— ফাইল চিত্র।
স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘ইতিহাসের চৌকাঠে’ (৮-৩) পড়ে কিছু কথা। সমাজের বর্তমান কাঠামো এক দিনে তৈরি হয়নি। মাত্র ১৯০৫ সালে বিলেতে মেয়েরা ভোটাধিকার পায়। রাজনীতিতে মেয়েদের মুখ দেখা গেলেও, সেই মুখেরা ‘মুখ্য’ হয়ে উঠুক, তা চায়নি সমাজের ক্ষমতালোভী অন্য এক কাঠামো। এই হল পুরুষতন্ত্রের কাঠামো, যা আবহমান কাল থেকে বুঝিয়ে এসেছে, মেয়েরা শুধু শারীরিক ভাবে নয়, বুদ্ধিতেও দুর্বল ও অসহায়। মেয়েদের একাংশও এর বাইরে বেরিয়ে ভাবতে চায়নি। অনেক মানুষই স্থিতাবস্থায় স্বস্তি ও শান্তি অনুভব করে। তার জন্য নানা রকম যুক্তি ও অজুহাত রচনা করে। পরিবার থেকে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা, সবটাই মেয়েদের কাঁধে ভর করে চলেছে। অথচ, প্রায়ই দেখা যায় যে মেয়েরা রাজনীতি বা অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মাথা ঘামায় না। ‘ও জানে’ বলে পাশ কাটায়। ফলে ব্যবস্থাতে বিন্দুমাত্র নড়াচড়া ঘটে না।
ক্ষমতার এই ধাঁচটা একেবারে গোড়ার দিকে এই রকম ছিল না। সমাজবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, গম বা দানাশস্য এক থেকে অনেক হয়ে ওঠা প্রথম আবিষ্কার করে মেয়েরাই। তার মানে, কৃষিবিদ্যার উপর দখল ছিল মেয়েদেরই। উৎপাদন পদ্ধতির প্রথম আবিষ্কারক নারী, যে সন্তানের জন্মদাত্রী ও প্রতিপালনকারী। পুরুষরা নিজেদের স্বার্থে মেয়েদের শক্তিকে কুক্ষিগত করে নিজেদের এগিয়ে রাখার চেষ্টা করে। প্রধান হাতিয়ার হয় তাদের দৈহিক ক্ষমতা। এখন দেখা যায়, একটা কাঠামোর ভিতর ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টায় নিত্যনতুন কায়দার উদ্ভাবন হচ্ছে। কোথাও বিবিধ সুবিধা দানের রূপ ধরে, আবার কোথাও কাঠামোর মধ্যে পরিবারতন্ত্রের প্রশাখা বিস্তার করে।
তারই সাম্প্রতিক রূপ মহিলা কল্যাণে গ্যাস সিলিন্ডারের সামান্য মূল্য হ্রাস। মহিলা প্রকল্পে আর্থিক সুবিধা। সরকারি বাসে নিখরচায় যাতায়াত। আয়করে ছাড়, পেনশন প্রকল্প প্রভৃতি। সামান্য কিছু ভাতা বৃদ্ধি করে দীর্ঘ দিনের দাবি পূরণকে বলা হয় ‘বেতন বৃদ্ধি’। এগুলো পরবর্তী কালে প্রবল ঢক্কানিনাদে কল্যাণকামী রাজনীতির প্রচারে সুবিধা করে দেয়। মেয়েরা ন্যূনতম এই প্রাপ্তিটুকুকেই যে অনেক বেশি প্রাপ্তি হিসাবে মনে করবে, এ বিষয়ে ক্ষমতাসীনরা নিশ্চিত। আর এখানেই চাপা পড়ে যায় অনেক বেশি মেয়ের রাজনীতিতে মুখ থেকে ‘মুখ্য’ হয়ে ওঠার আকুতি। দিনের পর দিন এটাই চলছে। আমরা বুঝেও বুঝছি না।
প্রতিমা মণিমালা, হাওড়া
শিক্ষাই পথ
স্বাতী ভট্টাচার্যের প্রবন্ধে উঠে এসেছে নারী আন্দোলনের সে কাল থেকে এ কাল। ভোটাধিকার প্রাপ্তি থেকে আজ সাংসদ পদে উন্নীত হওয়া। নারীর অধিকার নিয়ে ফিরে দেখা যাক ভারতবর্ষের ইতিহাসকে। অতীতে ‘মনুসংহিতা’ নারীকে যে চোখে দেখেছে, তা শিক্ষিত মানুষ মাত্রই জানেন। প্রাচীন সাহিত্য রামায়ণ, মহাভারত থেকে শুরু করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীর সমানাধিকারকে কখনও মেনে নেয়নি। মহামানব রামচন্দ্রের সন্দেহপ্রবণ মনও সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে বাধ্য করেছিল। ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’-র ধারণা আজও বীরাঙ্গনাদের কথা বলে না। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক কালেও ঠাকুরবাড়ির বীরাঙ্গনা সরলা দেবী চৌধুরানীকে কম আক্রমণ করা হয়নি। সংবিধান যতই নারীকে সর্বক্ষেত্রে সমানাধিকার দিক না কেন, সমাজ চলেছে তার আপন খেয়ালে। কারণ সমাজ চালনা করেছে পুরুষ, তাই ‘পুরুষতান্ত্রিক’ সমাজের কথা বলা হয়। মৌলবি সাহেবরাই মুসলমান নারীদের কোরান পাঠ বা মসজিদে নামাজ পড়ার অধিকার দিতে নারাজ। হিন্দুদের শবরীমালা মন্দিরে ঋতুমতী নারীর প্রবেশ নিষেধ— এই বিষয়গুলোতে পুরুষদের দাঁত নখ বেরিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তারা এ সবের অধিকার ফিরে পায়।
সব ক্ষেত্রে বিচারালয়ের মুখোমুখি হতে হবে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা খুঁজি, তা হলে দেখা যাবে ‘নারী জাতি’ এই শব্দবন্ধ তৈরির মূলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। নারীদের অধিকার দিতে না চাওয়ার ইচ্ছা থেকেই তাদের আলাদা করা হয়। আমরা যতই কবি নজরুলকে টেনে এনে বলি না কেন, “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার রচিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”, এই একবিংশ শতকেও ঘরের মেয়েদের বাইরে বেরোনোর কথা উঠলেই ঝড় ওঠে। বাড়ির পুরুষদের সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে, এমন কথা আজও বহু পরিবারের আনাচে-কানাচে কান পাতলে শোনা যায়। এমনই সন্দেহপ্রবণ পুরুষ জাতি!
নব্বইয়ের দশকে মেয়েরা পঞ্চায়েতে জায়গা করে নিয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীকে যবনিকার অন্তরালে রেখে বাড়ির পুরুষরাই সেই পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভার কাজকর্ম সামলাচ্ছেন। অন্য দিকে, ২০১০ সালে রাজ্যসভায় ‘মহিলা বিল’ পাশ হলেও ১৪ বছর আটকে পড়েছিল। কংগ্রেস বা বিজেপি, কেউই এই মৌচাকে ঢিল মারতে সাহস করেনি— পাছে পুরুষের সমর্থন খোয়াতে হয়। তবে অবশ্যই স্বীকার্য যে, মোদীজি সেই সাহস দেখিয়েছেন মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ করে।
নারীর সমানাধিকার পেতে স্বাতী ভট্টাচার্যের মত, “তাই কেবল খিল ভাঙার জন্য নোড়া-কুড়ুল হলেই হবে না, চাই ঝাঁটা, রাজমিস্ত্রির যন্ত্রপাতি।” এই মতের সঙ্গে আমি সহমত নই। আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষা ব্যতীত মেয়েরা চার দেওয়াল ভেঙে বাইরে বেরোতে পারে না। অতীতেও পারেননি; যাঁরা পেরেছিলেন তাঁরা কতিপয় শিক্ষিত নারী। শিক্ষাই পারে নারীর অধিকার সুরক্ষিত করতে। অশিক্ষার অন্ধকারকে তাড়াতে নোড়া-কুড়ুল ঝাঁটা বা রাজমিস্ত্রির যন্ত্রপাতি দিয়ে আঘাত করলেও কিচ্ছু হবে না। দিল্লি যত দূরেই হোক, পৌঁছনো যাবে শিক্ষা নামক রথের রশি ধরেই।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
সমান ভাগ
‘ইতিহাসের চৌকাঠে’ শীর্ষক প্রবন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য শুধু পুরুষতান্ত্রিক দলীয় রাজনীতির উপর নির্ভর করে চললে হবে না, নিজেদের পথে নামতে হবে, নারী সংগঠন গড়তে হবে বিভিন্ন মহল্লায়, পাড়ায় পাড়ায়। আন্দোলনের চাপে দুর্ভেদ্য দেওয়াল ভেঙে পড়তে বাধ্য। আমদের যখন প্রায় স্কুল ছাড়ার সময়, তখন নকশালদের দেওয়াল লিখন দেখতাম— “অধিকার চাইলে পাওয়া যায় না, অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়।” এর সত্যতা অনস্বীকার্য। তেত্রিশ শতাংশ কেন, সমানে সমানে পুরুষ ও নারী লড়াইয়ের ময়দানে নামবে। সেই দিনই হবে গণতন্ত্রের আসল দিন।
দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
সংসদের মর্যাদা
স্বাতী ভট্টাচার্য তাঁর প্রবন্ধে দেশের সংসদকে একটি ‘নিরামিষ্যি বাথরুম’ বলেছেন। কথাটি আপত্তিজনক এবং অপমানকর। মেয়েদের সমানাধিকারের লক্ষ্যে বহু আইন এই সংসদেই পাশ হয়েছে। নারীর সামাজিক সুরক্ষা, নারী পাচার থেকে ধর্ষণ, ঘরে-বাইরে হিংসা— সংসদই নেতৃত্ব দিয়েছে জাতিকে।
এক সময়ে ২৯৯ সদস্যের সংবিধান সভায় নারী সদস্য ছিলেন মাত্র ১৫ জন। সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয় নারীর সমান ভোটাধিকার। নারী সদস্যরা মেয়েদের জন্য সংরক্ষণ চাননি। তাঁদের আত্মসম্মান বোধকে সম্মান জানাই। স্বাধীনতার পরে কী ভাবে এই সংরক্ষণ রাজনীতির শিকার হয়ে উঠেছে, আমরা সবাই জানি। মহিলা বিলও এর ব্যতিক্রম নয়। অপেক্ষা না করে যদি রাজনৈতিক দলগুলি আরও বেশি সংখ্যায় মেয়েদের নির্বাচন প্রার্থী করে, সেটাই সংবিধান সভার নারী সদস্যদের প্রতি হবে জাতির সম্মান। প্রবন্ধকার যা বলেছেন, তা বাস্তবায়িত করতে মেয়েদের আরও বেশি করে রাজনীতিতে আসতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলিকেও এ বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে।
অলোক রায়, কলকাতা-৮