ প্রতিযোগিতায় একটা ঢাকনা দেওয়া বড় স্টেনলেস স্টিলের বাটি প্রাইজ় পেয়েছি, মাকে দিতে বললেন, “পানের ডাবর হবে”। মনে পড়ল, মায়ের এমনই একটা পিতলের পানের ডাবর ছিল। সেখান থেকে পান-সুপারি নিয়ে হামানদিস্তায় থেঁতো করে একটা সুন্দর নকশা করা রুপোর পানের ডিবেতে রেখে, প্যাঁচে আটকে, আমার হাতে দিতেন ঠাকুরমাকে দেওয়ার জন্যে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাসন বদলের মতো জীবনও বদলে যায়। এক সঙ্গে অফিস-সংসার সামলাতে যখন যে বাসন সুবিধের, তা-ই ব্যবহার করি। রোজকার দরকারে স্টিলের বাসন, অতিথি আপ্যায়নে চিনেমাটির বা কাচের বাসন ইত্যাদি। সবচেয়ে ভালবাসি কলাপাতা বা পদ্মপাতায় খেতে। আমাদের, শুধু মেয়েদের তিরিশ-চল্লিশ জনের দল যখন এক দিনের ডে-আউটে যাই, দুপুরে শুধুমাত্র মাটির বাসন বা শালপাতা, কলাপাতায় খাই, দূষণ সৃষ্টিকারী প্লাস্টিক বা থার্মোকলের বাসনে নয়। তবে বাড়িতে আমিও কয়েকটা রুপোর বাসন কিনে আলমারিতে তুলে রেখেছি। কখনও-সখনও ছেলের জন্মদিনে বার করি। একে কী বলা যায়? স্মৃতির সুতোর টান?
শিখা সেনগুপ্ত, কলকাতা-৫১
বাসনে পরিবর্তন
আগেকার দিনে বাঙালি মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত বাড়িতে মাটির হাঁড়ি, সরা, জল রাখার জন্য মাটির কলসি, কুঁজো আকছার ব্যবহার হত। মাটির পাত্রের ব্যবহার খুবই স্বাস্থ্যকর। অর্থমূল্যও খুব বেশি নয়। অনেকে আবার বিশেষ উপলক্ষে বিশেষ বাসন ব্যবহার করতেন। যেমন— উচ্চবর্ণের বিধবা মহিলারা পাথরের থালায় খেতেন, পুজোয় কাঁসা-পিতলের বাসন ব্যবহার করা হত। আবার উচ্চবিত্ত বাড়িতে দামি কাচের ডিনার সেট, রুপোর বাসন ব্যবহার করা হত। পরবর্তী কালে, মাটি, কাঁসার বাসনের পরিবর্তে এল স্টিলের বাসন। পরিষ্কার করা সহজ, এক বার কিনলে বহু দিন যায়, দামও নাগালের মধ্যে।
তবে এখনকার রান্নাঘর থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে শিলনোড়া, পরিবর্তে এসেছে মিক্সার গ্রাইন্ডার, আনাজপাতি, মাছ-মাংস কাটার বঁটির পরিবর্তে ব্যবহার হয় ছুরি বা চপার। বেশি পরিশ্রম করতে হবে না, সহজেই কাজ সারা যাবে এমন যন্ত্র আপন করে নিয়েছে মানুষ। সুপারি কাটার জাঁতি, পানের ডাবর— এই সব সম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই নতুন প্রজন্মের। তবে আবারও পুরনো জিনিসের কদর বাড়ছে। তাই প্লাস্টিকের বদলে তামার ওয়াটার ফিল্টার, বোতলের বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে। মা-দিদিমার আমলের চিনেমাটির আচারের বয়ামের চাহিদা বাড়ছে। আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাসন ব্যবহারেরও পরিবর্তন এসেছে।
সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া
সাহিত্যে তৈজস
‘বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি’ বাঙালির রান্নাঘর ও বাসনের বিবর্তনের উপর এক উজ্জ্বল আলোকপাত। মনে পড়ে যাচ্ছে লীলা মজুমদারের রান্নার বই-এর কথা। লীলা মজুমদার সেই বইয়ে ঘরোয়া ভঙ্গিতে রান্নার কথা তো বলেইছেন, সেই সঙ্গে রান্নাঘরে মেয়েদের যাতে সুবিধে হয়, সে রকম বাসনকোসনও রাখতে বলেছেন। তিনি বলছেন, “আমাদের রান্নাঘরে দুটি মাঝারি-মাপের, পুরু, পেটানো লোহার তাওয়া আর একটি ছোট পেটানো লোহার কড়াই, দুটি খুন্তি, দুটি ঝাঁঝরি, দুটি সাঁড়াশী রেখেছি।... যে-সব বাসন না রাখলেই নয়, সে হল একটি মাঝারি মাপের কেৎলি, নানান মাপের চারটি ডেকচি, দুটি কড়াই, দুটি ফ্রাই প্যান...।” মা-ঠাকুমাদের মতোই যেন কাছে বসে তিনি বলছেন, খাওয়ার বাসনের মধ্যে কাঁসা-পিতল বাদ দেওয়ার কথা, কারণ পরিষ্কার রাখার ঝামেলা, আর চোরের ভয়। চিনেমাটি, কাচ, পাথর, স্টেনলেস স্টিলের বাসন ব্যবহারের সুবিধের কথা বলেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ উপন্যাসে নগেন্দ্রের সঙ্গে কুন্দনন্দিনীর প্রথম সাক্ষাতের দৃশ্য মনে করুন। ঝড়-বৃষ্টির রাত, নগেন্দ্র গৃহের মধ্যে প্রবেশ করলেন। “দেখিলেন, কক্ষমধ্যে মনুষ্য-জীবনোপযোগী দুই একটা সামগ্রী আছে মাত্র, কিন্তু সে সকল সামগ্রী দারিদ্রব্যঞ্জক। দুই একটা হাঁড়ি- একটা ভাঙ্গা উনান- তিন চারিখান তৈজস- ইহাই গৃহালঙ্কার।” সদ্য পিতৃহারা কুন্দকে তিনি ফেলে যেতে পারলেন না। হল বিষবৃক্ষের সূচনা।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসে রোহিণীর মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব খুব সুন্দর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে কলসির সঙ্গে কথোপকথনে। যেন দুই সখী কথা বলছে। যোগ্য সঙ্গতে জল আর বালা।
“রোহিণীর মন বলিল— উইল চুরি করা কাজটা!
জল বলিল— ছলাৎ!
রোহিণীর মন— কাজটা ভাল হয় নাই।
বালা বলিল— ঠিন্ ঠিনা— না! তা ত না—
রোহিণীর মন— এখন উপায়?
কলসী— ঠনক্ ঢনক্ ঢন্— উপায় আমি,— দড়ি সহযোগে।”
সিক্তা দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান
নৈতিক দায়িত্ব
‘পরিচ্ছন্নতার পাঠে ব্যতিক্রমী জাপান’ (২৭-১১) মনে করিয়ে দিল আমার স্কুলবেলার কথা। গাঁয়ের যে স্কুলে আমি পড়াশোনা করেছি, সেটা ছিল মাটির বাড়ি, খড় ও টালির ছাউনি। প্রতিটি ক্লাসে ছিল দু’জন মনিটর, যারা নিজেদের শ্রেণি ও তার সামনেটা অন্য সহপাঠীদের সাহায্যে প্রতি দিন পরিষ্কার রাখত। সপ্তাহে এক দিন শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী মিলে স্কুল চত্বর পরিষ্কার করা হত। প্রতি মাসের একটি রবিবার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বরাদ্দ ছিল নিজ নিজ শ্রেণিকক্ষ গোবর, মাটি, জল দিয়ে পরিষ্কার করা। স্কুলে ছেলেমেয়েদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে অভিভাবকরাও উৎসাহিত করতেন। বিশেষ দিনে শিক্ষকদের নেতৃত্বে ছাত্রছাত্রীদের গ্রামের রাস্তাঘাট পরিষ্কার ছিল অন্যতম কাজ। তখন মাটির ছোট রাস্তা। কাঁটা গাছের বেড়া রাস্তার উপরে চলে আসত। সেই কাঁটা গাছ কেটে বেড়া সরিয়ে রাস্তা বড় করা হত। বর্ষায় যে সব জায়গায় জল জমত, সেখানে মাটি ফেলতে হত।
জাপান পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা দেয় শৈশব থেকে। এটাকে তাঁরা নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করেন। তাই এ সব নিয়ে তাঁরা প্রচারবিমুখ। এই বিশ্বকাপ থেকে জাপানের পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা নিয়ে যদি আমরা ভারতবাসীরা সচেতন হতে পারি, তবে নিজেদের দেশটাকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর