—ফাইল চিত্র ।
দেবাশিস ভট্টাচার্যের ‘শিশুরা যে শিক্ষা পেয়েছে’ (৪-৪) শীর্ষক প্রবন্ধসূত্রে কিছু সংযোজন। অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের অবতারণার সুযোগ করে দিয়েছে লাভপুরের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, বড় হয়ে ‘বোকা’ হতে চাওয়া রিক বাগদি (ছবি)। সত্যি বলতে, ছোট বয়সে আমরা সকলেই কম-বেশি রিকের মতোই সহজ সরল থাকি। কিন্তু অবক্ষয়ের মুখে পড়া এ-সমাজে কার্যত আমাদের ‘বোকা’ বা সৎ হয়ে বেঁচে থাকা হয় না। আমরা ‘চালাক’ হয়ে যাই, সে ক্ষেত্রে নিজের ‘সততা’টুকুও বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
অভিযোগ উঠেছে, ভোট মানে তো নাগরিক বা ভোটদাতারা আবার ঠকবেন। ভোট-পরবর্তী দিন-মাস-বছরগুলো বোকা হয়েই কাটিয়ে দিতে বাধ্য হবেন। পরবর্তী কালে কোনও না কোনও ভোট আবার আসবে। আশ্চর্যজনক ভাবে, ভোটদাতা একই ভাবে বঞ্চনার শিকার হবেন। কেন এমনটা হয়! এর উত্তর নিহিত থাকে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার উপর। আশ্চর্য, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে আমরা শূন্যগর্ভ আস্ফালন করি, বাস্তবে এ দেশ বা রাজ্যে তার যথাযথ প্রতিফলন কতটুকু ঘটে, সেই প্রশ্নের সহজ উত্তরটাও মেলা সত্যিই কঠিন হয়ে ওঠে।
তা হলে নাগরিকরা জেনেশুনে ঠকছেন কেন? কেন তাঁরা প্রতিবাদে শামিল হয়ে তথাকথিত এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শুদ্ধিকরণ ঘটাতে চান না? এর উত্তরও জলের মতোই পরিষ্কার। আমাদের অজানা নয় যে, কোনও রাষ্ট্রের ক্ষমতার অধীনে আমরা প্রায় সকলেই। আক্ষরিক অর্থে আমরা ‘স্বাধীন’, কিন্তু কোথায় আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা? কোথায়-ই বা রাজনৈতিক ও বাক্স্বাধীনতা? সবই শাসকের ক্ষমতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জনগণ যেটুকু ‘স্বাধীনতা’ পায়— তাতেই তারা গর্বিত হয়। মারামারি খুনোখুনি করে। এ ভাবেই চলছে এই মহান ভারতবর্ষ।
অপ্রিয় সত্য হল, এ দেশে সততার মূল্যের বড় অভাব। এখানে অনেক কর্মক্ষেত্রেই নিজের সততা দেখাতে গিয়ে কত ভাবে যে বিড়ম্বনা ও গুরুতর সমস্যার মুখে পড়তে হয়, এমন অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে পারেন ভুক্তভোগীরাই। সরকারি দফতরে এমন কিছু কিছু বিভাগ রয়েছে যেখানে উৎকোচ এড়িয়ে চলা তথা প্রতিবাদে শামিল হওয়ার অর্থ অকালে নিজের প্রাণটুকু সমর্পণ করে বসার শামিল। তাই যখন কেউ আক্ষেপ করে বলি, রাজনীতিতে সৎ ও মেধাবী যুবক-যুবতীরা আসছে না কেন— তার উত্তরও হয়তো এই মুহূর্তে এ ভাবেই দেওয়া যায় যে, প্রশ্নহীন আনুগত্য নিয়ে চলতে পারার শক্তি আছে ক’জনের? রাজনৈতিক দলে যুক্ত হলে, সেই মেধার অপমৃত্যু কার্যত নিশ্চিত! আর সে-কারণেই রাজনীতিকদের প্রতি ভোটদাতারা মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা নিরঙ্কুশ ঘৃণা নিয়েই গণতন্ত্রের এই ‘মহাযজ্ঞ’-এ ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হন।
শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া
সৎ ও বোকা
‘শিশুরা যে শিক্ষা পেয়েছে’ শীর্ষক প্রবন্ধে প্রবন্ধকার প্রাঞ্জল ভাষায় রিক বাগদির সরল বাক্যের দ্বারা সমাজের বর্তমান প্রেক্ষাপট যে ভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। সেখানে তিনি ঘুণ ধরা সমাজের রাজনীতির সমীকরণ, অর্থনৈতিক ভাবে ঠকে যাওয়া মানুষের বাস্তব ছবি তুলে ধরেছেন। এ ক্ষেত্রে বালকটি তার সরল মনে সমাজের দর্পণস্বরূপ যে কথাটি বলেছে, একটু ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, জীবনের কর্মফলের জটিল প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত সে দিয়েছে তার অজানতেই।
জীবনের সার হিসাবে গীতায় শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধবিমুখ অর্জুনকে কর্মফলের কথা না ভেবে, নিষ্কাম মনে কর্ম করে যাওয়ার শিক্ষা দিয়েছিলেন। তবে নিরাসক্ত মনে মানুষের হয়ে কাজ করাকে আজকের সমাজ ‘বোকা’ বলেই দাগিয়ে দেয়। কারণ এখানে চালাকির দ্বারা চালিত কর্মকেই আসল কর্ম বলে মনে করা হয়। যে কর্মে থাকে চাওয়া-পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, ঠকিয়ে নেওয়া, সর্বোপরি স্বার্থপরতা। রিক তার বাবার কাছে শুনেছে যে, বোকা পেয়ে সবাই তার বাবাকে ঠকিয়ে নিচ্ছে। তার অকপট স্বীকারোক্তি, ‘সে কাউকে ঠকাতে চায় না’, যা কথাতেই শুধু বড় নয়, বাক্যটির মর্মার্থও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বোকা হওয়ার কথাটিই আসলে তার সৎ হওয়ার পরিচয় বহন করে। তাই বলা যায়, ‘সৎ’ এবং ‘বোকা’ এ ক্ষেত্রে ‘নিষ্কাম’ কর্মেরই সমার্থক। আর রিকের সরল মন নিষ্কাম কর্মের প্রতীক।
সৈকত বিশ্বাস, বোলপুর, বীরভূম
এতটুকু আশা
দেবাশিস ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই পত্রের অবতারণা। আজকাল নেতাদের অযোগ্যতা, মিথ্যাচার, হিংসা-প্রতিহিংসার অসহনীয় রূপ, আগলহীন কু-কথা ইত্যাদি বিষয়ে যত লেখালিখি হচ্ছে, ততই দেখছি তাঁরা দুঃসাহসী হয়ে উঠছেন ক্রমশ। অর্থাৎ, ‘বোকা’ বানিয়ে রাখার কাজ থেকে তাঁরা বিরত হবেন না। রিক বাগদি তার জীবনের শুরুতেই বর্তমান সমাজের কঙ্কালসার চেহারাটি দেখে ফেলেছে। শিশুমনে রিক হয়তো এও বুঝতে পেরেছে যে, ‘সচেতন’ মানুষগুলিকেও চতুর রাজনীতিকরা ছলে-বলে-কৌশলে কী ভাবে বোকা বানিয়ে চলেছেন। নীতিশিক্ষা পাঠের সেই শিয়াল আর ছাগলের গল্পের মতো। একটি ধূর্ত শিয়াল কূপের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। অতঃপর সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার আশায় সে বলিস্বরূপ এক ছাগলকে বেছে নিয়েছিল। কূপে মিষ্টি জল আছে, এমন প্রলোভন দেখিয়ে চতুর শিয়াল সরল ছাগলকে কূপের মধ্যে নামিয়ে, শেষে তারই কাঁধে চড়ে কূপের বাইরে বেরিয়ে এসেছিল।
আমরা সরল বিশ্বাসী ‘বোকা’র দল প্রতিশ্রুতির ‘মিষ্টি’ গ্যারান্টির ফাঁদে পড়ে ক্রমে দেশ এবং দশের ক্ষতি করে চলেছি। শিল্প নেই, চাকরি নেই, শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির কলুষতা, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুরবস্থা, দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষের নাভিশ্বাস! ক’জনের ভ্রুক্ষেপ আছে তাতে? ধর্মান্ধতা এবং কুসংস্কার আবার যেন দেশটাকে গ্রাস করতে বসেছে। দুর্নীতিগ্রস্ত, ভোগবিলাসী, স্বেচ্ছাচারী হয়েও কী ভাবে আশ্বাসের কল্পকথা শুনিয়ে নেতারা বুক ঠুকে জয়ী হওয়ার জয়গান গেয়ে চলেছেন! জনগণের করের টাকা অকাতরে খরচ করে আত্মপ্রচারের মিথ্যে ঢাক পিটিয়ে চলেছেন। মিথ্যা ভাষণ আর অন্যের মুন্ডুপাত করে নিজেকে ভাল মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার লজ্জাহীন প্রয়াস। রিক হালের নেতাদের মতো এমন অসাধু কিংবা অসৎ হতে চায় না। তার কচি মনে ভেসে ওঠা স্বপ্ন আমাদেরও আশার আলো দেখায়! ‘বোকা’ বা ‘সৎ’ মানুষ হয়ে এমন ছেলেমেয়েরা এক দিন দেশের হাল ধরবে— এই আশা নিয়ে আমরা আজও বেঁচে আছি।
বাবুলাল দাস, ইছাপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
‘শিশু’র মতো
পশ্চিমবঙ্গে ক্লাস থ্রি, মানে সাত-আট বছরের একটি ছেলে নিতান্তই সরল। সততা-অসততা, ঠকানো বা ঠকে যাওয়া, পাপ-পুণ্য, অতিচালাকি, অতিবোকামি— এই সমস্ত জটিল শব্দবন্ধের কয়েকটা সে কানে শুনলেও শব্দগুলোর সম্যক অর্থ উপলব্ধি করার মতো বুদ্ধিমত্তা এবং বয়স থেকে সে এখনও অনেকটাই দূরে। সে শুধু ঠকে যাওয়া তার বাবার কষ্টটা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছে এবং সঙ্গে সে নিজেও তার বাবার প্রতি সমানুভূতিসম্পন্ন হয়ে কষ্ট পেয়েছে।
আমরা সকলেই প্রায় জানি যে, শিশুর প্রকৃত বন্ধু হতে গেলে বা তার মনের খবর পেতে গেলে যেমন তার সঙ্গে শিশুর মতো মিশতে পারা চাই, ঠিক তেমনই শিশুর বলা কথা বা তার কোনও কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করতে গেলেও শিশুসুলভ মন নিয়েই তা করা উচিত। আর ঠিক এইখানেই প্রবন্ধকার একটি বড় ভুল করে বসেছেন। ক্লাস থ্রি-র একটি সরল সাদাসিধে গ্রাম্য শিশুর কথাকে তিনি বিচার করেছেন তাঁর উচ্চশিক্ষিত মেধা এবং সুদীর্ঘ বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে। সেই নিষ্পাপ শিশুর মুখনিঃসৃত কথাগুলিকে তিনি বর্তমান সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার মাপকাঠিতে মেপে পরিবেশন করেছেন, যে মাপকাঠিগুলির কোনওটির সম্বন্ধেই বিন্দুবিসর্গ ধারণা নেই তার। প্রশ্ন হল— শিশুর সারল্যকে আমাদের অর্জিত বৈদগ্ধ ও অভিজ্ঞতা দ্বারা বিচার করা কতটা যুক্তিযুক্ত? সব কিছুকে একই ছাঁচে ঢেলে পরিবেশনের সহজ পথ পরিহার করে শিশুকে বরং শিশুর মতো করে বুঝতে চেষ্টা করি।
প্রণব কুমার সরকার, বোলপুর, বীরভূম