বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা আজ বিপর্যস্ত।
সুকান্ত চৌধুরীর ‘পাশ কাটিয়ে, চেপে গিয়ে’ (৮-৮) শীর্ষক প্রবন্ধটিতে লেখকের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হবেন কমবেশি সবাই। শিক্ষা জগতের সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক যাঁদের আছে, তাঁরা সকলেই জানেন বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা আজ বিপর্যস্ত।
সরকার-পোষিত স্কুল, কলেজে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি, ফলস্বরূপ অযোগ্য ব্যক্তির নিয়োগ, কিংবা প্রচুর সংখ্যক শিক্ষকপদ শূন্য রয়ে যাওয়ায় এক জন শিক্ষকের উপর বাড়তি চাপ পড়ছে। তাতে পড়াশোনার মান আরও নামছে। আরও বেশি করে টিউশনমুখী, নোটভিত্তিক, নম্বরসর্বস্ব হচ্ছে পড়াশোনা। অধিকাংশ শিক্ষক সঠিক ভাবে পড়াতে না পারলে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়াশোনাতে আরও দ্রুত আস্থা হারাবে।
আরও একটি বিষয় নজরে আনতে চাই, যা তথাকথিত আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে না। উচ্চমাধ্যমিকের পর সমস্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রীকে আজ এক রকম জোর করে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পথে। সমস্ত অভিভাবক মরিয়া যে কোনও ভাবে তাঁর সন্তানকে ডাক্তার কিংবা নিদেনপক্ষে নার্স করে তার ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে। যে সমস্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রী কোনও একটি বিষয়ের উপর পড়াশোনা করে বা করতে চায়, তাদের প্রায় অধিকাংশই প্রতিনিয়ত ‘ভবিষ্যৎ নেই’ বা ‘চাকরি নেই’ শুনতে শুনতে আগ্রহ হারাচ্ছে পড়াশোনায়। আর সত্যই মেধার যথার্থ বিচার এই রাজ্যে প্রায় অসম্ভব জেনে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাও বেছে নিচ্ছে কোনও বিকল্প রাস্তা। শিক্ষাজগৎ থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাবে যোগ্য ব্যক্তিত্বরা।
এ ভাবে চলতে থাকলে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে গুঁড়িয়ে শেষ হয়ে যাবে। কিচ্ছু করার থাকবে না। তাই সত্যি সময় এসেছে, এক বার যদি কোনও ভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়, এক বার শেষ চেষ্টা করে দেখা যায়।
পূর্বা মুখোপাধ্যায়, মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
বেসামাল
সুকান্ত চৌধুরীর লেখার সূত্র ধরে জানাই, গত কয়েক মাসে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে যে ঘটনাবলি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, এর রেশ সারা ভারতের শিক্ষাজগতে এই রাজ্যকে বহু দিন অবধি বহন করতে হবে। যেমন— সত্তর দশকের পর পশ্চিমবঙ্গের বাইরে এ রাজ্যের চাকরিপ্রার্থীদের নকশাল বলে অভিহিত করা হত। এখন বলা হবে, টাকা দিয়ে পাশ করেছে, শিক্ষক হয়েছে। এ কালিমা তুলে ফেলা সহজ কাজ নয়। সুকান্তবাবুর লেখার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলা যায়, বাংলার শিক্ষার একটা সর্বভারতীয় স্বীকৃতি ছিল। সেই স্থান পুনরুদ্ধার করতে বেগ পেতে হবে। এই মুহূর্তে প্রয়োজন, সরকার তদন্তের অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে গেলে চলবে না, যতখানি প্রকাশ্যে এসেছে মুখ্যমন্ত্রীকে কড়া ভাষায় তার নিন্দা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্বচ্ছতা যে কোনও মূল্যে বজায় রেখে শিক্ষক নিয়োগে তৎপর হতে হবে, সে ক্ষেত্রে আইন কখনও বাধা হবে না। তৃতীয়ত, স্কুল-কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের অলিখিত মাতব্বরি, টাকা নিয়ে ভর্তি বন্ধ করতে হবে। দরকার, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনকে স্বাধীন ভাবে কাজ করার অধিকার দেওয়া। তা হলেই আমাদের আত্মবিশ্বাস কিছুটা ফিরবে, শিক্ষাব্রতী মানুষগুলো দেখবে প্রশাসন আমাদের পাশে আছে। তা হলেই এই মুহূর্তে আমরা খানিকটা এই বেসামাল অবস্থা সামাল দিতে সক্ষম হব।
সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা-৩৫
অপরাধী কারা
‘দুই কলেজে ভর্তির আবেদনে বাদ গত বছর পাশ করা পড়ুয়ারা’ (২-৮) প্রসঙ্গে এই লেখা। আমি মনে করি, ২০২১ সালে বারো ক্লাস পাশ করা কোনও পড়ুয়া যদি ২০২২ সালে কোনও কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির আবেদন করে, তবে স্বাভাবিক ভাবেই সে অধিকার তার আছে। কিন্তু যে কারণে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ গত বছর বারো ক্লাস পাশ করা পড়ুয়াদের এই বছর আবেদন করা থেকে বঞ্চিত করলেন, তা শুধু অমানবিকই নয় এক কথায় ভয়ঙ্কর। শ্রীশিক্ষায়তন কলেজ কর্তৃপক্ষের কোনও মতামত যে-হেতু এখনও জানা যায়নি, তাই আশা করব নীরবতা ভঙ্গ করে এ বিষয়ে তাঁদের মতামত জানাবেন।
যে লক্ষ লক্ষ পড়ুয়া গত বছর মূল পরীক্ষা না দিয়েই পাশ করেছিল, তাদের অধিকাংশেরই রেজ়াল্ট বেরোনোর পরে চোখে যে অশ্রু দেখা গিয়েছিল, তা আনন্দের নয়, বেদনার। তাদের নম্বর দেওয়া হয়েছিল সারা বছরের কিছু ক্লাস টেস্ট বা টেস্ট পরীক্ষার (অনলাইন বা অফলাইন) ভিত্তিতে, যে পরীক্ষাগুলো নেওয়ার সময় কেউ-ই জানত না যে, ওই সমস্ত টেস্টের উপর ভিত্তি করেই তাদের দশম বা দ্বাদশ শ্রেণির ফল ঘোষণা করা হবে। স্বাভাবিক ভাবেই অধিকাংশ পড়ুয়া তাদের কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি। তখনই এ আশঙ্কা অভিভাবকদের মনে বাসা বেঁধেছিল যে, আগামী দিনে সমাজ এই পরীক্ষা না দিয়ে পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের সঠিক ভাবে গ্রহণ করবে তো!
আজ দেখা যাচ্ছে, সেই ধারণা ঠিক ছিল। এখন যাদের কলেজে ভর্তি হওয়া থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, সেই ভাবেই আগামী দিনে হয়তো তাদের চাকরি পাওয়া থেকেও বঞ্চিত করা হবে। অর্থাৎ, কোনও দোষ না করেও ২০২১ সালে পাশ করা দশম বা দ্বাদশ শ্রেণির সকল ছাত্রছাত্রী আজ অপরাধী বলে প্রমাণিত হয়ে গেল।
বিশ্বদীপ কর রায়, কলকাতা-৫৪
মৃত্যুঞ্জয়ী
ক্ষুদিরাম। মাত্র ১৮ বছর জীবনকালের এই তরুণ ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর জন্ম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর থানার মৌবনি গ্রামে। বড় দুই ছেলেকে অকালে হারিয়ে ছোট ছেলের মৃত্যুশঙ্কায় তাঁর মা নিজের সন্তানকে বড় বোনের কাছে বিক্রি করে দেন তিন মুঠো খুদের বিনিময়ে। খুদের বিনিময়ে কেনা বলেই তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ক্ষুদিরাম।
ছোটবেলা থেকেই দেশ আর রাজনীতির প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। একটু বড় হয়েই যোগ দেন বিপ্লবী রাজনৈতিক দল ‘যুগান্তর’-এ। সত্যেন বসুর নেতৃত্বে শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক শিক্ষাও লাভ করেন। প্রশিক্ষণ নেন অস্ত্র চালনার উপরও। কর্মদক্ষতার কারণে ক্রমশই তিনি দলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থানে উঠে আসেন। বিপ্লবী দলের নেতারা অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যার গুরুদায়িত্ব দেন তরুণ ক্ষুদিরামের উপর। সঙ্গী হিসেবে পাঠানো হয় প্রফুল্ল চাকীকে। তাঁরা সফল ভাবে কিংসফোর্ডের গাড়িতে বোমা মারলেও দুর্ভাগ্যবশত সেই গাড়িতে ছিলেন না কিংসফোর্ড। ক্ষুদিরাম ধরা পড়লেন পুলিশের হাতে।
হাতকড়া লাগানো ক্ষুদিরামকে ১ মে মুজফ্ফরপুর থেকে আনা হয়। পরের দিন, অর্থাৎ ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২ মে, ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টেটসম্যান লিখেছিল— “একটা ছেলেকে দেখার জন্যে রেল স্টেশনে ভিড় জমে যায়। ১৮ অথবা ১৯ বছরের এক কিশোর হলেও তাঁকে রীতিমতো দৃঢ় দেখাচ্ছিল। বাইরে তার জন্যেই রাখা এক চারচাকার খোলা গাড়িতে উঠতে প্রথম শ্রেণির এক রেল কামরা থেকে বেরিয়ে সে হেঁটে আসছিল, এক উৎফুল্ল কিশোরের মতো, যে কোনও উদ্বেগ জানে না... গাড়িতে নির্দিষ্ট আসনের বসার সময় ছেলেটা চিৎকার করে বলে উঠল ‘বন্দে মাতরম্’।”
বিচারে মৃত্যুদণ্ডের কথা শুনে হেসে উঠেছিলেন তিনি। স্তম্ভিত ইংরেজ বিচারক প্রশ্ন করেন, “তোমার ভয় করছে না?” তিনি উত্তর দিলেন, “আমি গীতা পড়েছি, মৃত্যুভয় আমার নেই।” ক্ষুদিরামের ফাঁসি কার্যকর হয় ১৯০৮ সালের ১১ অগস্ট। ঘড়িতে ভোর ৪টে। ক্ষুদিরামের আইনজীবী উপেন্দ্রনাথ সেনের কথা অনুযায়ী, “ফাঁসির মঞ্চে ক্ষুদিরাম নির্ভীক ভাবে উঠে যান। তাঁর মধ্যে কোনও ভয় বা অনুশোচনা কাজ করছিল না।”
তাই তো বাঁকুড়ার লোককবি পীতাম্বর দাস তাঁকে নিয়ে লেখেন, “এক বার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।”
দিগন্ত চক্রবর্তী , জাঙ্গিপাড়া, হুগলি