সাম্প্রতিক বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ব্রিটেনে লাগাতার কর্মবিরতির ডাকও সামনে নিয়ে আসে সেই অসাম্য। ফাইল ছবি।
অলকা এম বসুর প্রবন্ধ ‘অসাম্যেও এক নম্বর?’ (১-২) সম্বন্ধে বলা যেতে পারে, এই অসাম্য শুধুমাত্র আমাদের দেশে নয়, এই প্রবণতা আজ বিশ্ব জুড়ে। অনেক উন্নত দেশের পরিসংখ্যানও এই বিষয়ে আমাদের লজ্জা দেবে। তবে এর জন্য আমাদের দেশের এই ‘অসাম্য’ নামক ব্যাধিকে কোনও ভাবেই খাটো করা যাবে না। কারণ, আগামী দিনে দেশের সমস্ত মানুষের জন্য এ এক ভয়ঙ্কর বিপদের ইঙ্গিত দেয়। সমীক্ষা আমাদের জানান দেয়, অতিধনী ব্যক্তি বা ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি সম্পদের মালিকের সংখ্যা আমাদের দেশে কী ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কখনওই আমরা জানতে পারি না, মাথাপিছু আয়ের নিরিখে গরিবের সংখ্যা কমা বা বাড়ার পরিমাণ। শুধু পারিপার্শ্বিক মানুষের কর্মহীনতা, উপার্জনের জন্য সন্তানকে স্কুল ছাড়িয়ে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করা, সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানের অবনতি হওয়া, এই সব দেখে আমরা বুঝতে পারি মানুষ আরও বিপন্ন হচ্ছে। সাম্প্রতিক বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ব্রিটেনে লাগাতার কর্মবিরতির ডাকও সামনে নিয়ে আসে সেই অসাম্য।
প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, এক জনের ক্ষতি হলে সচরাচর অন্য কারও লাভ হয়। সেটা কিন্তু সর্বক্ষেত্রে ঘটে না। যেমন, আদানিদের শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ায় ক্ষতি কিন্তু শুধু আদানিদের নয়, এই শেয়ারের সঙ্গে জড়িত সমস্ত বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগকারীরও। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, এলআইসি, এসবিআই, ব্যাঙ্ক অব বরোদা প্রভৃতি ক্ষেত্রের বিনিয়োগ সংক্রান্ত ব্যাপারে জড়িত সবাই। তবে সরকারি ভাবে দরিদ্রতম মানুষকে সাহায্য করলে কারও কিছু বলার থাকতে পারে না এবং এটা করারও প্রয়োজন আছে। কিন্তু রাজনৈতিক লাভের আশায় যখন সমাজের বৃহত্তর অংশকে এর আওতায় আনা হয়, তখন মানুষের নিজে থেকে উপার্জনের ইচ্ছেটাই কমে আসে এবং মানুষ পরোক্ষে নিজেকেই ঠেলে দেয় বিপন্নতার দিকে। সরকার যদি এই অর্থে বিভিন্ন ভাবে মানুষের স্ব-উপার্জনের ব্যবস্থা করে, তা হলে আগামী দিনে এই সামাজিক অসাম্য অনেকটাই দূর হবে, এই আশা করা যেতেই পারে।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
গণতন্ত্রের জোর
প্রভাবশালী নেতার প্রশ্রয়ে পুজো, এবং পুজোর মণ্ডপে তারস্বরে মাইক চালিয়ে রাতের ঘুমের দফারফা, এই অভিজ্ঞতা এখন পাড়ায় পাড়ায়। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এই ধরনের নানা স্বেচ্ছাচারিতায় অনেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটির উপরেই শ্রদ্ধা হারাচ্ছেন। তাই গণতন্ত্র নিয়ে নতুন করে চিন্তার প্রয়োজন হয়েছে। গণতন্ত্রের দুটো দিক। এক, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কে জিতল কে হারল, কত ভোটে জিতল, এ সবের চুলচেরা বিশ্লেষণ। অর্থাৎ, গণতন্ত্রের একটা সংখ্যাগত পরিমাপের প্রক্রিয়া, কেউ কেউ যার নাম দিয়েছেন ‘গণতন্ত্রের গণিত’। আর এই গণিতের বাইরেও গণতন্ত্রের আর একটা নৈতিক দিক রয়েছে, তা হল গণতন্ত্রের মূল্যবোধ— নিজের মতোই প্রতিটি মানুষও যে স্বতন্ত্র ও সমান, সেই বোধে উপনীত হওয়া। অর্থাৎ, আমাদের মধ্যে আপাত পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু সেই পার্থক্যকে অতিক্রম করলে আমরা সকলেই মানুষ, এক বৃহত্তর প্রাণমণ্ডলের অংশ, এবং তার ভিত্তিতে আমরা প্রত্যেকেই সমান। গণতন্ত্রের এই দুটো দিক একে অপরের পরিপূরক। অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটিকে তার মূল্যবোধের থেকে আলাদা করে প্রয়োগ করতে গেলে গণতন্ত্রেরই স্বাস্থ্যহানি ঘটে। এখন আমাদের রাজনীতিতে যেটা প্রধানত দেখতে পাচ্ছি, তা হল, মূল্যবোধহীন এক প্রক্রিয়াসর্বস্ব গণতন্ত্রের আস্ফালন। মধ্যরাত পেরিয়েও মাইকবাজিতে নেতার প্রশ্রয় থাকে, তাই তা চলতে পারে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নেই। থাকলে, নেতা দিনান্তে যে মানুষেরা ঘুমোতে চাইছেন, তাঁদের কথাও ভাবতেন।
মূল্যবোধহীন, প্রক্রিয়াসর্বস্ব গণতন্ত্র চলতে থাকলে গণতন্ত্র তার জোরের জায়গা হারাতে থাকে। এর একটা ফল যেমন সংখ্যাগুরুবাদ, আর একটি হল, গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই কর্তৃত্ববাদের বিকাশ। আজ বিশ্বের নানান জায়গায় গণতন্ত্রের মধ্যে কর্তৃত্ববাদের বিকাশ ঘটেছে। একটু খুঁজলে দেখা যাবে, এর অধিকাংশ জায়গাতেই এক ব্যাপক সামাজিক মেরুকরণের মধ্যে দিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা ক্ষমতায় এসেছেন। সামাজিক মেরুকরণ, অর্থাৎ সমাজের এক দল মনে করছে, অপর দলের স্বার্থ তাদের নিজেদের স্বার্থের সঙ্গে কোনও ভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তারা সমান নয়। অর্থাৎ, ঘুরেফিরে সেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। তৃতীয় আর একটা আশঙ্কাও রয়েছে। আজ এমন কিছু সঙ্কট তৈরি হয়েছে, যেগুলো তীব্র হলে সভ্যতাই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। যেমন, জলবায়ু সঙ্কট। এর মোকাবিলার জন্য যেমন দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে দক্ষতা তৈরি, তেমনই সমাজে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক সহযোগিতার বিস্তৃত নেটওয়ার্ক তৈরি করা।
কিন্তু আজকের গণিত-সর্বস্ব গণতন্ত্র শুধু ভাবে, আগামী নির্বাচনে কী ভাবে জেতা যায়। অবশ্যই এই ভাবনা জরুরি। এই ভাবনাটা আছে বলেই তো সরকার বিভিন্ন কল্যাণমূলক পদক্ষেপ করে। নইলে তো প্রান্তিক মানুষ বাঁচতেই পারবেন না। এই মানুষদের সংখ্যার জোর আছে, এবং ভোটের বাজারে রাজনৈতিক দলগুলোকে সেই নির্ণায়ক সংখ্যাটাকে সমঝে চলতে হয়। এই সংখ্যাটা ঐক্যবদ্ধ থাকলে তারা যখন কোনও একটি দলের দিকে ঝোঁকে তখন পুরো সংখ্যাটাই সেই দিকে ঝোঁকে। এই ভাবে এই গোষ্ঠীগুলো গণতন্ত্রকে সম্বল করে বেঁচে থাকে। কিন্তু ভোটের হিসাব কষতে গিয়ে সরকার অনেক সময়েই দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলোকে দূরে ঠেলার চেষ্টা করছে। ভাবছে, পরের কথা পরে ভাবা যাবে। কিন্তু ভাবা হচ্ছে না বলে তো আর সঙ্কট থেমে থাকছে না। ভয় হয়, পরে হয়তো আর সেই কথা ভাবার সময় মিলবে না।
সৌরভ চক্রবর্তী, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
শান্তির খোঁজ
নির্বাচনের ঢাকে এখনও কাঠি পড়েনি। তার আগেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতে এক ধরনের দাঙ্গাবাজ মানুষ হিংসাত্মক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছেন। পরস্পরকে দোষারোপ, বিদ্বেষ, ক্ষোভ, শত্রুতা, গ্রামীণ পরিবেশকে বিষময় করে তুলেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রান্তিক এলাকাগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য থাকায় ব্যক্তিগত আক্রোশ ক্রমশ সামাজিক আক্রোশের চেহারা নিচ্ছে। একই এলাকার বিভিন্ন বাসিন্দার মধ্যে অশান্তির প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে সমাজ জীবনে। সর্বত্র যেন এক অস্থিরতা, অরাজকতার পরিবেশ। এলাকা দখলের লড়াইতে নেমেছে এক শ্রেণির মানুষ।
আশ্চর্যের বিষয়, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচন হলেও দু’-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া প্রাণঘাতী পরিস্থিতি তৈরি হয় না। কিন্তু, পূর্ব পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্-নির্বাচন পর্ব থেকে নির্বাচন পরবর্তী কালে হিংসাত্মক ঘটনায় বহু মানুষের প্রাণ যায়। তাই রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে আবেদন— সুষ্ঠু, সুস্থ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশকে বজায় রাখতে, এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে, ক্ষুদ্র স্বার্থ বর্জন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখা দরকার। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রগতির পথে শামিল হতে হবে সবাইকে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন মতাদর্শগত সমাজসেবী, প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকদের মধ্যে সমন্বয় থাকা উচিত। সর্বোপরি, সহিষ্ণুতাই পারে অবাধ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে। প্রজাতন্ত্রের সার্থক রূপায়ণে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে সমাজের সকল স্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করুক।
রতন নস্কর, সরিষা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা