প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বাঙালি সেনাদের নিয়ে বিকাশ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘রাত দুটোয় ঘুম ভাঙতেই আরম্ভ গোলাবর্ষণ’ (রবিবাসরীয়, ১৬-২) শীর্ষক নিবন্ধে বাঙালির রণনৈপুণ্যের যে অপূর্ব বর্ণনা আছে, সেখানে লক্ষণীয়, দৈহিক দক্ষতার সঙ্গে শিক্ষাগত মেধার এক সমন্বয় ঘটেছে। আর এখানেই বাঙালির বৈশিষ্ট্য, যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবীদের মধ্যেও প্রমাণিত।
লেখক উল্লেখ করেছেন, ‘বাঙালিরা যুদ্ধ করবে’ এই সম্ভাবনা ছিল না। প্রশ্নটা অন্যখানে। কার বিরুদ্ধে কেন যুদ্ধ করবে বাঙালি? ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ তথা ভারতভঙ্গ প্রতিরোধী বাঙালির চিন্তনে-মননে ছিল দেশপ্রেমের অনন্য উত্তরাধিকার। চন্দননগরেই ১৯০৭ সালে ফ্রেজারের রেলগাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস হয়েছিল। ১৯০৮ সালে ফরাসি মেয়র তার্দিভালের ঘরে, চন্দননগরে তৈরি বোমা ফেলার কেন্দ্রে ছিলেন চারুচন্দ্র রায়, ভোলানাথ দাস, বনমালী পাল, সুরেন্দ্রনাথ পাল, মতিলাল রায়, শ্রীশচন্দ্র ঘোষ, বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। এও তো যুদ্ধ, অবশ্য অঘোষিত ও অন্য কায়দায়। ১৯০৮ সালে কানাইলাল দত্ত ‘পলিটিকাল মার্ডার’ করে ফাঁসির দড়ি বরণ করলেন, তিনিও ভারতের স্বাধীনতা-যুদ্ধের তকমা-বিহীন অকুতোভয় বিপ্লবী সৈনিক।
লেখক শাসকভক্তির উল্লেখ করেছেন। ঠিক কথা। মনে হতে পারে, এ তো এক বালতি দুধে গো-চোনার নামান্তর। কিন্তু পরাধীন দেশে উপনিবেশবাদের চরিত্র বিবেচনা করলে, এই বাঙালির সেনানৈপুণ্য বিন্দুমাত্র কলঙ্কিত হয় না। রাজনীতির পরিবর্তনে দেশপ্রেম বদলায়। বিংশ শতকের প্রথম থেকেই ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব, ইউরোপে পুঁজিবাদের সঙ্কট তীব্র হয়। দেশকালের আঙ্গিক ও চরিত্র বদলের পরিণতিতে শুরু হয় প্রথম মহাযুদ্ধ। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রতিটি দেশ দেশের জনগণের সমর্থন লাভের চেষ্টা করে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে তৈরি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের পল্টনে হাবিলদার নজরুল ইসলাম ১৯১৭-১৯২০ সাল যুদ্ধ করেছেন ব্রিটিশের সেনা হিসেবে। ১৯১৬ সালে ফ্রান্সে হয়েছিল ব্যাটল অব ভার্দুন। ফ্রান্স ১৯১৫ সাল থেকে এশিয়া থেকে সৈন্য সংগ্রহ করেছিল।
ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে কিন্তু অন্য এক চিত্রও ছিল। সেখানে ১৯১০ সালে এক জাহাজে কলকাতার আউটরাম ঘাট থেকে সচ্ছল কায়স্থ পরিবারের পুত্র যোগীন্দ্রনাথ সেন ইংল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন, যুদ্ধের জন্য নয়, উচ্চশিক্ষার জন্য। ঘটনাচক্রে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
১৯১৫ সালে চির কালের জন্য মাতৃভূমি চন্দননগর তথা ভারত ছেড়ে রাসবিহারী বসু জাপানের উদ্দেশে রওনা দিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের উদ্দেশ্যে। গড়ে তুললেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি, যা তুলে দিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্রের হাতে।
লেখক উল্লেখ করেছেন আকর্ষক পাওনাগন্ডার কথা, রাজা নবাবদের উৎসাহের কথা। পাশাপাশি ঝুঁকি-দুঃখের কথাও উল্লেখ করা দরকার। পড়ুয়া মেধাবী যোগীন্দ্রনাথ সৈনিক হবেন শুনে, চন্দননগরে বাবা-মা আকুল। দাদা যতীন্দ্রনাথের মাধ্যমে যোগীন্দ্রনাথ মা’কে চিঠিতে লিখলেন, ‘‘আপনারা আমাকে মার্জনা করিবেন, আমি বাঙালীর গালে চুনকালি দিতে পারিব না।’’
ভেতো বাঙালি যুদ্ধে সাধারণত স্বেচ্ছায় যেতেন না। কিন্তু মহাযুদ্ধ বা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য ভয় পাননি চন্দননগরের হিন্দু বাঙালি ফরাসি প্রজা। ১৯১৬ সালে ১৬ এপ্রিল ফ্রান্সের রণক্ষেত্রে যান ২০ জন— ফণীন্দ্রনাথ বসু, তারাপদ গুপ্ত, রমাপ্রসাদ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ সরকার, বিপিনবিহারী ঘোষ, হারাধন বক্সী, সিদ্ধেশ্বর মল্লিক (ঘোষাল), করুণাময় মুখোপাধ্যায়, জ্যোতিষচন্দ্র সিংহ, অমিতাভ ঘোষ, বলাইচন্দ্র নাথ, মনোরঞ্জন দাস, রাধাকিশোর সিংহ, সন্তোষচন্দ্র সরকার, রবীন্দ্রনাথ রায়, অনিলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আশুতোষ ঘোষ, পাঁচকড়ি দাস, ব্রহ্মমোহন দত্ত, হাবুলচন্দ্র দাস। দ্বিতীয় দলে আট জন— যতীন্দ্রনাথ দে, সতীশচন্দ্র শেঠ, অজয়প্রসাদ বসু, কানাইলাল ভট্টাচার্য, অনিলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ললিতমোহন দে, পরেশনাথ চট্টোপাধ্যায়, গোবর্ধনচন্দ্র দাস। কানাইলাল বিদ্যামন্দির শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থে উল্লিখিত আরও দু’টি নাম: সিদ্ধেশ্বর সরকার ও পাঁচুগোপাল ঘোষ । (সূত্র: সংক্ষিপ্ত চন্দননগর পরিচয়, হরিহর শেঠ, পৃ ১৩১-১৩২)।
এই স্বেচ্ছাসেবক-বাহিনী গঠনে উৎসাহ দিয়েছিলেন রাজা বা নবাব নন, চন্দননগরের সচেতন মানুষ মতিলাল বসু, তিনকড়ি বসু, হরিহর শেঠ, মণীন্দ্রনাথ নায়েক, সৈনিক সিদ্ধেশ্বর মল্লিক, জ্যোতিষচন্দ্র সিংহ, হারাধন বক্সী প্রমুখ।
সন্দীপ দাশগুপ্ত (‘যুদ্ধে গেলেন বাঙালিবাবু’, আনন্দবাজার পত্রিকা, রবিবাসরীয়, ৩-৩-২০০২) প্রশ্ন রেখেছিলেন, কে বলে বাঙালি পুরুষ ঘরকুনো? ভেতো? সিংহের বিক্রম তার। লিখেছিলেন ছেলেধরার মতো কলকাতায় ‘সেনাধরা’ ডা. শরৎকুমার মল্লিকের কথা। সেই সেনা নজরুল ইসলাম কিন্তু যুদ্ধ শেষে অসির বদলে মসি ধরলেন। সিদ্ধেশ্বর মল্লিক সমাজতান্ত্রিক পথে প্রথমে পেজ়্যান্ট অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টি, পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯০৫-১৯৪৭ পর্বে বাঙালি স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধরেছে। স্বাধীনতার পর সংশোধনের জন্য ১৯৭০-এর দশকে নকশাল আন্দোলনে অস্ত্র ধরেছে। আবার সরাসরি যুদ্ধেও গিয়েছে।
শুভ্রাংশু কুমার রায়
ফটকগোড়া, হুগলি
বাঙালি যুদ্ধভীরু?
‘রাত দুটোয় ঘুম ভাঙতেই আরম্ভ গোলাবর্ষণ’ (রবিবাসরীয়, ১৬-২) পড়ে এই চিঠি। ‘বাঙালি যুদ্ধভীরু’— অপবাদটি খুবই প্রচলিত। কিন্তু ব্যতিক্রমী ঘটনাও অনেক আছে, ইতিহাস যা মনে রাখেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই বাঙালি যুবকদের একাংশের মধ্যে যুদ্ধবিদ্যা শেখার আগ্রহ দেখা যায়। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় (১৮৭৭), ১৮৮৭ সালে সুরেশ বিশ্বাস এবং ১৮৯৭ সালে যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সেনাদলে যোগ দেন। এমনকি ছাত্রাবস্থায় রাসবিহারী বসুও বাড়ি থেকে পালিয়ে সেনায় নাম লেখাতে পশ্চিম ভারতে চলে যান বলে তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই বিজনবিহারী জানিয়েছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদানকারী দুই যুবক— চট্টগ্রামের নগেন (জুলু) সেন ও কুমিল্লার যশোদারঞ্জন পাল ফিরে এসে সশস্ত্র বিপ্লবে অংশ নেন। এই নগেন সেন ১৯২৩-২৪ সালে কাশীর শচীন সান্যালের সঙ্গে মিলিত ভাবে রেড বেঙ্গল পার্টি গঠন করেন। সূর্য সেনের সঙ্গে চট্টগ্রামে যুগান্তর দলের বিস্তারে সাহায্য করেন। প্রথম মহাযুদ্ধে চন্দননগরের যুবকদের ফরাসি সেনাদলে যোগদানের পিছনে মতিলাল রায়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। অরবিন্দ ঘোষ-সহ শতাধিক বিপ্লবীর ফরাসি চন্দননগরে প্রধান আশ্রয়দাতা ছিলেন মতিলাল রায়। যে রাসবিহারীর নেতৃত্বে ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত-জুড়ে সেনাবিদ্রোহ ঘটানোর চেষ্টা হয়েছিল, মতিলালের তাতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা ও মদত ছিল। সেই মতিলালকেই আবার দেখা যাচ্ছে, চন্দননগরের যুবকদের প্রথম মহাযুদ্ধে অংশ নিতে উৎসাহিত করছেন। এমনকি শ্রীঅরবিন্দও গোপনে পুদুচেরি থেকে মতিলালকে তেমনই নির্দেশ দিচ্ছেন।
মতিলালের এই উদ্যোগকে কখনওই নিছক ইংরেজ বা ফরাসি জাতির প্রতি বাঙালির আনুগত্যের প্রমাণ বলে মনে করা যায় না। মতিলাল যে কৌশল নিয়েছিলেন, যুদ্ধের পরিভাষায় তাকে বলে ক্যামুফ্লাজ। এই কৌশল নেওয়ার ফলে সাধারণ জনমানসে মতিলালকে হয়তো আর বিপ্লবী বলা চলে না। কিন্তু ইংরেজ সরকারের চোখে তিনি ছিলেন ঘোষিত বিপ্লবী ও সেই হেতু তাঁর ইংরেজ-শাসিত ভারতে
প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বাঙালি যুবকেরা যুদ্ধবিদ্যা আয়ত্ত করতে পারলে আখেরে তা সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে যে কাজে লাগবে— এই ভাবনা মতিলাল অরবিন্দ ও রাসবিহারীর ছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে হারাধন বক্সী মতিলাল প্রবর্তিত ‘প্রবর্তক’ পত্রিকায় আধুনিক যুদ্ধবিদ্যার কলাকৌশল নিয়ে দীর্ঘ দিন ধারাবাহিক ভাবে লিখেছেন।
শুভেন্দু মজুমদার
ধোপাপুকুর, হুগলি