—ফাইল চিত্র।
দেবাশিস ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়, শিক্ষাক্ষেত্রে এবং খাদ্য বিভাগের দুর্নীতি ও অনাচারের জন্য প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন আমলা ও পুলিশ অফিসারদের নমনীয় অবস্থান বা উদাসীন মনোভাবকে দায়ী করেছেন তাঁর প্রবন্ধ “‘না’ বলবেন কবে?” (১৬-১১)-তে। আপাতদৃষ্টিতে প্রবন্ধকারের বক্তব্য সঠিক হলেও কয়েকটি প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রথমত, আমলা, পুলিশ বা অন্য কোনও সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মী যদি সরকারের গৃহীত কোনও নীতির কুফল সম্বন্ধে সরকারকে অবহিত করেন, বা ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীদের অন্যায় ভাবে কোনও সুযোগসুবিধা নেওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান, তা হলে হয় তাঁদের সাসপেন্ড করা হবে, নয় তাঁদের কম গুরুত্বহীন পদে বদলি করা হবে। ২০১১ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পরেই বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি-র তৎকালীন প্রধান এসপি ঘড়াইকে সাসপেন্ড করার ঘটনা থেকেই বোঝা গিয়েছিল, তৃণমূল সরকার কোন পথে চলবে।
আবার ২০১২ সালে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের তদন্তকারী অফিসার আইপিএস দময়ন্তী সেনকেও বদলি করে দেওয়া হয় রাজ্য সরকারের মনমতো পথে তদন্তের অভিমুখ পরিচালনা না করার জন্য। গত ১৬ নভেম্বর সম্পাদকীয় স্তম্ভে ‘অস্বচ্ছ’ শীর্ষক প্রবন্ধটি থেকে জানতে পারা যায় যে, সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৯০ হাজার পার হলেও স্বচ্ছতা প্রতিরোধ করতে ভীতি প্রদর্শনের একটা জাল বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে সারা রাজ্যে।
উপরন্তু যে সব শীর্ষস্থানীয় অফিসার রাজ্য সরকারের বা কোনও মন্ত্রীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন, তাঁদের দূরে বদলি করার আশঙ্কা থেকে যায়। আর সরকারের পক্ষ থেকে ভাঙা রেকর্ডের মতো ঘোষণা করা হয় যে, এটা রুটিন বদলি! এর উপর আছে প্রাণের ভয়। অন্য দিকে, শাসক দলের পছন্দমতো কাজ করে বিভিন্ন ভাবে পুরস্কৃত হওয়ার হাতছানি উপেক্ষা করার মতো মানসিক শক্তি ক’জনের আছে?
প্রবন্ধকার পশ্চিমবঙ্গের পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুর আমলে তৎকালীন মুখ্যসচিবের দৃঢ়তার কথা উল্লেখ করেছেন। অবশ্যই তাঁর অবস্থান অতীব প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, তখন বামফ্রন্টের বহুদলীয় সরকার। বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেসের মতো একদলীয় সরকার নয়। বহু দলের সরকারের উপর তার শরিক দলগুলির চাপ থাকে, ফলে একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। এর উপর আছে বিশ্বাস— যাঁকে কাজের ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, তাঁর বিচক্ষণতার উপরে। পশ্চিমবঙ্গে সৎ, দক্ষ এবং নির্ভীক অফিসারের অভাব নেই। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
অমিত কুমার চৌধুরী, কলকাতা-৭৫
নীরবে হজম
“‘না’ বলবেন কবে?” শীর্ষক প্রবন্ধে প্রবন্ধকার যথাযথই বলেছেন, অফিসারদের দায়িত্ব সরকারি নীতি রূপায়ণ, মন্ত্রীদের অভিলাষ পূরণ নয়। রাজনৈতিক প্রভুরা চিরকালই পুলিশ বা আমলাদের বশ করে তাঁদের অনৈতিক ইচ্ছাপূরণ করতে চান। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির বহরে প্রতীয়মান, রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক প্রভুরা পুলিশ এবং আমলাদের ‘দোসর’ করে তাঁদের অভিলাষ পূরণে অগ্ৰসর হয়েছেন। বিধান রায়ের আমলে তদানীন্তন মুখ্যসচিব করুণাকেতন সেনের কথা ছেড়েই দিলাম; বাম আমলে আইএএস অফিসার মোস্তাক মুর্শেদের কথা হয়তো অনেকেরই মনে থাকবে। যিনি দোদর্ণ্ডপ্রতাপ এক মন্ত্রীকে সমুচিত জবাব দিয়ে চাকরি ছাড়তে দ্বিধা বোধ করেননি।
কিন্তু প্রশাসনে বর্তমানে শিরদাঁড়াসম্পন্ন আমলা বিরল। ন্যায়-নীতি, মান-অপমানবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁরা অধিকাংশই প্রথম দিন থেকে মুখ্যমন্ত্রীর আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছেন। এমনকি টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত ভরা প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর অনভিপ্রেত তিরস্কার বা তাচ্ছিল্য সহকারে ‘তুমি’ সম্বোধনও তাঁরা গায়ে মেখে নেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর হল রাজ্য পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত এক ডিজি এবং এক মুখ্যসচিবের ভূমিকা। শীর্ষ পদে থেকে তাঁরা নীরবে এ সব হজম করায় অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা তো দূরস্থান, মুখ্যমন্ত্রীকে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার মতো মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছিলেন বললে বোধ হয় খুব একটা ভুল বলা হবে না। শীর্ষ পদেরই যদি এমন হাল হয়, তবে প্রশাসনের নিচু তলায় যাঁরা আছেন, দলীয় নেতাদের কাছে তাঁদের আত্মসমর্পণের আর কি কিছু বাকি থাকে? একশো দিনের প্রকল্প বা আবাস যোজনায় বেনিয়ম রুখতে বিডিওদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মদত পাওয়া দুরাশা বই আর কিছু নয়। ঠিক এই কারণেই আমপানে ক্ষতিগ্ৰস্তের নামে অর্থ আত্মসাৎকারীদের চিহ্নিত করা হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে এফআইআর বা অন্য কোনও প্রশাসনিক পদক্ষেপ করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
প্রশাসনকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং দুর্নীতিমুক্ত রাখতে প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মী এবং আধিকারিকের অভাবে তিন-সদস্যের রাজ্য ভিজিল্যান্স কমিশন ঢাল-তরোয়ালহীন নিধিরামে পরিণত হয়েছে। একই অবস্থা স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল বা স্যাট-এরও।
প্রশাসনকে প্রধানত গতিশীল এবং জনমুখী করার লক্ষ্যে রদবদল করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনে রদবদল হলেও আদালতে মামলা দায়ের হওয়ার আগে নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও, অভ্যন্তরীণ তদন্ত পর্যন্ত হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কায় সংশ্লিষ্ট দফতরের শীর্ষ আধিকারিকদের ‘না’ বলার অন্তরায় তাঁদের দায় এড়াতে সাহায্য করবে কি না, সেটা ভবিষ্যৎই বলবে।
ধীরেন্দ্র মোহন সাহা, কলকাতা-১০৭
ফের ‘রেউড়ি’
‘মানুষের স্বার্থে’ (১৩-১১) সম্পাদকীয়টি যথার্থই বলেছে যে, নির্বাচন এলেই ক্ষমতাসীন দলের প্রধান যে ভাবে ভোটারদের প্রভাবিত করেন, তাতে ভোট প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিকতাই বিপন্ন হয়ে পড়ে! ক্ষমতায় থাকার জন্য মানুষের সিদ্ধান্তের উপর নেতারা কিছুতেই আস্থা রাখতে পারছেন না। তাই এই লোভের ললিপপ দর্শন৷
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘রেউড়ি রাজনীতি’র বিরোধিতা করেন বটে, কিন্তু ভোট এলে নিজেই তাঁদের ‘উপহার’ দেওয়ার তাগিদটাও বড্ড বেশি অনুভব করেন! নির্বাচন বিধিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে তিনি ঘোষণা করেছেন, প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনার অধীন আরও পাঁচ বছর বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার বন্দোবস্ত তিনি করছেন৷ এই ঘোষণা কি নির্বাচন কমিশনের ভোটবিধির কার্যকারিতার মধ্যেই করতে হবে? এই ঘোষণা আরও ছয়-সাত মাস, কিংবা বছরখানেক আগেই ঘোষণা করে রাখলে কী এমন ক্ষতি হত? শুধু নজরানা বা উপহার বিলি করে ভোট আদায় করা গণতান্ত্রিক পন্থা নয়। আর দেশের প্রকৃত কল্যাণ চাইলে এই ক্ষমতাশালীদের এই দান খয়রাতির রাজনীতি শুধুমাত্র যথেষ্ট নয়। কারণ, তা দেশে উন্নয়নের গতি আনতে ব্যর্থ হয়। মানুষের মধ্যে কর্মক্ষমতা বাড়ানো, কর্মদিবস আরও বাড়িয়ে তুলে উৎপাদন বৃদ্ধিতে গতি আনতে পারে না।
বুঝতে পারছি ক্ষমতাই শ্রেষ্ঠ। ক্ষমতাই একমাত্র লক্ষ্য। বিরোধীরা কিছুতেই ভাগ বসাতে যাতে না পারেন ক্ষমতার মধুভান্ডে, তারই জন্য প্রধানমন্ত্রীর এই অন্ন দান! প্রশ্ন হল, বিনামূল্যে রেশন ব্যবস্থার প্রচলন করেও যদি তাঁরা নির্বাচনে পরাজিত হন, ক্ষমতা যদি হাতে না পান তা হলে? তখন কি এই ভাবে দান বা নজরানা প্রদানের প্রচলন তুলে দেওয়ার আন্দোলনে অংশ নেবেন? না কি আইন বদলে দেওয়ার বিষয়ে চাপ দেবেন?
এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এই অনৈতিক দাম্ভিকতার প্রদর্শন দেশবাসীর কাছে মোটেও সুখকর নয়, তা সে প্রধানমন্ত্রী হন বা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই হন!
বিবেকানন্দ চৌধুরী, কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান