সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় অথবা ভিতরের পাতায় নানান ধরনের রুচিসম্পন্ন কার্টুন থাকত। ফাইল ছবি।
একটা সময় ছিল, যখন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় অথবা ভিতরের পাতায় নানান ধরনের রুচিসম্পন্ন কার্টুন থাকত। বিশেষ করে সমকালীন রাজনীতিবিদ, চিত্রাভিনেতা, খেলোয়াড় বা অন্য কোনও ক্ষেত্রে মান্যগণ্যদের নিয়ে। উল্লেখযোগ্য, এই সব মজাদার কার্টুন নিয়ে সেই সব মান্যগণ্য ব্যক্তির কেউ কোনও দিন আইনজ্ঞের পরামর্শ নেননি, বা শিল্পীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আদালতের দোরগোড়ায়ও পৌঁছননি। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কার্টুনের প্রতি ভালবাসার কথা অনেক শোনা যায়। সংবাদপত্রে কোনও দিন তাঁকে নিয়ে কার্টুন না থাকলে নেহরু নাকি চিন্তায় পড়ে যেতেন। আশঙ্কা করতেন, তবে কি তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে শুরু করেছে? তাঁকে নিয়ে কুট্টি বা অন্যরা যে সব কার্টুন আঁকতেন, নেহরু তা খুব উপভোগ করতেন।
সেই ভাবেই বঙ্গের সংবাদপত্রে শৈল চক্রবর্তী, রেবতীভূষণ, চণ্ডী লাহিড়ীরা ছিলেন যথেষ্ট পরিচিত নাম। বর্তমানে সংবাদপত্রে বেশ কিছু শিল্পীর আঁকা ছবি দেখি আর ভাবি, তাঁরা কি পারেন না এই ধারাটিকে বজায় রাখতে? নতুন করে নিয়মকানুন মেনে কার্টুন শিল্পকে নতুন ধারায় প্রবর্তন করতে? অবশ্যই সম্মাননীয়দের কথা মাথায় রাখতে হবে, যাঁরা কথায় কথায় আইন দেখান— যার দৃষ্টান্ত অম্বিকেশ মহাপাত্রের কার্টুনকাণ্ডের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি। প্রতি দিনের সংবাদপত্রে আমরা যাতে নিয়মিত ভাবে কার্টুন দেখতে পাই, তার ব্যবস্থা করা কি যায় না? আশা করি, বিষয়টি সকলে ভেবে দেখবেন।
সুব্রত সেনগুপ্ত, কলকাতা-১০৪
জ্যান্ত কার্টুন
কলকাতার কড়চায় ‘কার্টুনে বঙ্গ’ (১১-২) প্রতিবেদন থেকে জানতে পারছি কিঞ্জল পত্রিকা বাংলা কার্টুনের ১৫০ বছরের শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসাবে প্রকাশ করেছে ‘কার্টুন সংখ্যা’। পত্রিকার সম্পাদক চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ। রাজনৈতিক কার্টুনের রসরঙ্গ অত্যন্ত উচ্চধারার এক শিল্প। আজ তার মৃতপ্রায় অবস্থা। অত্যন্ত কঠিন এই ব্যঙ্গচিত্রের অঙ্কনশৈলী। হাতের অনবদ্য দক্ষতায় কয়েকটি আঁচড়ে অবয়ব এঁকে ফেলা এর বৈশিষ্ট্য। এত উঁচু দরের শিল্প কেবল চেষ্টায় হয় না।
সম্ভবত আশির দশকে আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত কুট্টির আঁকা একটি ছবি সাড়া ফেলে দিয়েছিল। নেতাজির উপর বিবিসি’র তৈরি একটি তথ্যচিত্রে নীরদ সি চৌধুরী নেতাজি সম্বন্ধে কিছু তথ্য দিয়েছিলেন, যা সমালোচিত হয়। কুট্টি আঁকলেন বিশাল নেতাজির হাতের তালুতে ছোট্ট নীরদ, আর একটি দুই শব্দের বাক্য, “কে নীরোদ”? পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞান, প্রখর মেধা আর রসবোধ না থাকলে এই ছবি দেখে প্রাণখোলা হাসি আসে না।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, রাজনৈতিক কার্টুন শিল্পী হিসেবে আর কে লক্ষ্মণ, শঙ্কর বা কুট্টি এক অসামান্য উচ্চতায় নিজেদের নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে তুলনীয় রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট সারা দেশেই বিরল। তবে প্রাধান্যটা সব সময়ে বড় কথা নয়। বাংলায় যাঁরা ছিলেন, এবং সুনামের সঙ্গেই ছিলেন, তাঁদের স্মরণ করাটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যেই পড়ে। তাই এমন একটি বিষয় নিয়ে পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
ভারতে ব্যঙ্গচিত্রের জনক গগনেন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর তিনটি ব্যঙ্গচিত্র-সম্বলিত অ্যালবাম প্রকাশিত হয়— ‘নবহুল্লোড়’ (থ্যাকার স্পিঙ্ক অ্যান্ড কোম্পানি, ১৯২১) ‘অদ্ভুত লোক’ ( ক্যালকাটা, বিচিত্র প্রেস, ১৯১৭) আর ‘বিরূপ বজ্র’ (প্রিয়নাথ দাশগুপ্ত, ১৯৩০)। রবীন্দ্রনাথের আঁকা মুসোলিনির ক্যারিকেচার-ধর্মী ছবিটি নিয়েও তখন কম আলোচনা হয়নি। পরবর্তী কালে চঞ্চল বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন সেন, চারু রায়, বিনয় বসু, বনবিহারী আর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ছিলেন নামী ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী। তবে এঁরা কেউই রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন না।
গগনেন্দ্রনাথের পর ইতিহাসের অধ্যাপক, বেহালাবাদক প্রফুল্ল চন্দ্র লাহিড়ী, যিনি ‘কাফী খাঁ’ ছদ্মনামে অধিক পরিচিত, ছিলেন আধুনিক ব্যঙ্গচিত্রের প্রবর্তক। বাংলায় কমিক স্ট্রিপের জনক। তাঁর হাত ধরেই এই বাংলায় রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্রের সূচনা হয়। রাজনৈতিক কার্টুন আঁকার ক্ষেত্রে সারা দেশে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এই ‘পিসিএল’। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে তৎকালীন পরিস্থিতির বিশ্লেষণে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। প্রমথ সমাদ্দার ছিলেন সে কালের নামী ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী। শৈল চক্রবর্তীর হাতে স্ট্রিপ কার্টুন জনপ্রিয়তা পায়। যদিও ইলাস্ট্রেটর হিসেবেই তাঁর পরিচিতি বেশি— নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পের বিভিন্ন চরিত্র চিত্রায়ণ তাঁর হাতে খ্যাতি লাভ করে।
এ বার আসি ভারতের প্রথম অ্যানিমেশন ছবি মিচকে-পটাশ’এর চরিত্রাঙ্কন শিল্পী রেবতীভূষণ ঘোষের কথায়। জন্মস্থান বালি থেকে সাইকেল চালিয়ে বরাহনগরে অবনীন্দ্রনাথের কাছে অঙ্কনশৈলীর পাঠ নিতে যেতেন। ১৯৪৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত হয় তার আঁকা ব্যঙ্গ প্রতিকৃতি ‘ল্যাংচা মিত্র’। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদাকে কমিক রূপ দেওয়ার পথিকৃৎ রেবতীভূষণ। ১৯৬৫-তে শঙ্করের ডাকে তাঁর প্রকাশিত শঙ্কর্স উইকলি-তে কাজ করার জন্য দিল্লি চলে যান। ভারতবিখ্যাত এই কার্টুনিস্ট বিভিন্ন সংবাদপত্রে সুনামের সঙ্গে রাজনৈতিক কার্টুন এঁকেছেন।
এর পরেই নাম করতে হয় চণ্ডী লাহিড়ীর। সামাজিক ও রাজনৈতিক দু’টি বিষয়েই দক্ষ হাতে ছবি এঁকে গিয়েছেন। অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন সাহিত্যরসে। চমৎকার সব ডায়ালগ থাকত ছবিতে। অহিভূষণ মালিক, সুফী অর্থাৎ নরেন রায়, অমল চক্রবর্তী— সুনামের সঙ্গে কার্টুন করে গিয়েছেন। ব্যতিক্রমী শিল্পী নারায়ণ দেবনাথের নাম না করলে অন্যায় হবে। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট কার্টুন স্ট্রিপ এঁকে আমাদের আনন্দ দিয়েছেন। অমল চক্রবর্তীর পর সফলতম ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী হিসেবে যাঁদের নাম করতে হয়, তাঁরা হলেন দেবাশীষ দেব এবং অনুপ রায়।
তবে রাজনীতিবিদদের নিয়ে ব্যঙ্গচিত্রের বড় অভাব। ইদানীং উচ্চমেধা এবং সৎ নেতাদের অভাব চোখে পড়ার মতো। স্বভাবতই তাঁরা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতা ও জনপ্রিয়তা হ্রাসের ভয়ে ভোগেন। তাই তাঁদের নিয়ে ব্যঙ্গচিত্রের প্রয়োগে তাঁরা ঘোর বিরোধী। প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট কে শঙ্কর পিল্লাই জওহরলাল নেহরুকে নিয়ে নির্দয় ভাবে ব্যঙ্গচিত্র আঁকতেন। নেহরু কিন্তু তাঁকে সব সময়ে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন, এবং সর্বসমক্ষে বলেছিলেন, শঙ্কর যেন তাঁকে কোনও ভাবে রেয়াত না করেন। বাংলায় কার্টুনের ইতিহাস নিয়েও বেশ কিছু ভাল কাজ হচ্ছে। দুঃখের কথা, এই প্রজন্মের কার্টুন শিল্পীদের কাছে প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজের পরিসর ছোট হয়ে আসছে।
রাষ্ট্রশক্তির হাত বড় লম্বা। ক্ষমতাসীনদের অন্যায় কর্মকাণ্ড বা আচরণের প্রতিবাদ করলেই এখন থানা-পুলিশ, বা জেলে ঢোকার ভয়। রসিকতা করলেও বিপদ। সুফীর মতো নামজাদা কার্টুনিস্টেরও রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র আঁকার জন্য চাকরি গিয়েছিল। ক্ষমতার অপব্যবহার করতে নেতাদের কোনও লজ্জা নেই। বর্তমানে অধিকাংশ রাজনীতিবিদ রসবোধের মানকে অত্যন্ত নিম্নমানের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। টিভি চ্যানেলে বসে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের কাজ হল, একে অপর দলের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি। কথ্য ভাষা এবং শরীরী ভাষা অত্যন্ত শ্রুতিকটু এবং দৃষ্টিকটু। সেটাই এখন দর্শক রসিকতা হিসাবে উপভোগ করেন। কার্টুনের জায়গায় এখন তাঁরা নিজেরাই এক-এক জন জীবন্ত ব্যঙ্গচরিত্র।
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৫৭